মেলবোর্ন -২ মার্চ- মার্কিন প্রভাবশালী দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস গতকাল ১ এপ্রিল “As Bangladesh Reinvents Itself, Islamist Hard-Liners See an Opening” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছাপিয়েছে। তারাগঞ্জ ও ঢাকা থেকে নিউইয়র্ক টাইমসের এই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন মুজিব মাশাল এবং সাইফ হাসনাত।
কী আছে এই প্রতিবেদনে?
বাংলাদেশে রাজনৈতিক শূন্যতার সুযোগ নিয়ে ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলি ধীরে ধীরে তাদের প্রভাব বিস্তার করছে। দেশের দীর্ঘদিনের ধর্মনিরপেক্ষ নীতির মুখোশের নিচে সুপ্ত থাকা ইসলামপন্থী প্রবণতা এখন দৃশ্যমান হচ্ছে। দেশের একাধিক শহরে নারীদের স্বাধীন চলাফেরার ওপর বিধিনিষেধ আরোপের চেষ্টা চলছে। তরাগঞ্জের মতো একটি ছোট শহরে স্থানীয় মসজিদের ইমাম আশরাফ আলীর চাপে নারী ফুটবল ম্যাচ বাতিল করা হয়েছিল। পরে নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতিতে ম্যাচ আয়োজন করা সম্ভব হলেও নারীদেরকে তথাকথিত ‘শালীন’ পোশাক পরতে বাধ্য করা হয়। একইভাবে, আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মতো ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপাসনালয় ভাঙচুর করা হয়েছে এবং তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ক্রমাগত সীমিত করা হচ্ছে। ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে ইসলাম অবমাননাকারীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর না হলে জনতা নিজেরাই শাস্তি দেবে বলে হুমকি দেয়। নিষিদ্ধ ঘোষিত একটি গোষ্ঠী প্রকাশ্যে খিলাফত প্রতিষ্ঠার দাবিতে মিছিলও করেছে। এই ধরনের চরমপন্থী কর্মসূচিগুলো ইঙ্গিত দেয় যে, বাংলাদেশ এক নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে।
বিস্তারিত প্রতিবেদনটি নিচে তুলে ধরা হলো।
সংবিধানে পরিবর্তন এবং ধর্মীয় রাষ্ট্রের দাবি
বাংলাদেশের নতুন সংবিধান প্রণয়ন কমিটির বেশ কয়েকজন সদস্য স্বীকার করেছেন যে দেশটির ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র পরিবর্তনের বিষয়টি এখন আলোচনায় রয়েছে। সম্ভাব্য নতুন সংবিধানে বহুত্ববাদকে গুরুত্ব দেওয়া হতে পারে, যা বাংলাদেশকে আরও ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
নারীদের জন্য নতুন সংকট
প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সহ বিরোধী দলীয় নেত্রী যারা গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন, তারা এখন দেখতে পাচ্ছেন যে রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে নারীদের স্বাধীনতা সংকুচিত হচ্ছে। নারী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য পরিস্থিতি ক্রমশ প্রতিকূল হয়ে উঠছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক শেখ তাসনিম আফরোজ ইমি বলেন, “আমরা গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করেছিলাম, কিন্তু এখন দেখি যে আমাদের চেয়ে ধর্মীয় কট্টরপন্থীরাই বেশি শক্তিশালী।” সরকারের অস্থায়ী নেতৃত্ব ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্বলতার কারণে এই প্রবণতা দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে।
মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অস্থায়ী সরকার: সংকটের মধ্যে সমন্বয়হীনতা
শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশে যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে, যার নেতৃত্বে রয়েছেন ৮৪ বছর বয়সী নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস। তবে সমালোচকরা মনে করেন, ইউনুস সরকার ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে স্পষ্ট ও কঠোর অবস্থান নিতে ব্যর্থ হয়েছে। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর মধ্যে সমন্বয়হীনতা এবং অতীতের দমন-পীড়নের দায় নিয়ে উত্তেজনা চলমান থাকায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। সরকার একদিকে গণতান্ত্রিক সংস্কার আনতে চাচ্ছে, অন্যদিকে উগ্রবাদী শক্তিগুলোর উপস্থিতি ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। পুলিশ বাহিনী দুর্বল হয়ে পড়েছে, এবং সামরিক বাহিনীর সঙ্গেও সরকারের সম্পর্ক এখন টানাপোড়েনের মধ্যে রয়েছে।
অর্থনৈতিক কাঠামো ও নারী অংশগ্রহণ: আশার আলো?

শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মসজিদ নির্মাণের মাধ্যমে ধর্মীয় রক্ষণশীলতা ইতিমধ্যেই বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নারীর উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ—যেখানে শ্রমশক্তির ৩৭% নারী—এটিকে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে তৈরি করতে পারে। নারীর অধিকার হ্রাসের চেষ্টা সামাজিক সংঘাত আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশে নারীদের অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ এতো গভীর যে, রক্ষণশীল শক্তিগুলোর জন্য তাদের সম্পূর্ণরূপে গৃহবন্দি করা কঠিন হবে।
ইসলামপন্থীদের রাজনৈতিক পুনরুত্থান
বর্তমান প্রবণতা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা অপসারণের মাধ্যমে বাংলাদেশ ধর্মীয় রাষ্ট্রের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। জামায়াতে ইসলামীর মতো দলগুলি ইতিমধ্যেই দীর্ঘমেয়াদে ইসলামী রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা করছে। তবে শিক্ষিত তরুণ ও নারী নেতৃত্বের প্রতিরোধ এই প্রবণতা রোধ করার ক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশে ইসলামপন্থী দলগুলোর মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর উত্থান লক্ষণীয়। দলটির নেতারা একটি ‘ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার কথা বলছে, যা তুরস্কের মতো ধর্ম ও রাজনীতির মিশ্রণে পরিচালিত হবে। তবে, জামায়াত আসন্ন নির্বাচনে সরাসরি বিজয়ী হতে পারবে না বলে বিশ্লেষকদের মত। তবে তারা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে, যেখানে মূলধারার ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোর দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে চায়।
তৃণমূল পর্যায়ে ধর্মীয় বিধিনিষেধের বাস্তবায়ন
তারাগঞ্জে একদল আয়োজক স্থানীয় কিশোরীদের মধ্যে ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করেছিল। কিন্তু স্থানীয় মসজিদের ইমাম আশরাফ আলী দাবি করেন, এটি ধর্মবিরোধী এবং বন্ধ করতে হবে। প্রশাসন তার দাবির কাছে নতি স্বীকার করে, এবং ম্যাচটি বাতিল হয়। পরে অবশ্য কড়া নিরাপত্তার মধ্যে আরেকটি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়, তবে খেলোয়াড়দের শরীর সম্পূর্ণ ঢাকা পোশাক পরার বাধ্যবাধকতা ছিল।
এছাড়াও, এই ইমাম আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছেন এবং তাদের উপাসনালয়ে হামলার ঘটনায় ইন্ধন জুগিয়েছেন। প্রশাসন তাদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে, ফলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যরা চরম আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ: ধর্মনিরপেক্ষতা বনাম ধর্মীয় শাসন
বাংলাদেশে ইসলামপন্থী উত্থান শুধুমাত্র দেশীয় নয়, বরং এটি বৃহত্তর আঞ্চলিক প্রবণতার অংশ। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মতো দেশগুলোতে ধর্মীয় চরমপন্থী শক্তিগুলো রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করেছে। ভারতে, একটি শক্তিশালী হিন্দু ডানপন্থী দল দেশটির ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের ঐতিহ্যকে ক্ষুন্ন করেছে। মিয়ানমার বৌদ্ধ উগ্রপন্থীদের দখলে রয়েছে, যারা জাতিগত নির্মূল অভিযানের তত্ত্বাবধান করছে। বাংলাদেশ কি একই পথে এগোবে, নাকি এর ধর্মনিরপেক্ষ ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বজায় রাখবে—এই প্রশ্নের উত্তর এখনো অনিশ্চিত।
নিউইয়র্ক টাইমসের এই প্রতিবেদন থেকে সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায় বাংলাদেশ এখন একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। ধর্মীয় উগ্রবাদ নাকি গণতান্ত্রিক বহুত্ববাদ—এই সংঘাতের ফলাফলই নির্ধারণ করবে দেশের ভবিষ্যত। সরকার ও সুশীল সমাজের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা ছাড়া এই সংকট কাটানো কঠিন হবে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতোই বাংলাদেশও ধর্মীয় উগ্রবাদের একটি নতুন ঢেউয়ের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে, তবে এর সংস্কৃতি ও অর্থনীতির অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলোই হয়তো এখানে ভিন্ন ফলাফল তৈরি করতে পারে।
সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস থেকে