ফ্র্যাঙ্ক চাং, news.com.au
মেলবোর্ন ২২ এপ্রিল – অস্ট্রেলিয়ার জনসংখ্যা এখন ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অভিবাসন প্রবাহের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, আর এই গণ-অভিবাসনের সরাসরি প্রভাব পড়েছে দেশের বাসস্থান সংকটে। অর্থনীতিবিদগণ বলেছেন, অভিবাসনের এই ‘অস্বাভাবিক’ বৃদ্ধি ও বাড়িভাড়ার অগ্নিমূল্যের মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে এবং এর সমাধানও স্পষ্ট।
২০০০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার জনসংখ্যা বেড়েছে ৪০ শতাংশ, যা উন্নত দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০২৩ সালে অস্ট্রেলিয়ার মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশেরও বেশি বিদেশে জন্মগ্রহণকারী। পরিসংখ্যান বলছে, ১৮৯৩ সালের পর প্রথমবার এমনটি হয়েছে।
বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় প্রতিটি নবজাতকের বিপরীতে চারজন অভিবাসী আসছেন। অভিবাসীদের অনেকেই অস্থায়ী ভিসায় থাকা আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী, যাঁদের সংখ্যা ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতেই ছিল ১.৯৭ লক্ষ। বর্তমানে দেশে ৮.৫ লক্ষ আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী অবস্থান করছেন।
“বাসস্থান নেই, জায়গা নেই” — মেয়র ফ্র্যাঙ্ক কার্বোনের হুঁশিয়ারি
“ফেয়ারফিল্ড পুরোপুরি পূর্ণ। কোনও খালি বাড়ি নেই, নতুন কাউকে দেওয়ার মত কোন জায়গা খালি নেই।”
সিডনির ফেয়ারফিল্ডের মেয়র ফ্র্যাঙ্ক কার্বোন বলেন, “আমরা অভিবাসনের বিরোধী নই। তবে এখন যা চলছে, সেটা নিয়ন্ত্রিত না হয়ে সম্পূর্ণভাবে বিশৃঙ্খল একটা অবস্থা। এটা অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় নীতিগত ভুল।”
ফেয়ারফিল্ড, যা ‘অস্ট্রেলিয়ার শরণার্থী রাজধানী’ নামে পরিচিত, সেখানে ইরাক, সিরিয়া ও আফগানিস্তান থেকে আগত বিপুল সংখ্যক শরণার্থী বসবাস করছে।
কার্বোন আরও বলেন, “ফেয়ারফিল্ড পুরোপুরি পূর্ণ। কোনও খালি বাড়ি নেই, নতুন কাউকে দেওয়ার মত কোন জায়গা খালি নেই।”
অতিরিক্ত চাপ, কম ঘর: এক সমীকরণহীন ভারসাম্য
অস্ট্রেলিয়ায় বর্তমানে প্রায় প্রতি ৪৪ সেকেন্ডে একজন অভিবাসী স্থায়ী বসবাসের জন্য আসছেন। অন্যদিকে, দেশে বার্ষিক গৃহনির্মাণের গড় সংখ্যা মাত্র ১.৮ লাখ, যেখানে বর্তমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অনুসারে প্রয়োজন কমপক্ষে ২.৫ লাখ বাড়ি।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে, নির্মাণ অনুমোদন ৮.৮ শতাংশ হ্রাস পেয়ে ১,৫৮,৬৯০-এ নেমে এসেছে – যা গত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন।
বিভিন্ন রাজ্যে ঘর নির্মাণে ঘাটতি ভয়াবহ, যেমন ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ায় মাত্র ৪৮ শতাংশ চাহিদামাফিক নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। শুধু তাসমানিয়া ও অস্ট্রেলিয়ান ক্যাপিটাল টেরিটরিতে এখন পর্যন্ত পর্যাপ্ত বাসস্থান নির্মাণে সক্ষম হয়েছে।
অর্থনীতিবিদদের সুপারিশ: অভিবাসন হ্রাস ও গৃহনির্মাণ বাড়ানো জরুরি
“বাসস্থান সংকট সমাধানে অভিবাসন হ্রাস এবং নির্মাণ সক্ষমতা বৃদ্ধির সমন্বিত প্রয়োজন। অন্যথায়, গৃহচাহিদা প্রতিনিয়ত যোগান ছাড়িয়ে যাচ্ছে।”
AMP-এর প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. শেন অলিভার বলেন, “বাসস্থান সংকট সমাধানে অভিবাসন হ্রাস এবং নির্মাণ সক্ষমতা বৃদ্ধির সমন্বিত প্রয়োজন। অন্যথায়, গৃহচাহিদা প্রতিনিয়ত যোগান ছাড়িয়ে যাচ্ছে।”
তিনি বলেন, “বর্তমানে ৫ লাখ অভিবাসী আসার সময়, বছরে অন্তত ২.৫ লাখ ঘর নির্মাণ দরকার। অথচ বাস্তবে আমরা ১.৬ থেকে ১.৭ লাখ গৃহ নির্মাণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছি।”
রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি বনাম বাস্তবতা
লেবার সরকার ২০২৯ সালের মধ্যে ১.২ মিলিয়ন ঘর নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে (বা বছরে ২.৪ লাখ)। অপরদিকে, বিরোধীদল কোয়ালিশন দ্রুত ৫ লাখ বাড়ি নির্মাণের কথা বলেছে এবং অভিবাসন সংখ্যা তাৎক্ষণিকভাবে ১.৬ লাখে নামিয়ে আনার অঙ্গীকার করেছে।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অভ্যন্তরীণ নিয়ম-কানুন, শ্রমিক সংকট, নির্মাণ ব্যয় বৃদ্ধি এবং ডেভেলপারদের দেউলিয়া হয়ে যাওয়া – এসব বাস্তব সমস্যার কারণে এই প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়ন কঠিন।
নতুন বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে অনুমোদন থেকে সম্পূর্ণ নির্মাণে সময় দ্বিগুণ হয়ে গেছে – এক সময় যেখানে একক একটি বাড়ি ৭ মাসে তৈরি হতো, এখন তা গড়ে ১৬ মাস লাগছে।
সংকটের শিকার সাধারণ মানুষ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম
ফ্র্যাঙ্ক চাংের মন্তব্য অনুযায়ী, “অস্ট্রেলিয়ান স্বপ্ন ছিল একটি ঘর, একটি পরিবার, আর নিরাপদ ভবিষ্যৎ। কিন্তু আজ সেটাই হয়ে উঠেছে অস্ট্রেলিয়ার দুঃস্বপ্ন।”
হাউজিং ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন (HIA) জানায়, সিডনিতে একটি নতুন বাড়ির অর্ধেক খরচই সরকারী ট্যাক্স ও বিধি সংক্রান্ত ফি। একটি ইউনিটের ক্ষেত্রে তা ৩৮ শতাংশ পর্যন্ত।
অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করছেন, “এই পরিস্থিতি অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বড় সামাজিক বৈষম্যের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে – যারা ঘর কিনতে পেরেছে আর যারা পারেনি, তাদের মধ্যে পার্থক্য দ্রুত বাড়ছে।”
ফ্র্যাঙ্ক চাংের মন্তব্য অনুযায়ী, “অস্ট্রেলিয়ান স্বপ্ন ছিল একটি ঘর, একটি পরিবার, আর নিরাপদ ভবিষ্যৎ। কিন্তু আজ সেটাই হয়ে উঠেছে অস্ট্রেলিয়ার দুঃস্বপ্ন।”
মূল প্রতিবেদক: ফ্র্যাঙ্ক চাং, news.com.au