আমার ছেলে তোমাকে পছন্দ করেছে কিন্তু কখনও বলেনি তোমার সঠিক বয়স কত। আমি তোমার আইডি কার্ড মানে বার্থ সার্টিফিকেট দেখতে চাই।
আইডি কার্ড দেখতে হবেনা আন্টি। আমার বয়স চৌত্রিশ।
তাও আমি দেখে কনফার্ম হতে চাই।
যদি দেখেন বয়স তারচেয়ে কম বা বেশী তাহলে কি করবেন?
তুমি মুখে মুখে কথা বলছো কেন? এরেঞ্জ ম্যারেজ অনেকটা বাজারে গিয়ে দেখে শুনে নেয়ার ব্যাপার। বিয়ের পরে এটা নিয়ে কথা চালাচালি হবার চেয়ে বিয়ের আগে দেখে নেয়াটাই কি ভালো না?
নিতান্ত বিরক্তি আর রাগে দুঃখে মিতি উঠে যায় তার বার্থ সার্টিফিকেটের কপিটা আনতে। এতো বয়স হয়েছে বিয়ে কেন হচ্ছেনা, বাচ্চা কবে হবে, আর কতদিন বাবা মা মেয়ের রোজগার খাবে; ইত্যাকার কথার অত্যাচার থেকে প্রায় মুক্তির দুয়ারে দাঁড়ানো অবস্থায় হবু বরের স্বয়ং মা যদি এমন আঙ্গুল তোলে, কনের জন্য ব্যাপারটা আতংক ও ভীষণরকম বিব্রতকর হবে সেটাই যে স্বাভাবিক। বিয়ের জন্য সব আয়োজন যে বলতে গেলে প্রস্তুত ততদিনে। হবু বর রাহাতের দিক থেকে আগ্রহটা অবশ্যই বেশী ছিল বলেই না ছয় সপ্তাহের মধ্যে মিতির সাথে বিয়ের আয়োজন করা হয়। অথচ বিয়ের পাঁচদিন আগে রাহাতের মা জরুরী তলব ডেকে বসেছে মিতির বয়স কত তা তাকে যাচাই করতে হবে এখন। হঠাৎ উনি কেন যে এমন বয়স নিয়ে পড়লেন কে জানে?
‘আমি সবসময় চেয়েছি আমার ছেলের বৌ ছেলের থেকে অন্তত পাঁচ বছরের ছোট হবে। তাতে তাদের আন্ডারস্ট্যান্ডিং ভালো হবে। আর তাছাড়া বাচ্চা কাচ্চা হবারও তো একটা ব্যাপার আছে। চারদিকে আরো কম বয়সে বিয়ে হয়ে গেছে এমন মেয়েদেরই বাচ্চা হচ্ছেনা, সেখানে তোমার ব্যাপারে তো কি বলবো তাই বুঝে পারছিনা। আমি জানতামই না ও ওর কাছাকাছি বয়সের মেয়েকে পছন্দ করেছে। রাহাত, তুই এখানে বিয়ে করতে চাইলে নিজ দায়িত্বে করতে পারিস, আমি এই বিয়েতে নেই।’
ঘরের মধ্যে বাজ পড়লেও বোধহয় মিতির পরিবার এরচেয়ে স্বাভাবিকভাবে নিতো। প্রাকৃতিক দূর্যোগ যে কোন সময় যে কোন জায়গায় আসতেই পারে। কিন্তু মনুষ্য সৃষ্ট এমন ভূকম্পন! তাও বিয়ের সব আয়োজন শেষ, সব আত্মীয়স্বজন বলা শেষ এসময়ে এমন কথা! তবে সব কিছু পেরিয়ে কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেয়ার ঘটনা বুঝি মিতির পরিবার স্বচক্ষে দেখতে পায় যখন মায়ের পিছু পিছু দরজা খুলে রাহাতও বের হয়ে বাসার সামনে পার্ক করে রাখা গাড়িতে উঠে যায়।
…………….
