মতামত
লেখা অভিমন্যু ফয়েজী, মেলবোর্ন ১১ এপ্রিল- ঘটনা কেমন যেন প্যাঁচ খেয়ে গেলো। বিকেলের দিকে কুমিল্লায় সেটেল্ড নোয়াখালীর এক ভদ্রলোক ফোন করে বললেন, “কাহা, বিষয়টা কেমুন অইলো?” আমি তাঁর কথার আগা মাথা না বুঝেই বললাম, “কিসের কথা বলছেন?” তিনি আরো উত্তেজনার সাথে বললেন, “আপনে অহনো দরতে হারচেননা?” আমি ভাবলাম দেশে নতুন করে কোন ধর্ষনের ঘটনা ঘটেছে, এবং এই ভদ্রলোক এটিকে উপলক্ষ্যে করে মহাজনকে আচ্ছাসে এমনসব অভিধায় অভিষিক্ত করার মানসে আমাকে ফোনটি করেছেন যেসব অভিধা লিখে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আমি একটু এড়াতে চাইলাম; খুবই নিস্পৃহ গলায় বললাম, “কী ব্যপার বলুনতো”। ভদ্রলোক খুবই রেগে গেলেন, এবং আমার পেশা ও সামান্য ফেসবুকীয় লেখালেখির প্রচন্ড সমালোচনা করে বললেন, “আমনেরা আসলে একচক্ষু বিশিষ্ট প্রানী; আমার নেতা এতবড় একখান কাম করলো, আর আমনে তাইন সম্পর্কে ভালা কিছু কইলেননা”। আমি বুঝতে পারলাম, তিনি তারেক রহমান সম্পর্কে বলছেন; কারন, আমি জানি ভদ্রলোক বিএনপি’র একেবারে ডাইহার্ড বলতে যা বোঝায় সেই মাত্রার সমর্থক। কিন্তু তারেক রহমানের “কামডা” ধরতে পারলামনা; নতুন কিছু? অপারগতা জানিয়ে বললাম, ভাই, আমি আজ সারাদিন ব্যস্ত ছিলাম (এটা পুরোই চাপা!); আপনি বলুন একটু কী হয়েছে। ভদ্রলোক এই সুযোগটির অপেক্ষায় ছিলেন। তাঁর বয়ান জানা গেলো।
এত লম্বা শানে নজুলের পর ভদ্রলোক আসল বিষয়টি বললেন। সেটি হলো, তারেক রহমান ক’দিন আগে এক ইফতার মাহফিলে জানিয়েছেন যে, তিনিও নাকি আয়না ঘরে ছিলেন; এই খবরটা দিয়ে তারেক আওয়ামী লীগের জন্য সুবিধা করে দিয়েছেন, এটাই আমার বন্ধু ভদ্রলোকের বক্তব্য; এ কারনেই তিনি এত উত্তেজিত। অতঃপর আমাকে খবরটি দেখতে বলে ফোন রেখে দিলেন।
আমি খবরটি দেখলাম। বাংলা ট্রিবিউন পত্রিকা “অনেকেই আয়নাঘরে অত্যাচারিত হয়েছি: তারেক রহমান” শীর্ষক খবরটিতে তারেক রহমানের বরাত দিয়ে জানাচ্ছে, “বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, এতদিন আপনাদের একটি কথা বলা হয়নি। কয়েক দিন আগে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা আয়নাঘর পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। সেখানে হুম্মাম কাদের চৌধুরীও ছিলেন। পরবর্তীতে আমার সঙ্গে দেখা করে হুম্মাম বলেছিলেন, ভাইয়া আপনাকে যেখানে রাখা হয়েছিল আমিও সেখানে ছিলাম। অর্থাৎ আমরা অনেকেই আয়নাঘর থেকে ঘুরে এসেছি, অনেকেই আয়নাঘরে অত্যাচারিত হয়েছি।” খুবই নির্দোষ একটি মন্তব্য। কিন্তু এটির মধ্যে বেশ কয়েকটি খুব গুরুত্ত্বপূর্ন পয়েন্ট আছে আলোচনার জন্য।
