মেলবোর্ন, ২ মে— তিন বছর পর ফের নির্বাচনি উৎসবের সামনে দাঁড়িয়ে ওশেনিয়া অঞ্চলের দ্বীপ-রাষ্ট্র অস্ট্রেলিয়া। শনিবার (০৩ মে) ১ কোটি ৮০ লাখেরও বেশি অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক বর্তমান মধ্য-বামপন্থী লেবার পার্টি এবং রক্ষণশীল-ঝোঁকযুক্ত লিবারেল/ন্যাশনাল কোয়ালিশন প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে একটি বেছে নিতে ভোট দেবেন।
সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ভোটকেন্দ্র খোলা থাকবে। সাধারণত স্থানীয় স্কুল, গির্জা হল বা কমিউনিটি সেন্টারে ভোটগ্রহণ করা হয়।
১৮ বছর বা তার বেশি বয়সী সব অস্ট্রেলিয়ান নাগরিকের জন্য ভোট দেওয়া বাধ্যতামূলক। কেউ ভোট না দিলে অর্থ জরিমানা করা হয়।
যেসব অস্ট্রেলিয়ান ভোটকেন্দ্রে এসে সরাসরি ভোট দিতে অক্ষম তারা ইতোমধ্যে পোস্টাল ভোট দিয়েছেন। নির্বাচনের দুই সপ্তাহ আগে অগ্রিম ভোট দেওয়ার জন্য সারাদেশে প্রায় ৫৫০ প্রাথমিক ভোটকেন্দ্র খোলা হয়েছে।

এবারে অনুষ্ঠিত হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার ৪৮তম সংসদ নির্বাচন। যার মধ্যে হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভের ১৫০ সদস্যের পাশাপাশি সিনেটের ৭৪ জনের মধ্যে ৪০ সদস্য রয়েছেন।
অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজের মধ্য-বামপন্থি লেবার পার্টি ২০২২ সালের মে মাসে ক্ষমতা গ্রহণ করে। সেসময় প্রায় এক দশক ক্ষমতায় থাকার পর জনপ্রিয়তা হারানো কনজারভেটিভ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে তার দল।
শুরুতে আলবানিজের (৬২) সরকারকে ঘিরে আশা-প্রত্যাশা ও উৎসাহ থাকলেও সাম্প্রতিক মাসগুলোতে জনপ্রিয়তা হারাতে শুরু করেছে তার দল। তিন বছর মেয়াদের শেষ পর্যায়ে এসে আলবানিজের সরকারের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
জনমত জরিপে ডানপন্থি নেতা পিটার ডাটন (৫৪) ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আলবানিজ প্রায় একই ধরনের জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। আসন্ন নির্বাচনে এই দুই প্রার্থীর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের ইঙ্গিত দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
আশঙ্কা করা হচ্ছে, প্রায় প্রতি তিনজন ভোটারের একজন প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী— বর্তমান প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি অ্যালবানিজি ও বিরোধী নেতা পিটার ডাটনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে অন্য কোনো প্রার্থীকে বেছে নিতে পারেন। জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধি ও ভোটারদের ওপর ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘ভূত’ চেপে যাওয়ায় এমনটা ঘটতে পারে।
নির্বাচনের দিন লাল পোশাক পরা স্বেচ্ছাসেবকরা থাকবেন শাসক লেবার পার্টির জন্য, যারা বর্তমানে জরিপে এগিয়ে। নীল রঙে থাকবেন বিরোধী কোয়ালিশনের স্বেচ্ছাসেবকরা, যাদের শুরুটা শক্তিশালী হলেও পাঁচ সপ্তাহের প্রচারণায় গতি হারিয়েছে।
গার্ডিয়ান অ্যাসেনশিয়াল জরিপে দেখা গেছে, ৩২% ভোটার প্রথম পছন্দ দিয়েছেন লেবারকে, আর ৩৪% দিয়েছেন কোয়ালিশনকে।
