আপডেট ২৩ এপ্রিল ২০২৫ যশরাজ শর্মা, আল জাজিরা- বাংলায় অনুদিত
কাশ্মীরের পেহেলগামে ২২ এপ্রিলের রক্তক্ষয়ী পর্যটক হামলার পর ফের আলোচনায় উঠে এসেছে একটি অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত বিদ্রোহী গোষ্ঠী—‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ বা TRF। অন্তত ২৬ জন পর্যটক নিহত এবং আরও অনেক আহত হওয়ার ঘটনায় এই গোষ্ঠী দায় স্বীকার করেছে। অথচ বিগত বছরগুলোতে কাশ্মীরের বিদ্রোহীরা সাধারণত পর্যটকদের লক্ষ্যবস্তু করত না।
সাংবাদিকদের হিটলিস্টে TRF
TRF প্রথমবার বড় শিরোনামে উঠে আসে ২০১৯ সালে, যখন তারা কয়েকজন কাশ্মীরি সাংবাদিককে “বিশ্বাসঘাতক” হিসেবে চিহ্নিত করে একটি হিটলিস্ট প্রকাশ করে। এতে অন্তত পাঁচজন সাংবাদিক তৎক্ষণাৎ পদত্যাগ করেন, কারণ অতীতে এই ধরনের ‘তালিকা’ মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উল্লেখযোগ্যভাবে, প্রভাবশালী কাশ্মীরি সাংবাদিক ও Rising Kashmir পত্রিকার সম্পাদক শুজাত বুখারিকে ১৪ জুন ২০১৮ সালে শ্রীনগরে তার অফিসের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়। কাশ্মীর পুলিশ এই হত্যাকাণ্ডের জন্য লস্কর-ই-তইয়েবাকে দায়ী করে।
ধর্মীয় তীর্থযাত্রীদের বাসে হামলার দায় স্বীকার
২০২৪ সালের জুন মাসে TRF জম্মুর রেয়াসি জেলায় হিন্দু তীর্থযাত্রী বহনকারী একটি বাসে হামলার দায় স্বীকার করে, যাতে কমপক্ষে ৯ জন নিহত ও ৩৩ জন আহত হন। বাসটি হামলার সময় খাদে পড়ে যায়।
TRF-এর কৌশল: পুরনো ও নতুনের মিশ্রণ
TRF-এর নাম ও কৌশল বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ব্যতিক্রমী। ইংরেজি নাম এবং টেলিগ্রাম ও অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে উপস্থিতি তাদের আলাদা পরিচিতি দিয়েছে। তবে তারা পুরনো কৌশলগুলোও অবলম্বন করেছে।
২০১৪ সালের পর থেকে কাশ্মীরি বিদ্রোহী কমান্ডাররা সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদের উপস্থিতি বাড়িয়েছিল। কমান্ডারদের আপেল বাগানে হাঁটা, ক্রিকেট খেলা, কিংবা বাইক চালানোর ভিডিও ছড়িয়ে পড়ত। এসব ভিডিও তরুণদের মধ্যে বিপুল প্রভাব ফেলেছিল। বুরহান ওয়ানি এই কৌশল ব্যবহার করে পরিচিত হন এবং ২০১৬ সালে তার হত্যাকাণ্ডের পর ব্যাপক বিক্ষোভ হয়, যেখানে শতাধিক বেসামরিক মানুষ নিহত হন।
কিন্তু ২০১৯ সালের অভিযানের পর এই কৌশল কাজ করা বন্ধ করে দেয়। TRF এর যোদ্ধারা আবার মুখ ঢেকে, ছদ্মবেশ ধারণ করার কৌশল বেছে নেয়। হামলার সংখ্যা কমলেও, সহিংসতার তীব্রতা বেড়ে যায়।
নেতৃত্ব, সংকোচন ও ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ ঘোষণা
TRF-এর নেতৃত্বে ছিলেন মোহাম্মদ আব্বাস শেখ, যিনি ১৯৯৬ সালে বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিলেন। ২০২১ সালে তার মৃত্যু এবং পরের বছরে অন্যান্য অনেক যোদ্ধার মৃত্যুর পর TRF পার্বত্য অঞ্চলের গভীর জঙ্গলে আশ্রয় নেয়।
পাকিস্তান থেকে অস্ত্র পাচার ও নতুন বিদ্রোহীদের নিয়োগের অভিযোগে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ভারত সরকার TRF-কে একটি “সন্ত্রাসী সংগঠন” হিসেবে ঘোষণা করে। তবে বারবার অভিযানে TRF-এর যোদ্ধারা কমে আসলেও, নিরাপত্তা সূত্রে জানা যায়—তারা এখনও প্রশিক্ষিত এবং দুর্গম পার্বত্য এলাকায় অবস্থান করছে।
মোদি সরকারের কাশ্মীর নীতিতে প্রশ্ন
এই হামলার পর প্রশ্ন উঠেছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির “স্বাভাবিকতা” ভিত্তিক কাশ্মীর নীতিকে ঘিরে। ২০১৯ সালে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের পর সরকার পর্যটনকে উৎসাহিত করে আসছিল। গুজরাটের জামনগরের পর্যটক কৈলাশ সেঠি বলেন, “আমরা মাত্র দুই দিন আগে পেহেলগামে গিয়েছিলাম। এখন শুধু পরিবার নিয়ে পালাতে চাই। খুব ভয় লাগছে।”
এই হামলার পর ব্যাপক আতঙ্ক ছড়ায়। পর্যটকরা হোটেল বুকিং বাতিল করে কাশ্মীর ছাড়তে শুরু করেন। শ্রীনগর বিমানবন্দরের পথে ব্যাপক যানজট এবং বিমানের টিকিটের দাম এক লাফে ৩০০ শতাংশ বেড়ে যায়।
দক্ষিণ এশিয়ার সন্ত্রাসবিরোধী পর্যবেক্ষক প্ল্যাটফর্ম SATP-এর নির্বাহী পরিচালক অজয় সাহনি বলেন, “কাশ্মীরে পুরোপুরি রাজনৈতিক সমাধান ছাড়া জিরো মিলিটেন্সি অর্জন করা সম্ভব নয়। আর ‘স্বাভাবিকতা’র এই গল্প বিপজ্জনক কারণ এতে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে আক্রমণের অনুপ্রেরণা দেয়।”
মঙ্গলবার সন্ধ্যার মধ্যে আহত ও নিহতদের ঘোড়া ও সামরিক যান দিয়ে নামানো হয়। পেহেলগাম শহর পুরোপুরি সিল করে দেওয়া হয়। শ্রীনগরসহ একাধিক স্থানে ব্যবসায়ী সংগঠন ও রাজনৈতিক দলগুলোর আহ্বানে শোক পালন করে বন্ধ পালন করা হয়।
পেহেলগামে এক আতিথেয়তা কর্মী রাহুল (ছদ্মনাম) বলেন, “এখন আবার ধরপাকড়, সেনাবাহিনীর উপস্থিতি বাড়বে। সবাই এখান থেকে বেরিয়ে যেতে চায়।”