(১) হুম্মাম কাদের চৌধুরী যে আয়নাঘরে ছিলেন তারেক রহমানও সেটিতে ছিলেন। এই আয়নাঘরটিই প্রধান উপদেষ্টা পরিদর্শন করেছেন এবং বিগত আওয়ামী সরকারের আয়নাঘর হিসেবে এটিকে দেখানো হয়েছে। তো এই আয়নাঘরে তারেক রহমানও থাকলেন কিভাবে? তাঁকেতো রাখা হয়েছিলো আওয়ামী লীগ পূর্ববর্তী সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্বাবধায়ক সরকারের সময়। তাহলে এই আয়নাঘরটি কাদের তৈরী? যদি হুম্মাম চোধুরী এবং তারেক রহমানের কথা সহজভাবে সঠিক হয় তবেতো এই আয়নাঘর শেখ হাসিনার তৈরী নয়।
আমি আমার এক অবসরপ্রাপ্ত উচ্চ পদস্থ সামরিক কর্মকর্তা বন্ধুর কাছে বিষয়টি জানতে চাইলাম। সে যা বললো তা হলো, বাংলাদেশের প্রতিটি বাহিনীর ডিটেনশন সেন্টার আছে; পুলিশ, ডিজিএফআই, বিভিন্ন নিরাপত্তা এজেন্সী, এমনকি প্রতিটি থানাতেও আসামীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আলাদা জায়গা আছে। এসব জায়গায় জিজ্ঞাসাবাদের সময় অভিযুক্তের সাথে কোন সময়ই ভালো ব্যবহার করা হয়না। সামরিক/ বেসামরিক সব সরকারের আমলেই এগুলোতে একটু ঝামেলার লোকজনকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, এবং ভবিষ্যতেও হবে। বর্তমানে যে আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের ধরা হয়েছে তাদের অনেককেই রিমান্ড নিয়ে বা না নিয়ে অনৈতিক অত্যাচার নির্যাতন চালানো হচ্ছে যা আইনসম্মত নয়। এটি আওয়ামী লীগ আমলেও হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগকে কিছুতেই ক্ষমতাচ্যুত করতে না পেরে এটি সম্পর্কে বিভিন্ন রকমের কুৎসা রচনা করা হয়, এবং এটির বিচিত্র এক নাম দেয়া হয়, “আয়নাঘর”। এই “আয়নাঘর” আদতে ডিটেনশন সেন্টার; এটি সারা পৃথিবীর সব দেশে বিভিন্ন বাহিনী ও নিরাপত্তা এজেন্সীর কার্যকলাপ চালানোর একটি স্থান।
(২) যে আয়নাঘরটি শেখ হাসিনার আয়নাঘর নামে চালানো হলো সেটি যে তাঁর তৈরী নয় তাতো বোঝা গেলো। এটি সব সরকারের আমলেই ছিলো। বর্তমান সরকারের সময় এটিকে আরো ঝকঝকে তকতকে করে প্রধান উপদেষ্টার পরিদর্শনের জন্য প্রস্তুত করা হয়। মহাজনের সাথে এটির পরিদর্শনে যান একসময় আয়নাঘরে আটক মানুষেরা যাঁদের মধ্যে একজন জনাব হুম্মাম কাদের চোধুরী। ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো, এই আয়নাঘরটির অবস্থান আসলে কোথায় সেটি আমাদের জানানো হয়নি কখনো। কেন? একটি ব্যাখ্যা হলো এই যে, এখন জানা যাচ্ছে, এটিতে এক সময় জনাব তারেক রহমানও আটক ছিলেন। তিনিতো গ্রেফতার হয়ে নিরাপত্তা বাহিনী বা পুলিশের হাতে আটক ছিলেন ১/১১ এর সরকারের আমলে। তাহলে এর মানে কী দাঁড়ালো? এর মানে আবারো দাঁড়ালো এই যে, এগুলো শেখ হাসিনা তৈরী করেননি। আগে থেকেই এগুলো ছিলো।
“আয়নাঘর” নাম দিয়ে একটি “নেগেটিভ ফ্রেমিং” করা হয়েছিলো শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। নেগেটিভ ফ্রেমিং” বিষয়টি নতুন কিছু নয়। মার্কিন মনোবিজ্ঞানী লেজারউড এবং তাঁর সহকর্মীরা এটির ওপর কাজ করেন। তাঁরা দেখান যে, নেগেটিভ ফ্রেমিং এর প্রভাব মানুষের ওপর পজিটিভ ফ্রেমিং এর চেয়ে অনেক বেশী কার্যকরী থাকে।
