জাতীয় মাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী এবার রোজার ঈদের আগে ঢাকা ছেড়েছেন প্রায় ৪১ লক্ষ মানুষ। অথচ ২০২৩ সালের রোজার ঈদের আগে ঢাকা ছেড়েছিল প্রায় ৮৬ লক্ষ মানুষ। ছবি: সংগৃহীত PD
১৪ এপ্রিল ২০২৫ – কেউ ভাল কাজ করলে আমি তার প্রশংসা করার চেষ্টা করি। এমনকি ভাল কাজ করার চেষ্টা করলেও তার প্রশংসা করি। ভাল কাজ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেও তার চেষ্টার প্রশংসা করি এবং সামনে এগিয়ে যাবার উৎসাহ দিই। কিন্তু কেউ যদি ভাল কিছু না করে মিথ্যা তথ্য দিয়ে নানা কারণে ঘটে যাওয়া কোন একটা ঘটনায় কৃতিত্ব নেবার চেষ্টা করে, সেটির ভুল ভাঙানোও দায়িত্ব বলে মনে করি।
সম্প্রতি ২০২৫ সালের রোজার ঈদে ইউনুস, ডার্টি মাস্টারমাইন্ডস এবং পঞ্চতান্ডবদের পক্ষ থেকে একটি গুজব ছড়ানোর চেষ্টা করা হয় যে এবার ঈদে মানুষ ঢাকার বাইরে দেশে যেতে কোন ভোগান্তির শিকার হচ্ছে না, রাস্তাঘাট খালি, কোথাও কোন যানজট নাই। এবং এ সবই ইউনুস সাহেবের ক্ষুদ্রঋণ ও সেটির বাংলাদেশে যে প্রসার, সেই সোয়াবে ফেরেশতারাই সম্ভবত করে দিয়েছেন। যেহেতু বাংলাদেশে সেনা সংখ্যা বাড়েনি, পুলিশের সংখ্যা কমেছে, এবং নিম্ন পর্যায়ে অর্থাৎ যারা ট্রাফিক কন্ট্রোল করছে তাদের অধিকাংশ নতুন এবং অত্যন্ত অদক্ষ কারণ তারা ৫ অগাস্টের পর বিএনপি জামাতের ক্যাডার থেকে তড়িঘড়ি করে এই চাকরিতে ঢুকেছে, তাই এ দাবী অমূলক এবং জাতিকে প্রতারিত করার শামিল।
তবে মহাসড়ক যে আগের বছরগুলোর চাইতে কিছুটা ফাঁকা ছিল, এবং সেই কারণে মানুষ কিছু ক্ষেত্রে কম ভোগান্তিতে গ্রামের বাড়ি যেতে পেরেছে এটি সত্য। কিন্তু এই স্বস্তি জনমনে ইউনুস ও পঞ্চতান্ডবদের পোষা বিএনপি-জামাতের ক্যাডার পুলিশ অথবা সেনাবাহিনীর সৈনিকরা এনে দিয়েছে এটি বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই অসত্য। কেন এবার মানুষের ভোগান্তি খানিকটা কম হয়েছে চলুন তার আসল কারণগুলো জেনে নেইঃ
পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী এবার অর্থাৎ ২০২৫ সালের রোজার ঈদের আগের দুই-তিন দিনে ঢাকা ছেড়েছেন প্রায় ৪১ লক্ষ মানুষ। অন্যদিকে ২০২৩ সালের রোজার ঈদে র আগের ৪ দিনে ঢাকা ছেড়েছিল প্রায় ৮৬ লক্ষ মানুষ। অর্থাৎ এ বছরের দ্বিগুনেরও বেশী।
১) বাংলাদেশে ঈদে র সময় প্রতিবছর যে পরিমাণ মানুষ গ্রামের বাড়িতে ঈদ করতে যায়, এবার সে সংখ্যাটি ছিল বিস্ময়করভাবে কম। অনির্বাচিত সরকার নানা মিথ্যা তথ্য দেবার চেষ্টা করলেও মোবাইল কোম্পানীগুলো ঈদের সময় তাদের সিম ব্যবহারকারীরা কতজন ঢাকা ছাড়েন সেই তথ্যটি গত অন্তত ৫ বছর ধরে প্রকাশ করে আসছেন। ৫ বছর নিশ্চিতভাবে বলছি কারণ গত ৫ বছরের তথ্য আমি সংগ্রহ করেছি, আমার কাছে আছে। এই কারণেই এই লেখাটি প্রকাশ করতে ঈদের পর প্রায় ২ সপ্তাহ লেগে গেল যেহেতু আমি তথ্য উপাত্ত ছাড়া লিখি না। অনেকে বলতে পারেন দেশের সব মানুষ সিম ব্যবহার করে না – এটি মিথ্যা। ঈদে যারা গ্রামের বাড়ি যায় তাদের ৯৯.