সিডনি ০৯ এপ্রিল ২০২৫
বিশ্বজুড়ে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির প্রসারে বৈদ্যুতিক যানবাহন EV, (Electric Vehicles) এখন আলোচনার শীর্ষে। “পরিবেশ বাঁচাও”, “দূষণ কমাও” – এই স্লোগানেই বাজার কাঁপাচ্ছে বৈদ্যুতিক গাড়ির নির্মাতারা। কিন্তু এই ‘সবুজ বিপ্লবের’ পেছনে কি লুকিয়ে আছে এক ভয়ঙ্কর সত্য? সম্প্রতি একটি তথ্যচিত্রে উঠে এসেছে বৈদ্যুতিক গাড়ি শিল্পের এক অন্ধকার দিক – যেখানে পরিবেশ রক্ষার নামে পরিবেশই ধ্বংস হচ্ছে, মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, এবং এক বিশাল জনগোষ্ঠী চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখে পড়ছে।
ইন্দোনেশিয়ায় বিশ্বের সর্ববৃহৎ নিকেল রিজার্ভের অবস্থান—৫.২ বিলিয়ন টন আকরিক ও ৫৭ মিলিয়ন টন ধাতব নিকেল, যা বিশ্বব্যাপী রিজার্ভের ৪২ শতাংশ। এই সম্পদকে ঘিরেই ২০১৩ সালে চীনা কোম্পানি Tsingshan Holding Group এবং ইন্দোনেশিয়ার দুটি কোম্পানি মিলে গঠন করে ইন্দোনেশিয়া মোরোয়ালি ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক (IMIP)। এটি এখন দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে বড় নিকেল প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পাঞ্চল।
ইন্দোনেশিয়ার সুলাওয়েসি ও মালুকু প্রদেশে নিকেল খনির কার্যক্রম ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই খনিগুলোর কারণে স্থানীয় জলাধার দূষিত হচ্ছে, মাছের প্রজাতি হ্রাস পাচ্ছে, এবং কৃষিজমি অনুর্বর হয়ে পড়ছে। স্থানীয় বাসিন্দারা স্বাস্থ্যগত সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন, যেমন ত্বকের ফুসকুড়ি ও শ্বাসকষ্ট। বাহোদোপি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের পর থেকে এই অঞ্চলে শ্বাসকষ্টই সবচেয়ে সাধারণ রোগ, প্রায় ৭,০০০ জন আক্রান্ত হয়েছেন।
খনির পাহাড়গুলো এখন আর সবুজ নয়—তাদের রং লালচে–বাদামী, ধুলোমাখা। বর্ষায় সেই মাটি নদী–জমিতে গিয়ে জলাভূমিকে দূষিত করছে। কল–কারখানার ধোঁয়ায় আকাশ ধূসর, প্রতিদিন ছয় ঘণ্টা পরপর চুল্লির ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশে। একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, স্থানীয় জলাধারে নিকেল, সীসা ও ক্যাডমিয়ামের মাত্রা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ।
একসময় যারা ছিলেন জেলে বা কৃষক, তারা আজ খনিশ্রমিক। দূষিত পানি ও নিঃশেষ মাছের জন্য তরুণরা বাধ্য হয়ে খনিতে কাজ নিচ্ছেন। কিন্তু সেই কাজেও নেই কোনো নিরাপত্তা, নেই ন্যায্য মজুরি। শ্রমিকদের তিন মাসের চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়, স্বাস্থ্য সুরক্ষা উপেক্ষিত, কাজের সময় দীর্ঘ, বেতন কম।
চীন এখন ইন্দোনেশিয়ার ৯০% নিকেল খনি ও স্মেল্টার নিয়ন্ত্রণ করে, যার ফলে ইন্দোনেশিয়া কার্যত চীনের ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। গত এক দশকে চীন প্রায় ৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে এ খাতে। EV ব্যাটারি তৈরির মূল উপাদান নিকেল উৎপাদনে এই আধিপত্য চীনের ইভি শিল্পকে বৈশ্বিক শীর্ষে নিয়ে গেছে।
পশ্চিমা দেশগুলো ও বড় বড় কর্পোরেশনগুলো EV বিপ্লবকে উৎসাহিত করছে, কারণ এটি তাদের ‘গ্রিন ট্রানজিশন’ এর অংশ। অথচ তারা এই নির্মম বাস্তবতা দেখেও না দেখার ভান করছে। কারণ এই শিল্পে লাভ আছে, রাজনীতি আছে, এবং আছে ‘সবুজ’ ব্র্যান্ডিং–এর চটক।
“সবুজ” প্রযুক্তির পিছনের রঙ যদি হয় রক্ত ও ধূসর, তাহলে সেই প্রযুক্তি কতটা মানবিক?
অমল দত্ত, সিডনি থেকে
একাউন্টেন্ট প্রফেশনাল এবং কমিউনিটি সংগঠক