(৩) “আয়নাঘর” নামের বস্তুটি শেখ হাসিনার সময় তৈরী, এই প্রচারনাটি কেন তবে? আসলে “আয়নাঘর” নাম দিয়ে একটি “নেগেটিভ ফ্রেমিং” করা হয়েছিলো শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। নেগেটিভ ফ্রেমিং” বিষয়টি নতুন কিছু নয়। মার্কিন মনোবিজ্ঞানী লেজারউড এবং তাঁর সহকর্মীরা এটির ওপর কাজ করেন। তাঁরা দেখান যে, নেগেটিভ ফ্রেমিং এর প্রভাব মানুষের ওপর পজিটিভ ফ্রেমিং এর চেয়ে অনেক বেশী কার্যকরী থাকে। তাঁরা কয়েকটি নেগেটিভ ফ্রেমিং নিয়ে কাজ করেন। যেমন নিক্সনের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত “Tricky Dick” নামের নেগেটিভ ফ্রেমিং কেনেডিকে নির্বাচনে সাহায্য করেছিলো; “Death Panels” নামের একই রকমের নেগেটিভ ফ্রেমিং এর কারনে এফোর্ডেবল হেলথ কেয়ার এক্ট অনেকটাই মুখ থুবড়ে পড়ে; ভিয়েতনাম যুদ্ধে কেরীর ভূমিকা নিয়ে “Swiftboating” নামের ফ্রেমিংটির কারনে ২০০৪ সালে জন কেরীর ক্যাম্পেইনটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়; ট্রাম্প তাঁর বিরোধীদের বিভিন্ন রকমের নেগেটিভ ফ্রেমিং করে নিজের পক্ষে তার ফলাফল পেয়েছেন (যেমন, Crooked Hillary, Low Energy Jeb, ইত্যাদি)।
এই একই জিনিস করা হয়েছিলো শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। খুব সম্ভবতঃ “আয়নাঘর” নামটি প্রথম সামনে আসে নেত্র নিউজ এবং ভয়েস অব আমেরিকার খবরে; এরপর আল জাজিরায় প্রচারিত “প্রাইম মিনিস্টার’স্ মেন” নামের প্রামাণ্য চিত্রটিতেও এটি দেখানো হয়। এই মিডিয়া চিত্রগুলোতে সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত আয়নাঘরে লোকজনকে আটক করা এবং নির্যাতন করা নিয়ে বিঙিন্ন তথ্য দেয়া হয়। পরবর্তীকালে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এই “আয়নাঘর” নামের নেগেটিভ ফ্রেমিংটি বিশেষ প্রচার পায়, এবং উল্লেখ্যযোগ্য সংখ্যক মানুষ এটি বিশ্বাস করেন। পাঁচই আগষ্ট বঙ্গভবন অবমাননার পর বলা হয়, সেখানেও আয়নাঘর ছিলো, অথচ খবরটি সর্বৈব মিথ্যে। এটি যে একটি নেগেটিভ ফ্রেমিং ছিলো তার প্রমান পাওয়া যায় বর্তমান সরকারের কয়েকটি আচরনে। এইটি আমাদের চতুর্থ পয়েন্ট।
(৪) মহাজন ক্ষমতায় এসেই বলেন যে, সব আয়নাঘর বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আমরা তখন বলেছিলাম, এই সিদ্ধান্তের পেছনে ষড়যন্ত্র আছে; আসলে আয়নাঘর নামে কোন জিনিস বাস্তবে নেই বা ছিলোনা। যেটি ছিলো সেটি হচ্ছে বিভিন্ন ডিটেনশন সেন্টার। এরপর ছ’মাস পর জানা গেলো যে, প্রধান উপদেষ্টা সবাইকে নিয়ে আয়নাঘর দেখতে যাবেন। তাহলে ব্যপারটি কী দাঁড়ালো? এগুলো প্রথমে বন্ধ করে দিয়ে এখন আবার “একটি” আয়নাঘর পরিদর্শনে যাওয়ার কী কারন? মানুষ কি এটিকে বিশ্বাস করেছে?
