বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দীর্ঘদিন থেকে অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। দিন দিন পরিস্থিতি আরো বেশি ঘোলাটে হচ্ছে বলে দৃশ্যমান। প্রশ্ন এসেছে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে কি না?
পরিস্থিতি অত্যন্ত অনিশ্চিত, কারণ একাধিক রাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতার জন্য প্রতিযোগিতায় নেমেছে, এবং আইন-শৃঙ্খলার অবনতি একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সম্ভাবনাকে ম্লান করে দিচ্ছে।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত ছাত্ররা যারা বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছে, যা এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। এই নতুন দল, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), একটি তরুণ ও সক্রিয় জনগোষ্ঠীর সমর্থন নিয়ে রাজনৈতিক গতিপথ বদলানোর তীব্র চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের এই চেষ্টা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ভালো চোখে দেখছে না। তাদের উত্থান ইতিমধ্যেই অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল) ক্ষমতায় ফিরতে পারবে বলে ধারণা করেছিল। কিন্তু তাদের এই পথ এখন ধীরে ধীরে জটিল হয়ে উঠেছে, কারণ জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ-এর প্রভাব বাড়ছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী দলের প্রভাব দৃশ্যমান। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে যে জামায়াতে ইসলামী তরুণদের নতুন দলের সাথে হাত মিলিয়ে ক্ষমতায় যেতে চায়। এই তিন পক্ষের সংঘাত—বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং নতুন গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)—রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে সামনের দিনগুলোতে আরও অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।
দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ এখন চ্যালেঞ্জের মুখে। যদিও দলটি শক্তিশালী অবস্থানে ছিল, কিন্তু শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর বস্তুত প্রথম, মধ্যম এবং তৃণমূল পর্যায়ের সকল নেতাকর্মী এখনো পালিয়ে বেড়াচ্ছে। অনেকেই জেল হাজতে।
অভ্যন্তরীণ বিভেদ, ব্যাপক দুর্নীতি জনগণের অসন্তোষ তাদের অবস্থানকে দুর্বল করে দিয়েছে। দলটি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কি না, তা অনিশ্চিত, কারণ তাদের বিরুদ্ধে কর্তৃত্ববাদী আচরণ ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। আওয়ামী লীগ যদি নির্বাচন থেকে সরে যায় বা বর্জন করে, তাহলে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা হারাতে পারে, যা রাজনৈতিক সংকটকে আরও গভীর করবে।
আইন-শৃঙ্খলার অবনতি বর্তমান পরিস্থিতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। হত্যা, ধর্ষণ, ডাকাতি ও চুরির মতো ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় দেশে ভয় ও অস্থিতিশীলতার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা কমে গেছে। ভোটারদের ভীতি প্রদর্শন, সহিংসতা ও নির্বাচনী জালিয়াতির সম্ভাবনা নির্বাচনের ফলাফলের বৈধতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলতে পারে, যা আরও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে।
এই চ্যালেঞ্জগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা অনিশ্চিত। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যার মূল দায়িত্ব নির্বাচনের জন্য একটি নিরপেক্ষ পরিবেশ নিশ্চিত করা, তারই সঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর যোগসাজশের অভিযোগ উঠেছে। এই অনাকাঙ্ক্ষিত সংশ্লিষ্টতা নির্বাচনী প্রক্রিয়ার প্রতি জনগণের আস্থা কমিয়ে দিতে পারে। এছাড়াও, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ৫ই আগস্ট এর আগে এবং পরে বাংলাদেশ পুলিশ সদস্যদের মনোবল ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এই অবস্থায় নিরাপত্তা ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য উন্নতি ও রাজনৈতিক সহিংসতা কমানো ছাড়া একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি করা কঠিন হবে।
সব মিলিয়ে বাংলাদেশ এখন একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর মধ্যে তিন পক্ষের সংঘাত, নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান এবং আইন-শৃঙ্খলার অবনতি আগামী দিনগুলোর জন্য একটি ভয়াবহ চিত্র তৈরি করেছে। যদি এই পরিস্থিতিতেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে সহিংসতা ও জালিয়াতির অভিযোগে তা ডুবে যেতে পারে, যা দেশকে আরও গভীর সংকটে ফেলতে পারে।
অন্যদিকে, নির্বাচন পিছিয়ে দিলে দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হতে পারে, যা সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলবে। এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি স্পষ্ট নয়, এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সতর্ক দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছে যে বাংলাদেশ কীভাবে তার গণতান্ত্রিক যাত্রার এই সংকটময় মুহূর্ত অতিক্রম করে।
এই প্রেক্ষাপটে আঞ্চলিক শক্তি, বিশেষ করে ভারতের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহাসিকভাবে ভারত আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে, কারণ তারা আওয়ামী লীগকে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও ইসলামী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মূল মিত্র হিসেবে দেখে। যদি আওয়ামী লীগ নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে সরে যায় বা বাদ পড়ে, তাহলে ভারত সরকার সেই ফলাফল মেনে নেবে বলে মনে হয় না। ভারতের প্রধান উদ্বেগ হলো জামায়াতে ইসলামীর মতো ইসলামী শক্তির উত্থান, যা তারা তাদের নিজস্ব নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক স্বার্থের জন্য হুমকি হিসেবে দেখে। এছাড়াও, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর উত্থান ভারতের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে, কারণ এই দলটি ভারতের কৌশলগত লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।
সর্বোপরি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচন আয়োজনের চেষ্টা করলেও বর্তমান রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি একটি সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনাকে ক্ষীণ করে দিয়েছে। উল্লেখযোগ্য নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা ছাড়া বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে নির্বাচন ভারত তথা আন্তর্জাতিক বিশ্বের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না, যা এই জটিল পরিস্থিতিতে আরও একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
আগামী দিনগুলোই নির্ধারণ করবে বাংলাদেশ এই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারে কি না এবং একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বৈধ নির্বাচন আয়োজন করতে পারে কি না?
প্রদীপ রায়
সম্পাদক, ওটিএন বাংলা, মেলবোর্ন
৮ মার্চ, ২০২৫