১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ। বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন। এই দিনে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন, যা কেবল একটি ভাষণই নয়, বাঙালির মুক্তির সনদ। এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু শুধু স্বাধীনতার ডাকই দেননি, বাঙালি জাতিকে দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা। এই দিনে আমরা গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, যার নেতৃত্বে আমরা পেয়েছি আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ।
৭ই মার্চের ভাষণ আজও বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত, যা ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের মাত্র ১৮ দিন পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালি নিধনে নামলে, বঙ্গবন্ধুর ডাকে শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের পর অর্জিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
৭ই মার্চের ভাষণের প্রেক্ষাপট ছিল অত্যন্ত জটিল ও সংকটপূর্ণ। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ, বঞ্চনা ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতি দীর্ঘদিন ধরে সংগ্রাম করে আসছিল। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করে। এরই প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণে বাঙালি জাতিকে প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেছিলেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত কৌশলে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তিনি বলেছিলেন, “প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।” এই নির্দেশনা বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেছিল। ৭ই মার্চের ভাষণ ছিল মূলত একটি যুদ্ধের ডাক, যা বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জনের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়।
৭ই মার্চের ভাষণের গুরুত্ব অপরিসীম। এটি কেবল একটি ভাষণই নয়, এটি ছিল বাঙালি জাতির জন্য একটি পথনির্দেশিকা। এই ভাষণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত করেছিলেন। এই ভাষণের পরই বাঙালি জাতি বুঝতে পেরেছিল যে, তাদের মুক্তির একমাত্র পথ স্বাধীনতা। ৭ই মার্চের ভাষণ বাঙালি জাতির মনে সাহস ও প্রেরণা জুগিয়েছিল, যা পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৭ই মার্চের ভাষণ আজও আমাদের প্রেরণার উৎস। এটি শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসেই নয়, বিশ্ব ইতিহাসেও একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই ভাষণ শুধু বাঙালি জাতিকেই নয়, বিশ্বের সকল নিপীড়িত মানুষের জন্যও একটি অনুপ্রেরণা। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আমাদের সর্বদা সচেতন ও প্রস্তুত থাকতে হবে।
৭ই মার্চের ভাষণ বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক অনন্য মাইলফলক। এটি আমাদের জাতীয় জীবনের একটি গৌরবময় অধ্যায়। এই দিনটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় বঙ্গবন্ধুর ভিশনারি নেতৃত্বের কথা, যার কারণে আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি। ৭ই মার্চের ভাষণ আমাদেরকে শেখায় যে, ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম করলে লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব। ৭ই মার্চের ভাষণ কেবল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা নয়, এটি বাঙালি জাতির হৃদয়ে চিরভাস্বর এক অধ্যায়। এই ভাষণ আমাদেরকে প্রতিনিয়ত অনুপ্রাণিত করে, আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে শেখায়। ৭ই মার্চের ভাষণ বাঙালি জাতির জন্য চিরকাল প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ১৪ই অগাস্ট রাত ৮টা নাগাদ ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া শেষে রাত ১২টার দিকে ঘুমাতে যান। এর পরের ইতিহাস আমরা সবাই কমবেশি জানি।
ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িটি ছিল শুধু একটি আবাসিক স্থান নয়, বরং বাংলাদেশের ইতিহাসের এক জীবন্ত সাক্ষী। এই বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধু দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং বাঙালি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু সেই রাতের পরের ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক কলঙ্কিত অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ১৫ই আগস্ট ভোররাতে একদল বিপথগামী সেনা কর্মকর্তার হাতে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের বেশিরভাগ সদস্য নির্মমভাবে নিহত হন। এটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক মর্মান্তিক ও বেদনাদায়ক ঘটনা, যা জাতিকে গভীর শোকে নিমজ্জিত করেছিল।
দুঃখের বিষয়, বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত এই ঐতিহাসিক স্থান এবং তার অসংখ্য মূল্যবান দলিল-দস্তাবেজ বর্তমান সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে ধ্বংস করা হয়েছে। এটি শুধু একটি বাড়ি বা কাগজপত্রের ধ্বংস নয়, এটি বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের একটি অংশের ধ্বংস।
বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত এই বাড়িটি সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের পরিবর্তে এটিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এটি শুধু বঙ্গবন্ধুর পরিবারের জন্য নয়, সমগ্র বাঙালি জাতির জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও কর্ম বাংলাদেশের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তার স্মৃতিবিজড়িত স্থান ও দলিল-দস্তাবেজ সংরক্ষণ করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয়, বর্তমান সরকারের আমলে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকে মুছে ফেলার এই অপচেষ্টা বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি এক চরম অবহেলা। আমরা আশা করি, ভবিষ্যতে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকে সমুচিত মর্যাদা দেওয়া হবে এবং তার জীবন ও কর্মের সাক্ষ্যগুলো সংরক্ষণ করা হবে। কারণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু একটি নাম নন, তিনি বাঙালি জাতির হৃদয়ে চিরভাস্বর এক অধ্যায়।