আধ্যাত্মিকতা, ভক্তি এবং একতার এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশে ব্রিসবেনে অনুষ্ঠিত হয়েছে শ্রীশ্রী ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের পবিত্র ১৩৭তম জন্মবার্ষিকী উৎসব। শনিবার ১২ এপ্রিল, ২০২৫ সানিব্যাংক হলে অনুষ্ঠিত হয় এই মহা উৎসবের মূল পর্ব। প্রাতঃকালীন প্রার্থনা ও ঊষাকীর্তনের মাধ্যমে এই মহা উৎসবের সূচনা হয় ব্রিসবেনের গৌতম পালের বাসভবনে। পূজ্যপাদ আচার্যদেব এবংপূজনীয় অবিন দার আশীর্বাদে এই অনুষ্ঠান এক গাম্ভীর্যপূর্ণ রূপ লাভ করে।
চিল্ড্রেন সৎসঙ্গে ভবিষ্যতের নির্মাতা শিশুরা ঠাকুরের পথে (Photo: Deepak)
চিল্ড্রেন সৎসঙ্গ অনুষ্ঠানে প্রবাসে বেড়ে উঠা শিশুদের অংশগ্রহণ ছিল স্মরণ রাখার মতো। সিডনি থেকে রূপাঙ্গন এই সেশনটির পরিচালনা করেন। প্রার্থনা, ধ্যান, ভজন-কীর্তন, ঠাকুরের জীবন ও দর্শন নিয়ে গল্প ও আলোচনা এবং পবিত্র গ্রন্থ পাঠের মাধ্যমে ছোটদের ভক্তিময় পরিবেশে যুক্ত করা হয়।
মাতৃসন্মেলনে মায়েদের ভক্তি, জ্ঞান ও কীর্তন পরিবেশনা (ছবি:মাধব হাওলাদার)
মাতৃসন্মেলনী পর্বটি ছিল হৃদয়গ্রাহী। অ্যাডিলেড থেকে নিপা মার সঞ্চালনায় এ অংশে ছিল ধ্যান, মাতৃজয় গান, গ্রন্থ পাঠ ও মায়েদের ভূমিকা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। নিপা বিশ্বাস মা ঠাকুর প্রদত্ত বিবাহ সংস্কার নিয়ে একটি মূল্যবান আলোচনা করেন। জেমস কুক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথের লেকচারার ড. স্মরণিকা তালুকদার মা,, বক্তব্যে বলেন—একজন মা-ই ভবিষ্যতের নেতৃত্বগুণসম্পন্ন সন্তান গঠনে মুখ্য ভূমিকা রাখেন। তিনি ঠাকুরের ভালবাসা-ভিত্তিক আচরণ ও শিক্ষার দর্শনের গুরুত্ব তুলে ধরেন।
সঙ্গীতাঞ্জলি পর্বে ব্রিসবেনের গোপাল দা, ঋপা মা এবং প্রণব পদ্মাল দা তাঁদের ভক্তিগীতি নিবেদন করেন। অমল চক্রবর্তী দা পূজ্যপাদ শ্রীশ্রী দাদার একটি কবিতা আবৃত্তি করেন এবং প্রণব দার বাঁশির সুরে মুগ্ধ হয়ে যায় উপস্থিত দর্শকবৃন্দ।
মহা উৎসবে আগত অতিথিদের একাংশ (ছবি:মাধব হাওলাদার)
মূল অনুষ্ঠান শুরু হয় অপা মার পরিচালনায় সন্ধ্যা প্রার্থনার মাধ্যমে। এরপর মেলবোর্নের প্রিয়াঙ্কা মার কণ্ঠে “সবচে সুন্দর নাম ঠাকুরজি” গীতির মাধ্যমে সঙ্গীতাঞ্জলি পর্ব শুরু হয়। রূপাঙ্গন (সিডনি) এবং গুরু চরণ দা (পার্থ) পরিবেশন করেন হৃদয় ছোঁয়া কীর্তন। বিন্নি ও আরাধ্য অতিথিদের ফুলের তোড়া এবং পবিত্র গ্রন্থ ‘সত্যানুশরণ’ উপহার দিয়ে আন্তরিকভাবে অভ্যর্থনা জানান।
সূচনা বক্তব্যে, ইঞ্জিনিয়ার বিবেক নাগ শ্রীশ্রীঠাকুরের ‘Being and Becoming’ দর্শনের সাবলীল উপস্থাপনা। (ছবি: মাধব হাওলাদার)