(৫) মহাজন এবং তাঁর টিম অতঃপর আয়নাঘরে গেলেন, এবং মর্মস্পর্শী বক্তব্য দিলেন, কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ সেগুলো বিশ্বাস করলোনা। আমরা সেসময় এ সম্পর্কিত খবরের ওপর সামাজিক মাধ্যমে মানুষের মতামত বিশ্লেষন করেছিলাম; মোটা দাগে মানুষের মতামত ছিলো এই যে, এই আয়নাঘর নতুন করে বানানো হয়েছে; তাঁদের একটি মৌলিক প্রশ্ন ছিলো এই যে, ঘরটি এত ঝকঝকে তকতকে নতুনের মত কেন? এরপর প্রেস সচিব বললেন, সারা দেশে সাত/ আটশো আয়নাঘর আছে। তো সেগুলো কোথায়? তাঁরা একটিও আয়নাঘরের ঠিকানা বা লোকেশন বললেননা। কেন?
আমাদের মনে হয়েছে, তাঁদের কাছে এগুলোর খবর থাকলে শেখ হাসিনার প্রতি প্রেস সচিব বা প্রধান উপদেষ্টাসহ অন্য কুশীলবদের যে ক্ষোভ তাতে সেগুলো প্রকাশ করে গলার রগ ফুলিয়ে শেখ হাসিনা যে কত খারাপ ছিলেন সেটি বলার কথা। কিন্তু তাঁরা সেটি করেননি; কেন? কারন আলাদাভাবে শেখ হাসিনা কোন আয়নাঘর নির্মান করেননি। তাঁর এটি করার কোন কারন ছিলোনা। যেখানে ডিটেনশন সেন্টারগুলো ছিলো সেগুলো দিয়েই তিনি তাঁর কাজ চালাতে পারতেন।
নেগেটিভ ফ্রেমিং চলেছে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পরও। এর একটি উদাহরন হলো, শেখ হাসিনার নাম দিয়ে একটি ভিডিও প্রচার যেখানে শোনা গেলো, তিনি আয়নাঘর প্রতিষ্ঠার ধারনা এবং এটির প্রয়োগ নিয়ে স্বীকারোক্তি দিচ্ছেন। বেশ কয়েকদিন উত্তেজনার পর রিউমার স্ক্যানারের মাধ্যমে জানা গেলো, ওই ভিডিওটি ভুয়া।
(৬) আমরা দেখেছি, আয়নাঘর নামের প্রত্যয়টি দিয়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে নেগেটিভ ফ্রেমিং চলেছে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পরও। এর একটি উদাহরন হলো, শেখ হাসিনার নাম দিয়ে একটি ভিডিও প্রচার যেখানে শোনা গেলো, তিনি আয়নাঘর প্রতিষ্ঠার ধারনা এবং এটির প্রয়োগ নিয়ে স্বীকারোক্তি দিচ্ছেন। বেশ কয়েকদিন উত্তেজনার পর রিউমার স্ক্যানারের মাধ্যমে জানা গেলো, ওই ভিডিওটি ভুয়া। তার মানে নেগেটিভ ফ্রেমিং এর সকল চেষ্টাই চলেছে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে।
(৭) এবার আমাদের আলোচনার সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ন অংশে আসা যাক। আমরা এখানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সরকারের তুলনা করবো। উপাত্তের অভাবজনিত কারনে আমরা পরিসংখ্যানের ফোরকাষ্টিং মডেল ব্যবহার করে দেখতে চাইবো বিএনপি যদি চৌদ্দ বছর শাসন করতো (২০০১–২০১৪) তবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড ও গুম মিলিয়ে অবস্থাটা কী হতে পারতো।
আজকের লেখায় আমাদের উদ্দেশ্যটি ব্যাখ্যা করা যাক। সবসময়ই আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড এবং গুম নিয়ে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন বক্তব্য দেয়া হয়। বিএনপি’ও উঁচু গলায় এসব নিয়ে আওয়ামী লীগের মুন্ডুপাত করে। এ কারনে আমরা পরিসংখ্যানের সাহায্য নিয়ে দেখতে চেয়েছি আসল চিত্রটি কী হতে পারতো যদি বিএনপি’ও চৌদ্দ বছর শাসন করতো। এখানে উল্লেখ্য