৯৯ শতাংশ মানুষ সিম ব্যবহার করে। তবে হ্যা, অনেকে একাধিক সিম ব্যবহার করে, তাই যত মানুষ ঢাকা ছাড়ছে বলে মনে হয়, হয়ত তার চাইতে কম মানুষ ঢাকা ছাড়ে, কিন্তু সেটি সব বছরই একই হারে কমে বাড়ে। আবার যেহেতু অনেক শিশু সিম ব্যবহার করে না, তাই প্রতিবারের প্রতি সদস্য প্রতি গড়ে ১টি সিম ব্যবহৃত হয়।
পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী এবার অর্থাৎ ২০২৫ সালের রোজার ঈদে র আগের দুই-তিন দিনে ঢাকা ছেড়েছেন প্রায় ৪১ লক্ষ মানুষ। অন্যদিকে ২০২৩ সালের রোজার ঈদে র আগের ৪ দিনে ঢাকা ছেড়েছিল প্রায় ৮৬ লক্ষ মানুষ। অর্থাৎ এ বছরের দ্বিগুনেরও বেশী। এখন ঈদে সবচেয়ে বেশী মানুষ বাড়িতে যায় শেষের ২-৩ দিনেই। ৪-৫ দিন ধরে যাওয়া মানুষের সংখ্যা শেষ ২-৩ দিনের চাইতে খুব যে বেশী তা নয়। সেই হিসেবে ধরে নিই আমরা যদি এবছরের তালিকায় শেষ ৪-৫ দিনের হিসাব নিতাম সেটি বড় জোর বেড়ে ৪১ লক্ষ থেকে ৫০-৫৫ লক্ষ হতো। তবুও সেখানে একটা ফাঁক আছে।
ঢাকায় প্রতিবছর নতুন কত মানুষ আসে যারা টাকা জমিয়ে ঈদে বাড়ি যায়? বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. শহীদুল আমিনের মতে এই সংখ্যাটি ৬ লক্ষাধিক। এদের প্রায় সবাই গরীব। এদের একটা বড় অংশ যারা অতিদরিদ্র তাদের মাসিক আয় ৭ হাজার টাকার নিচে। তারা কেবল রোজার ঈদের সময়ই দেশে যায় প্রিয়জনদের সাথে দেখা করতে। ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী যদি ২০২৩ সালে ৮৬ লক্ষ মানুষ ঢাকা ছাড়ে, ২০২৫ সালে ছাড়ার কথা ৯২ লক্ষ। সেটি না হয়ে, আমরা যদি ঈদের আগের ৪-৫ দিনের হিসেবও ২০২৩ সালের পরিসংখ্যানের সাথে তুলনামূলক করার জন্য, তাহলেও দেখা যাবে প্রত্যাশিত ৯২ লক্ষের জায়গায় মাত্র ৫০-৫৫ লক্ষ মানুষ ঢাকা ছেড়েছে। অর্থাৎ প্রায় ৪০-৪২ লক্ষ মানুষ যারা ঢাকা ছাড়ার কথা তারা ঢাকা ছাড়েনি।
২) কেন এত বিপুল সংখ্যক মানুষ ঢাকা ছেড়ে ঈদে গ্রামের বাড়িতে গেল না? প্রথম কারণই নিরাপত্তার অভাব। ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট সরকার পরিবর্তনের পর থেকে বাংলাদেশ যতটা অনিরাপদ হয়েছে, ততটা অনিরাপদ এ দেশ স্বাধীনতার পর আর কখনই ছিল না। বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনও ২০২৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারির মতো একদিনে সারাদেশব্যাপী ১০০০ হাজার জনের বেশী রাজনৈতিক নেতার বাসভবন ভেঙে আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়নি। ২০২৪ সালের ৫ অগাস্টের মতো একদিনে এত বিপুল সংখ্যক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গুঁড়িয়ে দেয়া হয়নি। ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট থেকে ১৫ অগাস্ট ১০ দিনে এত হাজার হাজার সরকারী কর্মচারী ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়নি। কেবল তাই নয় ইউনুস সরকার সেই সব হত্যাকারীকে ইনডেমনিটি দিয়েছে যা ২০২৪ সালের বিশ্বে বিরল এবং অভাবনীয়। বাংলাদেশে গত ৮ মাসে নিরাপত্তা ব্যবস্থা যেভাবে ভেঙে ফেলা হয়েছে এবং উগ্র মৌলবাদীদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে এমনটি আফ্রিকার কিছু গৃহযুদ্ধ চলা দেশেই কেবল দেখা যায়। এমনকি পাকিস্তান কিংবা আফগানিস্তনের মতো দেশেও নিরাপত্তা ব্যবস্থা এর চাইতে ভাল। আগের সরকারের সাথে সম্পর্ক ছিল এই অজুহাত দিয়ে দেশে যে কাউকে হত্যা-গুম-খুন ও ধর্ষণ করলে সেটির বিরুদ্ধে আইনগত কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় না। সন্ধ্যা বেলায় নারীরা ঘর থেকে বের হতে নিরাপদ বোধ করেন না, রাত হলে পুরুষেরা। এমন যখন অবস্থা, গলি-অলিতে ডাকাত ছিনতাইকারী, তখন লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের ঘর-বাড়ি ছেড়ে ঈদে দেশের বাড়িতে যাননি – এটিই প্রত্যাশিত, এবং মূলত এই কারণে এবার ঈদে র সময় মহাসড়কে জ্যাম কিছুটা কম ছিল। এখানে ফকির ইউনুস ও পঞ্চতান্ডবদের কোন কৃতিত্ব নেই।
দেশের মানুষের অর্থনৈতিক দুরাবস্থার সবচেয়ে বড় তথ্য হচ্ছে গত বছরের ঈদে র তুলনায় এই ঈদে বেচাবিক্রি কমেছে ৩০ হাজার কোটি টাকা।
দেশের মানুষের অর্থনৈতিক দুরাবস্থার সবচেয়ে বড় তথ্য হচ্ছে গত বছরের ঈদে র তুলনায় এই ঈদে বেচাবিক্রি কমেছে ৩০ হাজার কোটি টাকা।
৩) দ্বিতীয় কারণ অর্থনৈতিক দুরাবস্থা। বাংলাদেশ গত ১৫ বছরে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় সেরা অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছিল, ঠিক ভারতের পরের স্থানেই। মানুষের হাতে টাকা ছিল, তারা কাজ করেছে, আয় করেছে, সে টাকা খরচ করেছে। দুর্নীতি হয়েছে, সেই দুর্নীতির টাকাও অর্থনীতির trickle down theory মেনে গরীব মানুষের কাছে গিয়েছে। মানুষ যে ঈদে কেবল গ্রামের বাড়িতেই গিয়েছে তাই নয়, বিদেশে গিয়েছে দেদারসে। ৫ অগাস্ট ২০২৪ সালের পর দেশের অর্থনীতি প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত, হাজার হাজার কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, লক্ষ লক্ষ মানুষ বেকার হয়ে গিয়েছে, টাকার অভাবে মানুষের দিনের খরচ চালানোই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে, সেখানে গ্রামের বাড়িতে যাবার বিলাসিতা তারা করতে পারছে না। দেশের মানুষের অর্থনৈতিক দুরাবস্থার সবচেয়ে বড় তথ্য হচ্ছে গত বছরের ঈদে র তুলনায় এই ঈদে বেচাবিক্রি কমেছে ৩০ হাজার কোটি টাকা। সংখ্যাটা আবার পড়েন। ৩০ হাজার কোটি টাকা। মানুষ কী পরিমাণ অর্থনৈতিক অনিরাপত্তায় ভুগলে বাজারে কেনাকাটার পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি টাকা কমে?