পরের একটা বছর মিতি ডুবে গিয়েছিল এক গভীর বিষন্নতার সাগরে। প্রত্যাখ্যানের কষ্টের চেয়েও কঠিন ছিল লোকের তীর্যক কথার ঢেউ সামলানো।
কথায় বলে সৃষ্টিকর্তা কেবল মানুষকে তখনই সেই জিনিসটা দেন যখন সে সেটার যোগ্য হয়। আর তাই রাহাতের সাথে বিয়েটা ভেঙে গেলেও বছর না ঘুরতেই পারিবারিক পছন্দেই মিতির বিয়ে হয় দীপুর সাথে। যে অজুহাতে রাহাতের মা বিয়েটা ভেঙে দিয়েছিল সে অজুহাতও সৃষ্টিকর্তা দূর করে দেন বিয়ের বছর পেরিয়ে মিতির মা হবার খবরে।
প্রথম নাতির জন্মদিন উপলক্ষ্যে মিতির বাবা মা জন্মদিনের আয়োজন করেছেন আজ। সকাল বেলাতেই মিতি চলে এসেছে তার ছেলেকে নিয়ে মায়ের বাসায়। মিতিকে অবাক করে দিয়ে সকালবেলাতেই তার নামে কুরিয়ারে হাজির হয় এক উপহারের বাক্স। প্রেরকের নাম নিলুফার আহমেদ। মিতি অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারেনা এই নামে কাউকে চেনে কিনা?
বাক্সের ভেতর একটা বাচ্চাদের খেলনা আর একটা খাম বন্ধ চিঠি। কে হতে পারে ভাবতে ভাবতেই চিঠি খোলা হয়ে যায় মিতির।
‘স্নেহের মিতি,
তোমাকে প্রিয় বলে সম্বোধন করলাম না কারণ আমার নিজের ছেলের বৌ হলে হয়তো আমার সে অধিকার থাকতো। তবে গুরুজন হিসেবে স্নেহের তো বলাই যায়, তাইনা?
খুব অবাক হচ্ছো নিশ্চয়ই আমি কে? কেন তোমাকে চিঠি লিখলাম? পরিচয়টা এ বেলা আগে দিয়ে নেই নয়তো তুমি চিঠিটা এলোমেলোভাবে পড়বে। আমি রাহাতের মা, যে রাহাতের সাথে তোমার বিয়েটা হতে দেয়নি। আমার গল্পটুকু বলার আগে তোমার সাথে হওয়া অন্যায়ের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
অক্ষমতা শব্দটার জোর কতটুকু জানো? একটা জীবন, একটা পরিবার, একটা সাম্রাজ্য পর্যন্ত শেষ হয়ে যেতে পারে এই অক্ষমতা শব্দের ঝড়ে। রাহাত যখন তোমার কথা প্রথম আমাকে বলে আমি খুশী মনেই বিয়েতে রাজী হয়েছিলাম। সেজন্যই বিয়ের আয়োজনে কোন বাঁধা শুরুতেই দেইনি। তারপর যখন বিয়ের কেনাকাটা শুরু হলো সেদিন কথা প্রসঙ্গে কথা ওঠে তোমার বয়স নিয়ে। তোমার বয়স শুনে আমার হঠাৎ বুকের ভেতর কেমন ধ্বক করে ওঠে।
তোমার মনে আছে কিনা জানিনা, রাহাতের বাবা এবং আমি দুজনেই হেলথ সেকটরে জব করি। সে সুবাদে ডাক্তারদের সাথে ওঠাবসা আমাদের সবসময়ই ছিল। রাহাতের খুব ছোটবেলায় একবার মাম্পস হয়েছিল। লম্বা সময় ভুগেছিল ও। সু্স্থ হবার পর ওর ডাক্তার বলেছিল বড়বেলায় যেন ওর স্পার্ম কাউন্টটা করানো হয়। ব্যাপারটা আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম। তোমার বয়সজনিত বাচ্চা হওয়া নিয়ে ঝামেলা হতে পারে এই বিষয়ক মন্তব্য