কিন্তু পছন্দক্রম অনুযায়ী ভোট বণ্টনের পর লেবার এগিয়ে থাকবে ৫২.১% বনাম ৪৭.৯%-এ। এলাকাভিত্তিক ভোটের হেরফের অনুযায়ী, এতে লেবার পার্টি হয়তো সংখ্যালঘু সরকার গঠন করবে, আবার সম্ভবত সংখ্যাগরিষ্ঠও হতে পারে। এই পূর্বাভাস অন্যান্য জরিপের সঙ্গেও মিল রয়েছে।

শনিবারের নির্বাচনে গ্রিনস পার্টিও প্রতিযোগিতায় থাকবে, কারণ তারা ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করছে, যদি লেবার বা কোয়ালিশন কেউই সরাসরি সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায়। ধারণা করা হচ্ছে, তারা প্রায় ১৩% ভোটারের প্রথম পছন্দ হিসেবে ভোট পাবে।
হলুদ রঙে দেখা যাবে ট্রাম্প-পন্থী ট্রাম্পেট অব প্যাট্রিয়টস পার্টির কর্মীদের, যেটি খনিজ ধনকুবের ক্লাইভ পামারের সহায়তায় পরিচালিত হচ্ছে। এই দলটি দেশজুড়ে ভোটারদের রাগিয়ে তুলেছে অনাকাঙ্ক্ষিত টেক্সট মেসেজের মাধ্যমে।
চিরায়ত ডানপন্থী প্রতিদ্বন্দ্বী পলিন হ্যানসনের ওয়ান নেশন পার্টি ২০২২ সালে তাদের প্রাথমিক ভোট ৫% ছিল, এবং এবারে কিছু আসনে তাদের প্রভাব বাড়তে পারে, যদিও নিজে কোনো আসন জেতার সম্ভাবনা কম।
যদি কোনো দলই সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায়, তবে টিল স্বতন্ত্র প্রার্থীরা (নীল এবং সবুজ রাজনীতির প্রতীক কমিউনিটির স্বাধীন প্রার্থী, অস্ট্রেলিয়ার রাজনীতিতে বিভিন্ন মধ্যপন্থী, স্বাধীন বা নির্দলীয় রাজনীতিবিদ যাদের অস্ট্রেলিয়ার মিডিয়া আলোচনার সুবিধার্থে সম্মিলিতভাবে একত্রিত করেছে) ‘কিংমেকার’ হয়ে উঠতে পারে।
তারা ২০২২ সালের নির্বাচনে জলবায়ু সংকট, নৈতিকতা ও লিঙ্গ সমতার ইস্যুতে প্রচলিত লিবারেল আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সাফল্য পেয়েছিল। তারা অস্ট্রেলিয়ান রাজনীতিতে একটি শক্তিশালী উদীয়মান শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। তারা লিবারেল প্রার্থীদের পরাজিত করেছে এবং হুমকির মুখে ফেলেছে।
“টিল” নামে পরিচিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সাধারণত জলবায়ু পরিবর্তন, রাজনৈতিক সততা, এবং সামাজিক ন্যায় ইস্যুগুলোর ওপর গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে, যা ঐতিহ্যবাহী বড় দল লেবার এবং কোয়ালিশন-কে চ্যালেঞ্জ করছে।

জেনারেশন জেড ও মিলেনিয়ালরা — যারা জীবনযাত্রার ব্যয় এবং আবাসন সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত —তারা এখন অস্ট্রেলিয়ায় সংখ্যার দিক থেকে একসময়ের প্রভাবশালী বেবি বুমারদের ছাড়িয়ে গেছে।
দুই প্রধান দল ভিন্ন ভিন্ন কর নীতির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। লেবার পার্টি দিয়েছে আয়কর কমানোর, আর কোয়ালিশন দিয়েছে জ্বালানি কর কমানোর প্রতিশ্রুতি।
তারা প্রথমবার বাড়ি কিনতে চাওয়া ক্রেতাদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন আবাসন নীতিও এনেছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, উভয় প্রস্তাবই ইতিমধ্যেই বেড়ে যাওয়া বাড়ির দাম আরও বাড়াবে।
লেবার পার্টি জোরালোভাবে তাদের স্বাস্থ্যনীতি প্রচার করছে, যার মূল লক্ষ্য হলো GP (জেনারেল প্র্যাকটিশনার) সেবাগুলোতে সরাসরি ফ্রি কনসালটেশন প্রাপ্তির হার পতন ঠেকানো। তবে, চিকিৎসকদের সংগঠনসহ অনেকে এই নীতিগুলো নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
প্রধান দুই দলের মধ্যে সবচেয়ে বড় নীতিগত পার্থক্য সম্ভবত জ্বালানি উৎপাদন নিয়ে।
