অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের আট মাস পরেও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে জনমনের উদ্বেগ কাটেনি। দেশে অহরহই ঘটছে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ ডাকাতি এমনকি হত্যাকাণ্ডও। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ঢাকার বেশ কিছু এলাকায় দিনের আলোয় ধারালো অস্ত্র নিয়ে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। এতে সন্ধ্যার পর বের হতে ভয় পাচ্ছেন অনেকেই। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি দৈনিক যুগান্তরের কাভার নিউজ “ঢাকায় ছিনতাইয়ের ৪৩২ হটস্পট- রাজধানীতে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে ছিনতাই। নগরীর ৫০ থানা এলাকায় ছিনতাইকারীদের ৪৩২টি হটস্পট চিহ্নিত হয়েছে। এসব স্থানে সক্রিয় ১২শ ছিনতাইকারী।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২৫ মধ্যে, ডাকাতির মামলা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধির কথা জানিয়েছে পুলিশ। সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ষণসহ নারী ও কন্যাশিশুদের ওপর সহিংসতার প্রতিবাদ এবং ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার দাবিতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গতকাল রোববার বিক্ষোভ মিছিল, প্রতিবাদ সমাবেশ, সড়ক অবরোধসহ নানা কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। ধর্ষণ, নিপীড়ন, নির্যাতনসহ নারীর ওপর একের পর এক সহিংসতার প্রতিবাদে লাঠি, মশাল নিয়ে মিছিল করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।
সম্প্রতি এক রিপোর্টে জানানো হয়, ৫ আগস্টের পর মাত্র পাঁচ মাসে বাংলায় খুন হয়েছেন ৩২ হিন্দু। ১৩ জন সংখ্যালঘু মহিলাকে ধর্ষণ ও গণধর্ষণ করা হয়েছে। ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে ১৩৩টি মন্দির। সারা দেশে ছোট–বড় অসংখ্য মাজারে হামলা–ভাঙচুর করা হয়েছে।
বাধার মুখে একের পর এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান স্থগিত করা হয়েছে। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ‘ঢাকা মহানগর নাট্য উৎসব’। অনুষ্ঠানটি ১৫ই ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু একদল লোকের বাধার মুখে শেষ মুহূর্তে অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেয় আয়োজকরা। বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব ঘটনা দমাতে স্থানীয় সরকারের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ গত পাঁচই অগাস্ট সরকার পতনের পর থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে এরকম ঘটনা ঘটছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অভিযোগ, ‘তৌহিদী জনতা’ নামে ‘একদল লোক’ এগুলো ঘটাচ্ছে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটেছে আরও অদ্ভুত ঘটনা। সিন্ডিকেট সভায় সেখানকার হলসহ ১৯টি স্থাপনার নাম পরিবর্তন করা হয়, যেখানে মাত্র দুটোর নামের সঙ্গে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পর্ক ছিল। কিন্তু বাকিগুলো ছিল বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী ড. সত্যেন্দ্রনাথ বসু, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, কবি জীবনানন্দ দাশ, লালন সাঁই, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় এবং বিভিন্ন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নামে। কী কারণে ওই স্থাপনাগুলো থেকে জাতির এ শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নাম কাটা গেল? শিক্ষার্থীরা নাকি পুরোনো নামগুলোর ব্যাপারে ‘আপত্তি’ জানিয়েছিল। কোন শিক্ষার্থী; তারা মোট শিক্ষার্থীর কত ভাগ– জানানো হয়নি।
তৎকালীন শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদ উদ্দিন এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, আমরা ছোটবেলা থেকে জগদীশ বসুর গল্প শুনেছি। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে জগদীশ চন্দ্র বসু, তার মতো বিজ্ঞানীর নামে করা ভবন-স্থাপনা ছিল, সেগুলোর নাম পরিবর্তন করেছে। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্রের নামে স্থাপনা ছিল। তার পাশাপাশি আরও কয়েকজনের নামে করা স্থাপনার নামও বদলানো হয়েছে। এটি আমাকে মর্মাহত করেছে। অধ্যাপক ওয়াহিদ উদ্দিন বলেন, জগদীশ চন্দ্র বসুর নামে করা ভবনের নাম পাল্টানো হবে, এটা কল্পনার বাইরে। আমি আশা করব, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষার্থীরা মিলে এর প্রতিকার করবে। এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যে সরকারের কোন হাত নেই তা স্পষ্ট! এরপরে ওনাকে শিক্ষা উপদেষ্টার পদ থেকে সরানো হয়।
ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি ভাঙচুর ও দেশজুড়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটল। এ সময় বিশাল জনতাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে স্পষ্টতই ব্যর্থ হয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। পরবর্তীতে সরকার সমালোচনার মুখে এই ভাঙচুর বন্ধ করতে বললেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কার্যকর ভূমিকা পালন করেনি।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির কোষাধ্যক্ষ এম রশিদুজ্জামান মিল্লাত গত ৫ মার্চ দৈনিক কালবেলাকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ।
প্রশ্ন উঠেছে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আইন-শৃঙ্খলা উন্নয়নে সক্ষম হবে কিনা?