যে, আমরা কোন অবস্থাতেই কোন রকমের গুম বা বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের পক্ষে নই। কিন্তু এসব বিষয়ে আমরা বাংলাদেশের সরকারগুলোর আনুপাতিক পারফর্মেন্স বিবেচনা করতে আগ্রহী এ কারনে যে, এতে করে সব পক্ষ যেন নিজের দিকেও তাকায়; বাঙ্গালী জাতির মধ্যে আত্মসমলোচনা নামের জিনিসটি নেই। তাই আমাদের আজকের এই অংশের আলোচনা অন্তত বিশ বছর আগে শেষ হওয়া বিএনপি আমলের একটি খন্ডিত চিত্র বিগত আওয়ামী লীগে সরকারের নিরিখে উপস্থাপন করবে; আমাদের উদ্দেশ্য হলো, আওয়ামী লীগের বিরদ্ধে আয়নাঘরসহ অন্যান্য যেসব নেগেটিভ ফ্রেমিং আছে সেগুলো এক তরফা কিনা সেটা পরখ করা।
বাংলাদেশের গোয়েবলসীয় প্রেস সচিব শফিকুল আলমের কাছ থেকে জানা যায় যে, সারা দেশে সর্বমোট সাত থেকে আটশ আয়নাঘর আছে। তো এই তথ্যটি সঠিক হলে প্রতিটি আয়নাঘরে গড়ে একজন মানুষ খুন হলে অন্ততঃ সাত থেকে আটশো মানুষ খুন হওয়ার কথা। গুম কমিশনের তথ্য মতে, তাঁরা মোট ৭৫৮টি গুমের ঘটনা যাচাই করতে পেরেছেন। আমরা আমাদের বিল্লেষনে এই সংখ্যাটিকে সত্যি ধরে নিয়েই বিবেচনা করবো, কিন্তু আমাদের দুটো তাৎপর্যপূর্ণ পর্যবেক্ষন এই সুযোগে জানিয়ে রাখতে চাই।
আয়নাঘরে যাঁরা ছিলেন তাঁদের মধ্যে জনসমক্ষে আমরা মাত্র পাঁচ বা সাতজন মানুষের খবর জেনেছি। এঁদের মধ্যে আছেন, আট বছর ধরে চোখের জলে ভেজা চকচকে গামছার মালিক ব্রিগেডিয়ার আজমী, মাইকেল চাকমা, হুম্মাম চোধুরী প্রমুখ।
প্রথমতঃ আয়নাঘরে যাঁরা ছিলেন তাঁদের মধ্যে জনসমক্ষে আমরা মাত্র পাঁচ বা সাতজন মানুষের খবর জেনেছি। এঁদের মধ্যে আছেন, আট বছর ধরে চোখের জলে ভেজা চকচকে গামছার মালিক ব্রিগেডিয়ার আজমী, মাইকেল চাকমা, হুম্মাম চোধুরী প্রমুখ। আন্দোলনের শেষের দিকে ছিলেন নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ, সার্জিস আলমসহ আরো কয়েকজন। মিডিয়াতে মোটামুটি পাঁচ থেকে বিশ জনের স্পেসিফিক তথ্য পাওয়া যায়। আমরা দুটো দাবী জানিয়ে আসছি প্রথম থেকেইঃ (১) আয়নাঘরে বন্দী ও গুম হওয়া মানুষদের বিস্তারিত তালিকা দেয়া হোক; এবং (২) আয়নাঘরগুলোর ঠিকানাসহ তালিকা দেয়া হোক। বলা বাহুল্য যে এ দুটো দাবীর কোনটিই এখন পর্যন্ত পূরন করা হয়নি। যে একটি আয়নাঘর “পরিদর্শন” করা হয়েছে সেটির বিষয়েও বিস্তারিত তথ্য আমরা পাইনি; প্রেস সচিব জানিয়েছেন, কিছু রঙের কাজ করা হয়েছে। এ পর্যন্তই; আর কোন খবর নেই।
দ্বিতীয়তঃ গুমের ক্ষেত্রে কমিশন জানায়, তাঁরা মোট ১,৬৭৬টি অভিযোগ পেয়েছেন। এর মধ্যে তাঁরা ৭৫৮টি অভিযোগ যাচাই করতে পেরেছেন। যদি এই ৭৫৮টি গুমের ঘটনা পনের বছরে ঘটেছে বলে ধরে নেয়া হয় তবে গড়ে আয়নাঘর প্রতি একটিরও কম সংখ্যক গুমের ঘটনা ঘটেছে পনেরো বছরে যদি দেশে আটশত আয়নাঘর থেকে থাকে।