উভয় দলই বলছে যে তারা ২০৫০ সালের মধ্যে নিট কার্বন নির্গমন শূন্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ। লেবার পার্টি ২০৩০ সালের জন্য একটি ভিশন আইন করে নির্ধারণ করেছে এবং বলেছে যে তারা নবায়নযোগ্য জ্বালানির অংশ বাড়িয়ে ও কয়লা ধীরে ধীরে বাদ দিয়ে ২০৫০ সালের মধ্যে শূন্যে পৌঁছাবে।
অন্যদিকে, কোয়ালিশন হুমকি দিয়েছে লেবারের জলবায়ু সংক্রান্ত উদ্যোগ বাতিল করার। তারা একটি বহুল সমালোচিত পরিকল্পনার প্রতি অনড় রয়েছে। তা হলো– নতুন করে পারমাণবিক বিদ্যুৎ শিল্প শুরু করা, যা ক্লাইমেট চেঞ্জ অথরিটি সতর্ক করেছে যে ২০৫০ সালের মধ্যে শূন্য লক্ষ্য অর্জনকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
২০২৫ সালের নির্বাচনি প্রচারণায় সবচেয়ে অনির্দেশ্য উপাদানগুলোর একটি ছিল ট্রাম্প। তার নেতৃত্বে বাণিজ্য যুদ্ধ অর্থনীতিকে ধ্বংস করতে পারে, বিদেশি সহায়তা হ্রাস এই অঞ্চলে প্রাণঘাতী বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে, এবং তার পুনর্নির্বাচন অস্ট্রেলিয়ায় সংস্কৃতি যুদ্ধকে পুনর্জীবিত করেছে।
পিটার ডাটন, যিনি কুইন্সল্যান্ডের সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা। দীর্ঘদিন ধরে “হার্ডম্যান” বা কঠোর নেতার ভাবমূর্তিতে পরিচিত তিনি। যদিও মাঝে মাঝে তিনি তা বদলাতে চেষ্টা করেছেন। ট্রাম্পের নির্বাচনের পর ডানপন্থীদের মধ্যে উত্সাহ ফিরে আসে, এবং ডাটন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কিছু নীতির প্রতিধ্বনি করা শুরু করেন।
ডাটনের নির্বাচনি স্লোগান – “গেট অস্ট্রেলিয়া ব্যাক অন ট্র্যাক” – ট্রাম্পের বিখ্যাত স্লোগান “মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন”-এর স্পষ্ট প্রতিধ্বনি।

তিনি সরকারি দক্ষতার জন্য একটি ছায়ামন্ত্রী হিসেবে জাসিন্তা নাম্পিজিনপা প্রাইস-কে নিয়োগ দেন। যিনি বলেন, “ডাটনের সরকার অস্ট্রেলিয়াকে আবার মহান করে তুলবে।” ডাটনের নির্বাচনি স্লোগান – “গেট অস্ট্রেলিয়া ব্যাক অন ট্র্যাক” – ট্রাম্পের বিখ্যাত স্লোগান “মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন”-এর স্পষ্ট প্রতিধ্বনি।
ডাটন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে তিনি ক্যানবেরার ৪১,০০০ সরকারি কর্মচারী ছাঁটাই করবেন। বিশেষভাবে “সংস্কৃতি, বৈচিত্র্য ও অন্তর্ভুক্তি” বিষয়ক উপদেষ্টাদের লক্ষ্য করে তার এই হুঁশিয়ারি। এছাড়াও তিনি অভিবাসন ও অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন।
তিনি কিছু সংবাদমাধ্যমের অধিকার হরণ করার চেষ্টাও করেছেন। বিশেষ করে Guardian Australia ও জাতীয় সম্প্রচার মাধ্যম ABC-কে আখ্যা দিয়েছেন “ঘৃণার মিডিয়া” হিসেবে।
প্রচারণার শেষ সপ্তাহে, ডাটন আবারও সংস্কৃতি-ভিত্তিক দ্বন্দ্ব উসকে দেন। বলেছিলেন যে আদিবাসী ঐতিহ্যবাহী নেতাদের ‘Welcome to Country’ অনুষ্ঠানগুলো অতিরিক্ত হয়ে গেছে।
ডাটন বলেন, তিনি “নীরব অস্ট্রেলীয়দের” ওপর ভরসা করছেন তাকে বিজয় এনে দেওয়ার জন্য। বিরোধীদলের কিছু সদস্য বলেছেন, তাদের অভ্যন্তরীণ জরিপ প্রকাশিত জরিপগুলোর চেয়ে তাদের ভালো অবস্থানে দেখাচ্ছে।
তারা সঠিকও হতে পারে — কারণ জরিপ ভুল প্রমাণিত হয়েছে আগেও: যেমন ২০১৯ সালের অস্ট্রেলিয়ার ফেডারেল নির্বাচন, যুক্তরাষ্ট্রে হিলারি ক্লিনটনের পরাজয়, এবং অন্যান্য দেশেও। সবকিছু সময়ই বলে দেবে।
—গার্ডিয়ান অবলম্বেন।