আমার মতামত হচ্ছে, না! মতামতের পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। প্রথমত, সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বেশিরভাগ সদস্য, যার মধ্যে অনির্বাচিত সরকার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনুসও রয়েছেন, তাদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং রাজনীতির সাথে সংযোগ সীমিত। ডঃ মুহাম্মদ ইউনুস অনেকটা উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন। রাজনৈতিক দূরদর্শিতা এবং দক্ষতা বিষয়টি এমন নয় যে হঠাৎ করে বড় কিছু পরিবর্তন সম্ভব। এই পরিস্থিতিতে, বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ ও জটিল জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা তার নাই বললেই চলে। সরকারে থাকা অন্যান্য উপদেষ্টা মন্ডলী সদস্যগণেরই একই অবস্থা।
দ্বিতীয়ত, আগস্ট ৫ এর আগে ও পরে পুলিশ অফিসারদের নৃশংস হত্যাকাণ্ড পুলিশ বাহিনীর মনোবল ভেঙে দিয়েছে। পুলিশ সদস্যরা এখনও হামলার শিকার হচ্ছেন এবং তাদের দায়িত্ব পালনে ভয় পাচ্ছেন। মেরুদণ্ড ভেঙ্গে যাওয়া পুলিশ বাহিনীকে সাধারণ মানুষের আস্থায় আনা সম্ভব হয়নি এখনও। পুলিশ বাহিনীও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় শত চেষ্টা করেও সাবলীল হতে পারছেন না বলে মনে করছেন সাধারণ মানুষ। তারা মনে করেন, পুলিশ বাহিনীকে সাধারণ মানুষের আস্থায় ফিরিয়ে আনা বর্তমান সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ।
এছাড়াও, জনতার বিচার বা মব জাস্টিস একটি বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে, যা আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। ৫ আগস্টের পর অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হয়েছে তার সঠিক হিসাব নেই। যদিও গত রোববার আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, “সাম্প্রতিক পরিস্থিতি আমাদের সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এখন থেকে আরও কঠোর হতে হবে। মব জাস্টিস বা অরাজকতা সৃষ্টির যেকোনো প্রচেষ্টাকে কঠোর হাতে দমন করা হবে।” এই বার্তা সরকারের দেশ পরিচালনায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ব্যর্থতা এবং অদক্ষতার কথাই মনে করিয়ে দেয়।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পরও বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা অব্যাহত রয়েছে। বর্তমান সরকার শুরুর দিকে নির্বাচন সংক্রান্ত আলাপ বাদ দিয়ে নানামুখী সংস্কারের দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের চির ধরা শুরু করে। গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া সমন্বয়ক এবং তরুণদের নিয়ে গঠিত এ দলটি সরকারি সমর্থনে এবং পৃষ্ঠপোষকতা সৃষ্টি হয়েছে কিনা এমন প্রশ্ন উঠেছে। এর মধ্যে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), নেতা নাহিদ ইসলাম সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে ২০২৫ সালের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, যা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনের চ্যালেঞ্জকে নির্দেশ করে।
এছাড়াও, নিষিদ্ধ ইসলামী গোষ্ঠীগুলোর পুনরুত্থান সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকায় হিজবুত তাহরীরের সদস্যদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ এই গোষ্ঠীগুলোর দমন করতে সরকারের অক্ষমতা প্রকাশ করে। এরা প্রকাশ্যে ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের পরিবর্তে ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠার দাবি করছে, যা সরকারের জন্য জনগণের শৃঙ্খলা বজায় রাখাকে কঠিন করে তুলেছে।
গত তিন মার্চ ডঃ মুহাম্মদ ইউনুস বিবিসি বাংলাকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, একটা পলাতক দল সর্বাত্মক চেষ্টা করছে আনসেটেল করার জন্য। এই পলাতক সরকার বলতে ডঃ মোঃ ইউনুস আওয়ামী লীগ কে বুঝিয়েছেন। এইজন্য সরকারের “অপারেশন ডেভিল হান্ট” নামক অভিযান, যা ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সমর্থকদের গ্রেপ্তারের লক্ষ্যে পরিচালিত হচ্ছে, সমালোচকদের মতে এটি বিরোধী মতদমন হিসেবে দেখা দিচ্ছে। এই অভিযানে হাজার হাজার মানুষ গ্রেপ্তার হয়েছে, তাতে কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতাও কমেনি এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও উন্নতি হয়নি বরং দিন দিন অবনতি হচ্ছে। “অপারেশন ডেভিল হান্ট” নামক অভিযান, রাজনৈতিক বিভাজন বাড়িয়ে তুলতে পারে এবং সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা কমিয়ে দিতে পারে।
সর্বোপরি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রাজনৈতিক দক্ষতার অভাব, পুলিশ বাহিনীর মনোবল হ্রাস, চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, ইসলামী গোষ্ঠীগুলোর উত্থান এবং বিতর্কিত আইন প্রয়োগ পদ্ধতি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সমস্যাগুলো সমাধান না করে সরকারের পক্ষে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে।
প্রদীপ রায়,
সম্পাদক- ওটিএন বাংলা, মেলবোর্ন