৪) অথচ মার্চ মাসের প্রথম ২৬ দিনে দেশে রেমিটেন্স এসেছে গত বছরের তুলনায় ৮২ শতাংশ বা প্রায় ২.৯৪ বিলিয়ন ডলার বেশী। এত বিপুল পরিমাণ রেমিটেন্স আসার পরেও কেন ঈদে র বাজারে কেনাকাটা ৩০ হাজার কোটি টাকা কম? কারণ,
ক) এই টাকার একটি বড় অংশ আসে নির্দিষ্ট একটি গোষ্ঠীর কাছে। তাদের ব্যয়ের খাত সুনির্দিষ্ট।
খ) এই গোষ্ঠীটি গত ৮ মাসের আর্থিক অব্যবস্থাপনা, নানা প্রান্তিক মানুষের ভাতা বন্ধ হয়ে যাওয়া, বিএনপি-জামায়েত-পঞ্চতান্ডবদের চাঁদাবাজির কারণে ঋণে জর্জরিত ছিল, তাই এই টাকার একটি বড় অংশ তারা ব্যয় করেছে ঋণ পরিশোধ করতে।
গ) যেহেতু তারা জানে ইউনুস ও পঞ্চতান্ডব দেশকে ধ্বংস করে দেবে, তাই টাকা খরচ করার পরিবর্তে সঞ্চয়ে প্রাধান্য দিচ্ছে মানুষ।
ঘ) এই রেমিটেন্স পাওয়া জনগোষ্ঠীর বাইরে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তরা অর্থনৈতিকভাবে আগের চাইতে খারাপ অবস্থায় আছে, তাই ঈদে র বাজারে তাদের ব্যয় হ্রাস পেয়েছে।
যেখানে অর্থনৈতিকভাবে মানুষ বিপর্যস্ত, নিরাপত্তাহীনতায় আতংকিত, সেখানে তারা গ্রামের বাড়িতে যায়নি এটাই স্বাভাবিক। বাড়িতে না যাওয়া মানুষের সংখ্যা গতবারের চাইতে কমেছে ৫০ লক্ষের মতো। তবে বাস্তবে সেটি বহুগুণ হতে পারে। ফলশ্রুতিতে রাস্তায়, মহাসড়কে জ্যাম কিছুটা কম ছিল সেটিই স্বাভাবিক, এতে ইউনুসের কোন কৃতিত্ব নেই। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তাদের সিন্ডিকেট ভেঙে গেছে তাই চাঁদাবাজি কমেছে বলে আমার একটা ধারণা ছিল। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে খবর নিতে গিয়ে জানলাম, বিএনপি-জামায়েতের নেতৃত্বে নতুন সিন্ডিকেট তৈরী হয়ে গেছে এবং চাঁদাবাজি বন্ধ নেই, বরঞ্চ অনেক ক্ষেত্রে কয়েকগুণ বেড়েছে।
সুতরাং এবারের ঈদে মহাসড়কে জ্যাম না থাকা ভ্রমণকারীদের জন্য স্বস্তিদায়ক ব্যাপার হলেও দেশের জন্য আশংকার খবর। এতে সরকারের ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের কোন প্রমাণ নেই, আদতে নিরাপত্তাহীনতা ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের দিকনির্দেশনা দিচ্ছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে কোরবানীর ঈদে দেশের অর্থনীতি আরও গভীর সংকটে পড়বে বলেই মনে হচ্ছে।
লেখক: শামীম আহমেদ, টরন্টো, অন্টারিও
উল্লিখিত মতামত লেখকের নিজস্ব, এবং প্রতিষ্ঠানের অবস্থান বা দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত করে না।