মেলবোর্ন ১৪ এপ্রিল ২০২৫– আজ ১৪ এপ্রিল, পহেলা বৈশাখ—বাঙালির প্রাণের উৎসব, নবজাগরণের দিন। বাংলা নববর্ষ কেবল নতুন ক্যালেন্ডারের সূচনা নয়, এটি এক আত্মিক শুদ্ধি ও সাংস্কৃতিক চেতনার পুনর্জাগরণ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন বলেছিলেন—“মুছে যাক গ্লানি, মুছে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা”—এই পঙক্তি যেন আজকের বৈশাখী ভোরে আরও গভীর তাৎপর্য ধারণ করে। বৈশাখ আসে অশুভকে পেছনে ফেলে শুভকে বরণ করতে, আমাদের ভেতরে-বাইরের আবর্জনাকে ধুয়ে মুছে নতুন করে গড়ার প্রেরণা নিয়ে।
তবে এ বছরের নববর্ষ এসেছে এক ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। বিশ্বে যুদ্ধ, জলবায়ু সংকট, অর্থনৈতিক মন্দা ও সামাজিক অস্থিরতা বিরাজমান। আমাদের দেশও ব্যতিক্রম নয়। দীর্ঘদিনের অর্জিত অর্থনৈতিক সাফল্য আজ ভঙ্গুর। মানুষ বেকার, শিল্পকারখানা বন্ধ, বাজারে নেই সেই চিরচেনা বৈশাখী ভিড়। গত বছরের তুলনায় ঈদ কেনাকাটায় ৩০ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি, দুরাবস্থারই প্রতিচ্ছবি।
বাংলাদেশ একসময় দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় সেরা অর্থনীতির দেশ ছিল। মানুষের হাতে ছিল কাজ, আয়, ব্যয়। দুর্নীতি সত্ত্বেও অর্থনীতি প্রবাহমান ছিল। অথচ আজ অর্থনৈতিক সংকোচনের মুখে পড়ে মানুষ ঈদে গ্রামে যেতে পারছে না, বৈশাখের পোশাক কিনতে পারছে না। চাহিদার হ্রাস আর বাজারের নিস্তব্ধতা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য বড় সতর্কবার্তা। জাতীয় মাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী এবার রোজার ঈদের আগে ঢাকা ছেড়েছেন প্রায় ৪১ লক্ষ মানুষ। অথচ ২০২৩ সালের রোজার ঈদের আগে ঢাকা ছেড়েছিল প্রায় ৮৬ লক্ষ মানুষ। যেখানে অর্থনৈতিকভাবে মানুষ বিপর্যস্ত, নিরাপত্তাহীনতায় আতংকিত, সেখানে তারা গ্রামের বাড়িতে যায়নি এটাই স্বাভাবিক।
নববর্ষ মানেই উদযাপন, একত্রতা, সম্প্রীতির মিলনমেলা। কিন্তু সম্প্রীতির এই উৎসবেও বিভাজনের রাজনীতি ঢুকে পড়েছে। মঙ্গল শোভাযাত্রার মতো একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের নাম পরিবর্তনের মাধ্যমে এর মূল্যবোধকে খর্ব করা হচ্ছে। এই শোভাযাত্রা কেবল ঢাকঢোলের বর্ণাঢ্য বহর নয়, এটি এক সময় স্বৈরাচার ও অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে বাঙালির প্রতিরোধের প্রতীক ছিল। জাতিসংঘের ইউনেসকো ২০১৬ সালে একে বিশ্ব ঐতিহ্যের মর্যাদা দিয়েছিল—এটি আমাদের জন্য গর্ব, অহংকারের বিষয়। সেই ঐতিহ্যকেই আজ প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা চলছে।
নববর্ষের এই দিনে আমাদের আত্মসমালোচনার সময় এসেছে—আমরা কোন পথে হাঁটছি? কেন আমাদের সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও সমাজের ভীত এতটা নড়বড়ে হয়ে পড়েছে? পহেলা বৈশাখে আমরা নতুন পোশাক পরি, কিন্তু নিজেদের ভেতরের পোশাক কি আমরা পাল্টাতে পেরেছি? দুর্নীতি, বৈষম্য, অসহিষ্ণুতা আর দায়িত্বহীনতার আবরণ কি আমরা ঝেড়ে ফেলতে পেরেছি?
আজ এই শুভ দিনে আমাদের অঙ্গীকার হোক—জাতি হিসেবে আমরা যেন পুনরায় জেগে উঠি, যেন নতুন প্রভাতের আলোয় আমরা আলোকিত হই ভ্রাতৃত্ববোধ, সাম্য ও মানবিকতায়। কবি নজরুল যেমন বলেছিলেন—“তোরা সব জয়ধ্বনি কর! ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবৈশাখীর ঝড়!”—সেই ঝড়ে ধুয়ে যাক সব অমঙ্গল, জেগে উঠুক মঙ্গল, আলো, মানবতা।
আসুন, আজকের নববর্ষ হোক নতুন আশা, নতুন প্রতিজ্ঞা, আর নতুন বাংলাদেশের প্রথম সূর্যোদয়।
OTN বাংলা পরিবারের পক্ষ থেকে সকল পাঠক, দর্শক ও শুভানুধ্যায়ীদের জানাই বাংলা নববর্ষের আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। শুভ নববর্ষ ১৪৩২।
প্রদীপ রায়, সম্পাদক, ওটিএন বাংলা