এরপর আমরা দুই সরকারের (আওয়ামী লীগ এ বিএনপি) গুমের তুলনা করতে যেয়ে দেখতে পাই যে, ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত গুমের ঘটনা ডকুমেন্টেড করা হয়নি নানান কারনে। আবার ২০০৪–০৬ এ সংঘটিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের একটি পরিসংখ্যান আমরা পাই “অধিকার” নামের মানবাধিকার সংস্থাটির কল্যানে (বারী, ২০২২)। অধিকার দাবী করে যে, ২০০৪–০৬ এ মোট ৯৯১ জনকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়। অন্যদিকে আমাদের জানা আছে যে, ২০০১–০৩ পর্যন্ত অপারেশান ক্লিন হার্টের মাধ্যমে বেশ বড় সংখ্যক বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছিলো। পুরো অবস্থাটি বিবেচনা করে আমরা সিদ্ধান্ত নেই যে, উভয় আমলের (আওয়ামী লীগ ও বিএনপি) গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড আমরা তুলনা করবো পরিসংখ্যানের ফোরকাষ্টিং মডেল ব্যবহার করে। এর আরেকটি কারন হলো এই যে, বিভিন্ন মানবাধিকার রিপোর্টে দেখা যায়, গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মধ্যে পজিটিভ সহসম্পর্ক বা কো– রিলেশন আছে। তো এটি করার জন্য এবং বিশ্লেষনে সর্বোচ্চ অপক্ষপাত নিশ্চিত করার প্রয়োজনে আমরা আওয়ামী লীগের চৌদ্দ বছর (২০০৯–২০২৩) শাসনের বিপরীতে বিএনপি’র চৌদ্দ বছরের (২০০১–২০১৪) পরিস্থিতি মূল্যায়ন করি ফোরকাষ্টিং মডেলের মাধ্যমে।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড, রাজনৈতিক নিপীড়ন, এবং বেআইনী গ্রেফতারের ভিত্তিতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্সের সহায়তায় আমরা ২০০১–২০১৪ সময়কালে গুমের নিম্ন ও উচচসীমা নিরূপন করি পরিসংখ্যানের ফোরকাষ্টিং কৌশল অবলম্বন করে; এগুলো অনুমান (Estimate) মাত্র।
বিএনপি’র শাসনামলের পরবর্তী সময়ে (২০০৭–২০০৮) সংঘটিত বেশ কিছু ঘটনা বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা কর্তৃক প্রদত্ত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। এগুলোর ভিত্তিতে চ্যাট জিপিটি ২০০১ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের আনুমানিক সংখ্যাগুলো বের করে। মনে রাখতে হবে, এগুলো প্রকৃত সংখ্যা নয়, কারন বিএনপি’র শাসন ২০০৬ সালে শেষ হয়ে গিয়েছিল। বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড, রাজনৈতিক নিপীড়ন, এবং বেআইনী গ্রেফতারের ভিত্তিতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্সের সহায়তায় আমরা ২০০১–২০১৪ সময়কালে গুমের নিম্ন ও উচচসীমা নিরূপন করি পরিসংখ্যানের ফোরকাষ্টিং কৌশল অবলম্বন করে; এগুলো অনুমান (Estimate) মাত্র। অন্যদিকে “অধিকার” নামের মানবাধিকার সংস্থাটির মতে, ২০০৪–০৬ সালে ৯৯১ জন বিচার–বহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হন। এই সংখ্যাটির ভিত্তিতে চ্যাট জিপিটি ২০০১–০৬ এবং ২০০১–১৪ (বিএনপি’র অনুমিত শাসনামল) এ সংঘটিত গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের আনুমানিক সংখ্যা বের করে। আপনারা আমাদের বিশ্লেষনের বৈধতা বুঝতে চাইলে নিজেরাই চ্যাট জিপিটি ব্যবহার করে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।
