ঠাকুরগাঁও ৩মার্চ: বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের শহর ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার বেগুনবাড়ী ইউনিয়নে “নতুন পাড়া স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা” নামে একটি অস্তিত্বহীন ভুয়া প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এমপিও ভুক্তির পাঁয়তারার অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয়দের দাবি, মাদ্রাসাটি এমপিও ভুক্ত করার জন্য একটি অসাধু চক্র ক্ষমতার অপব্যবহার করে একটি ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে।
এই ঘটনার তদন্ত ও জড়িতদের শাস্তির দাবি জানিয়ে মানববন্ধনসহ জেলা প্রশাসক, জেলা শিক্ষা অফিসার, দুদক কার্যালয় ও শিক্ষা সচিব বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসীরা।
এলাকাবাসীদের অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৩ সালে স্থানীয় আহসানুল্লাহ সহ কয়েকজন ব্যক্তির উদ্যোগে “নতুন পাড়া স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা” প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে আহসানুল্লাহ চাকরি থেকে অব্যাহতি নিলে এর প্রধান শিক্ষক হন একই গ্রামের আবুল বাশার। এরপর প্রতিষ্ঠানটি ১৯৯৯সালে দাখিল পর্যন্ত একাডেমিক স্বীকৃতি লাভ করে। পরবর্তীতে, ২০০২ সালে ইবতেদায়ী ও দাখিল শাখা একত্রিত হয়ে এমপিওভুক্ত হয়। অন্যদিকে আবুল বাসার সহ অন্যরা দাখিল মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করলেও তারা এখনও পূর্বের ইবতেদায়ীর ভাতাভুক্ত থেকে যান।
স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করে বলেন, সম্প্রতি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসাগুলো এমপিও ভুক্ত ঘোষণার সুযোগ নিয়ে একটি অসাধু চক্র একই এলাকায় একই নামে আরেকটি ভুয়া প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। পূর্বের “নতুন পাড়া স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা” দাখিল মাদ্রাসার সাথে একীভূত হওয়ার পরেও, এই চক্রটি জাল কাগজপত্র তৈরি করে প্রায় ৫০০ মিটারের মধ্যে হুবহু একই নামে আরেকটি মাদ্রাসার অস্তিত্ব তৈরি করেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা মোশারফ হোসেন, জহির, ফারুক হোসেন ও রুস্তম আলী জানান, নতুন পাড়া স্বতন্ত্র নামে এই ভুয়া মাদ্রাসার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। সেখানে কোনো শিক্ষার্থী, শিক্ষক বা নির্ধারিত স্থান নেই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নতুনপাড়া গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, নতুনপাড়া দাখিল মাদ্রাসার সুপারিনটেনডেন্ট আব্দুল মতিন মাদ্রাসার জাল কাগজপত্র তৈরি থেকে শুরু করে সব অফিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগসহ সবকিছু করছেন। আর এই ভুয়া প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক দাবি করছেন দাখিল মাদ্রাসার সংলগ্ন বাড়ির বাসিন্দা শাহিনুর আলম। শুধু তাই নয়, এ ভুয়া প্রতিষ্ঠানের রাতারাতি শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে সব দাপ্তরিক কাজে জড়িত এ চক্রটি।

এই জালিয়াতি শুধু বেআইনি নয়, বরং সরকারি সম্পদ ও সুযোগ-সুবিধার চরম অপব্যবহার বলে দাবি স্থানীয়দের। তারা এই বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে তদন্ত করে জালিয়াতি চক্রের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রশাসনের কাছে জোর দাবি জানিয়েছেন।
ঠাকুরগাঁও জেলা শিক্ষা অফিসার শাহীন আকতার বলেন, প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়ে সরেজমিনে পরিদর্শনে গিয়ে দেখলাম শুধু ফসলি মাঠ। নতুন পাড়া স্বতন্ত্র মাদ্রাসা নামে কোন প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক ইশরাত ফারজানা বলেন, প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত চলছে।
উল্লেখ্য যে, স্বাধীনতার পর প্রথমবারের মতো ইবতেদায়ী মাদ্রাসাকে এমপিওভুক্ত করতে যাচ্ছে সরকার। এর আগে কয়েক দফা উদ্যোগ নিলেও শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি। প্রথমবারের মতো নিবন্ধিত ১ হাজার ৫১৯টি ইবতেদায়ী মাদ্রাসা এবং সেখানে কর্মরত শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী মে মাস থেকে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা বেতন-ভাতা পেতে পারেন। এসব শিক্ষকের এমপিও দিতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট থেকে ১৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাবনা প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে পাঠানো হচ্ছে। মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের হিসাবে বর্তমানে দেশে ৬ হাজার ৯৯৭টি (কোডভুক্ত) স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা আছে। এ ছাড়া মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের হিসাবে আরও পাঁচ হাজারের মতো মাদ্রাসা আছে। তার মধ্যে এডুকেশনাল ইনস্টিটিউট আইডেন্টিফিকেশন নম্বর বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শনাক্তকারী নম্বর (ইআইআইএন) আছে ১ হাজার ৫১৯টি মাদ্রাসার। প্রথম ধাপে এসব প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করা হবে। প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের একজন প্রধান ধরে মোট চারজন শিক্ষক এমপিওভুক্ত হবেন। সেই হিসাবে ৬ হাজার ৭৬ জন শিক্ষক এমপিওভুক্ত হতে পারেন। এতে সরকারের খরচ হবে ১৬ কোটি টাকার কিছু বেশি।
সরকারের এই ঘোষণাকে কাজে লাগিয়ে কিছু সুবিধাবাদী গোষ্ঠী মাদ্রাসার নামে ভুয়া প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে রাষ্ট্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে।
এলাকাবাসীর জোরালো দাবি, এই অবৈধ প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমপিওভুক্ত করে সরকারি অর্থের অপচয় বন্ধ করা হোক। বরং প্রকৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকেই সহযোগিতা প্রদান করা উচিত, যাতে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সঠিকভাবে এগিয়ে যেতে পারে।