করার আগে আমার ছেলের কোন ঝামেলা আছে কিনা সেটা কেন যে আমার মাথায় আসে জানিনা। কিছু হবেনা, বিয়ে হলে পরে দেখা যাবে ইত্যাকার ভাবনার পাশাপাশি নেগেটিভ ভাবনাগুলোকেও কোনভাবে তাড়াতে পারছিলামনা মনের থেকে। গভীর রাতে নামাজে বসে আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলাম, আমাকে সঠিক পথ দেখানোর জন্য। আমি কিছুতেই চাইছিলামনা আরেকটা মেয়ের ক্ষতি হোক। রাহাতের বাবা আর আমি মিলে বসে রাহাতকে খুলে বলি সব।
আমাদের সব দুঃস্বপ্নকে সত্য করে রাহাতের রিপোর্ট এলো এজোস্পার্মিয়া। আমরা কেউ সারারাত সেদিন ঘুমাইনি, জানো। ভোর সকালে ফজরের নামাজ শেষে সিদ্ধান্ত নেই তোমাদের বাসায় আসবো। রাহাত সেদিন আমার পিছু পিছু উঠে এসেছিল বলে তুমি কতটা দুঃখ পেয়েছিলে আমি জানিনা। হয়তো পুরো পুরুষজাতির ওপরেই তোমার জন্মেছিল এক নিদারুন বিতৃষ্ণা। কিন্তু তুমি যেটা জানতে পারোনি বাড়ি ফেরার পুরোটা পথ আমরা মা ছেলে হাউমাউ করে কেঁদেছি। তারপর আরো কত শত রাত আমরা জেগে কাটিয়েছি তা আমি গুনে বলতে পারবোনা মিতি। রাহাতের রুমের দরজা লাগাতে দিতামনা পাছে ছেলেটা আত্মহত্যা করে বসে। দেশের কোন সাইকিয়াট্রিস্ট সাইকোলজিস্ট বাদ দেইনি রাহাতের জন্য। তোমার নাম্বারটা ব্লক করে রাখলেও তোমার খবর আমি রেখেছি সবসময়। তুমি আমার রোজদিনের প্রার্থনায় ছিলে।
বলতে পারো কেন তোমাকে জানাইনি তখন? ধরে নিলাম, তুমি মানুষ হিসেব অসম্ভব ভালো। তুমি হয়তো ওভাবেই রাহাতকে মেনেও নিতে। কিন্তু সত্যি কথা কি জানো মিতি, সংসারের চাল ডালের গল্প যখন একঘেয়ে হয়ে যায় মানুষ তখন সন্তানের গল্প খোঁজে। অনেক অনেক ভালবাসার মাঝেও তোমার মনে তখন খুঁতখুঁত তৈরী হতো, কেন তুমি একটু খারাপ হলেনা। আমি কখনোই চাইনি আমার ছেলের জন্য আরেকটা নিষ্পাপ মেয়ের জীবন নষ্ট হোক। তুমি কোনদিন আমার রাহাতকে ক্ষমা করতে পারবে কিনা জানিনা। তবে জেনে রেখো রাহাত তোমাকে খুব খুব ভালবেসেছিল।
তোমার আর তোমার ছেলের জন্য অনেক অনেক দোয়া রইলো।
ইতি
এক হতভাগা মা।’
চিঠিটা পড়তে পড়তে কখন যে দু চোখ জলে ভেসে গেছে টেরই পায়না মিতি। যে জীবন পেতে পেতেও হারিয়ে ফেলেছে অনেকটা দিন আগে, যে জীবনটাকে মনে প্রানে ভুলে যেতে চেয়েছে গত কয়েকটা বছর, যে জীবনটা তার অস্তিত্বকে একটা সময় ঠেলে দিয়েছিল খাদের মুখে, চিঠিটা পড়ার পর সেই জীবনটার জন্যই কেন যে এক অযাচিত হাহাকার কাঁপিয়ে দেয় মিতিকে তার কোন ব্যাখ্যা যে মিতির নিজের কাছেও নেই।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস, জেনারেল প্র্যাকটিশনার
মিলডোরা, ভিক্টোরিয়া