প্রারম্ভিক ভাষণেইঞ্জিনিয়ার বিবেক নাগ দা (সিডনি) ঠাকুরের “Being and Becoming” দর্শনের ব্যাখ্যা করেন। তিনি তুলে ধরেন কীভাবে ঠাকুরের প্রতি প্রার্থনা ও ভালোবাসা অস্ট্রেলিয়ার অনুসারীদের জীবনশক্তি ও সহমর্মিতায় পরিপূর্ণ করেছে। তিনি এ সময় মেলবোর্নের গুরু ভাই দীপেশ দার ক্যানসারের বিরুদ্ধে সাহসিকতাপূর্ণ সংগ্রামকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন।
প্রধান অতিথি ড. গোপাল কৃষ্ণ বসু দা বক্তব্য শুরু করেন বৃহদারণ্যক উপনিষদ এর এক শ্লোক দিয়ে—“অসতো মা সদগময়…”।
তিনি বলেন, প্রকৃত ধর্ম মানে জীবনের রূপান্তর, চরিত্র গঠন ও নির্লোভ সেবার মাধ্যমে ঈশ্বরীয় গুণ প্রকাশ। ঠাকুর ও শ্রীরামকৃষ্ণের বাণী একই সুরে প্রতিধ্বনিত হয়—মন্দির নয়, ঈশ্বর খুঁজতে হয় কর্মে ও ভালবাসায়। তিনি সৎসঙ্গের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে বলেন, “এক প্রদীপ আরেক প্রদীপকে প্রজ্বলিত করে”—এভাবেই সত্যের আলো ছড়ায় সমাজে।
ঠাকুর বলেছেন—আমরা সবাই অসীম সম্ভাবনা নিয়ে জন্মাই, এবং সেই সম্ভাবনার বিকাশ ঘটাতে হলে একজন ‘সুপ্রিম আদর্শ’ বা ‘পরম পুরুষ’ এর নির্দেশনা অনুসরণ করতে হবে। তিনি ঠাকুরের বাণী উদ্ধৃত করেন— “যখন আদর্শ জাগ্রত হয়, তখন মানুষ সক্রিয়, সচেতন, কুশলী ও দায়িত্ববান হয়ে ওঠে”।
ড. সুভাষ নন্দী’র (SPR) আলোচনায় বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার অপূর্ব সমন্বয় (ছবি:মাধব হাওলাদার)
ড. সুভাষ নন্দী, (SPR), তাঁর ভাষণে শিশুদের সৎসঙ্গে অংশগ্রহণ দেখে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, শ্রীশ্রী ঠাকুর বিজ্ঞানসম্মতভাবে পরমাণু সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতেন যা সমসাময়িক বিজ্ঞানীদের অবাক করত। ঠাকুর বলেছেন—আমরা সবাই অসীম সম্ভাবনা নিয়ে জন্মাই, এবং সেই সম্ভাবনার বিকাশ ঘটাতে হলে একজন ‘সুপ্রিম আদর্শ’ বা ‘পরম পুরুষ’ এর নির্দেশনা অনুসরণ করতে হবে। তিনি ঠাকুরের বাণী উদ্ধৃত করেন— “যখন আদর্শ জাগ্রত হয়, তখন মানুষ সক্রিয়, সচেতন, কুশলী ও দায়িত্ববান হয়ে ওঠে”।
তাঁর বক্তব্যে ঠাকুরের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা ও দর্শনের জীবন্ত প্রতিফলন ঘটান তিনি। তিনি বলেন, আমরা যদি এমন এক আদর্শের সঙ্গে যুক্ত হই এবং প্রেম, ধ্যান ও প্রার্থনার শক্তিকে গ্রহণ করি, তবে জীবন হবে নির্ভয় ও আনন্দময়।
গৌতম পাল তাঁর ধন্যবাদ জ্ঞাপন বক্তব্যে অনুষ্ঠানে সরাসরি ও অনলাইনে অংশ নেওয়া সকল ভক্ত, অতিথি ও পৃষ্ঠপোষকদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানান এবং অনুষ্ঠানকে সফলভাবে সম্পন্ন করার জন্য তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
এই ব্রিসবেন উৎসবটি প্রমাণ করে, দেশকাল পেরিয়ে শ্রীশ্রী ঠাকুরের বাণী আজও মানুষের হৃদয়ে এক নবচেতনার সঞ্চার করে, এবং তাঁর দর্শন—ভালবাসা, প্রার্থনা ও মানবিকতার পথে চলার—আমাদের সকলকে একত্রিত করে।