এবার আমাদের বিশ্লেষনটি দেয়া যাক। গুম কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত মোট ৭৫৮টি গুমের ঘটনা তাঁরা যাচাই করেছেন। এগুলোর মধ্যে ২০১৪ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশী এমন ঘটনা ঘটে (দেখুন বনিক বার্তা, ২০২৪); এখানে আমরা শুধু ওই সময়কালটি পাঠকদের মনে করিয়ে দিতে চাই। প্রথমটি হলো, ২০১৪ সালের নির্বাচন ঠেকানোর নামে আগুন সন্ত্রাস শুরু হয়; অন্যদিকে ২০১৫–১৬ সালে ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের তান্ডব শুরু হয়। এই দুই পরিস্থিতির সাথে গুমের সংখ্যা বাড়ার সম্পর্ক থাকলেও থাকতে পারে।
সবদিক থেকেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডে বিএনপি আওয়ামী লীগের চেয়ে অনেক বেশী অগ্রগামী। অন্যদিকে গুমের ক্ষেত্রে সবদিক থেকেই আওয়ামী লীগের সময় এটি বেশী ঘটেছে বলে ধরে নেয়া যায়। ফোরকাষ্টিং এ ২০০১ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত উচ্চ সীমার হিসেবেও বিএনপি’র সময় ৩২১ টি গুমের ঘটনা ঘটতো যদি তারা ওই সময় ক্ষমতায় থাকতো; আওয়ামী লীগের চৌদ্দ বছরে ৭৫৮টি গুমের ঘটনা গুম কমিশন যাচাই করতে পেরেছিলো। (পুরো বিশ্লেষনটির ভিজুয়ালাইজেশন লেখচিত্র ১ এ তুলে ধরা হিয়েছে)।
এবার মূল তুলনাটিতে আসা যাক। আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের ক্ষেত্রে একই সময়ের (চৌদ্দ বছর শাসন পরিসর) হিসেবে বিএনপি’র আমলে অনেক বেশী এ জাতীয় কর্মকান্ড ঘটার ইঙ্গিত পাওয়া যায়; বিএনপি’র সর্বনিম্ন অনুমান ৫১৭৮টির বিপরীতে আওয়ামী লীগের ২৬৯৯ টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড ঘটেছিলো; অন্যদিকে উচ্চতর সীমায় বিএনপি’র আনুমানিক শাসনকালীন সময়ে (চৌদ্দ বছর) এমন ঘটনা ঘটার কথা ৬১৩৪টি যেটি আরো উচ্চতর সীমায় ৭৭২৭টি বলে ফোরকাস্টিং পাওয়া যায়। সবদিক থেকেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডে বিএনপি আওয়ামী লীগের চেয়ে অনেক বেশী অগ্রগামী। অন্যদিকে গুমের ক্ষেত্রে সবদিক থেকেই আওয়ামী লীগের সময় এটি বেশী ঘটেছে বলে ধরে নেয়া যায়। ফোরকাষ্টিং এ ২০০১ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত উচ্চ সীমার হিসেবেও বিএনপি’র সময় ৩২১ টি গুমের ঘটনা ঘটতো যদি তারা ওই সময় ক্ষমতায় থাকতো; আওয়ামী লীগের চৌদ্দ বছরে ৭৫৮টি গুমের ঘটনা গুম কমিশন যাচাই করতে পেরেছিলো। (পুরো বিশ্লেষনটির ভিজুয়ালাইজেশন লেখচিত্র ১ এ তুলে ধরা হিয়েছে)।
এ পর্যন্তই আমাদের আজকের আলোচনা। আমরা এখানে দেখাতে চেয়েছি এই যে, আওয়ামী লীগের ওপর আয়নাঘর নির্মানের যে দায়টি চাপানো হয় সেটি সঠিক নয়। এ আয়নাঘরগুলো আসলে বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থার ডিটেনশন সেন্টার মাত্র। দ্বিতীয়তঃ আওয়ামী লীগের ওপর ঢালাওভাবে গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের যে দায়টি এককভাবে চাপানো হয় সেটিও সঠিক নয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে সকল শাসক দলের ওপরই এটি বর্তায়।

লেখক, অভিমন্যু ফয়েজী, ভার্জিনিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
উল্লিখিত মতামত লেখকের নিজস্ব, এবং প্রতিষ্ঠানের অবস্থান বা দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত করে না।
।