ডাক্তার ফারজানা সুমির গল্প
“সিলেকশন”-
প্রকাশিত- মেলবোর্ন মে ৯, ২০২৫
১.
রায়হান ফুটপাথের পাশে গাড়িটা পার্ক করার সময় স্টার্ট বন্ধ করে জানালাগুলো একটু ফাঁকা করে বসার চেষ্টা করলো। আচমকা তিনদিক থেকে যে এভাবে এটাক হবে কিছুতেই আশা করেনি। ড্রেনের গন্ধ, মশা এবং পোড়া মবিলের গন্ধ মিশৃত হল্কা বাতাস।
তড়িঘড়ি জানালা কাঁচ উঠিয়ে আবার স্টার্ট দিয়ে এসিটা ছেড়ে কেবল হেলান দিয়েছে এমন সময় পাশের দরজা হ্যাঁচকা টানে খুলে কাকলি ধপ করে বসে পড়লো পাশে। আরেকটু হলে রায়হানের ডিফেন্স রিফ্লেক্স এটাক করে বসতো।
কাকলি কাল বিলম্ব না করেই সীট বেল্ট লাগিয়ে এক পা আরেক পায়ের উপর তুলে দিয়ে আরাম করে বসলো। তারপর রায়হানের দিকে না তাকিয়েই কথা শুরু করলো।
– অনেক্ষণ অপেক্ষা করেছেন?
– না, পাঁচ মিনিটেরও কম হবে। আপনি আমাদের গাড়ি চিনেন?
– অফিসে আজ বিকালের কাজ কম ছিলো। টেক্সট করে জেনে নিয়েছিলাম গাড়ির রং আর নম্বরটা। আপনি ঢাকায় ড্রাইভ করতে অভ্যস্ত?
– না।
– বুঝতে পারছি। শুনেন সামনে বায়ে ইউটার্ন নিয়ে আবার ঘুরে আসেন। আমাদের অফিসের পার্কিংএ গাড়ি রেখে আমরা সামনে কোথাও বসবো।
রায়হান ভদ্রলোক, কথা মতই কাজ হলো। গাড়ি থেকে নেমেই কাকলি জানতে চাইলো এ দিকটা রায়হান চিনে কিনা। উত্তর স্বাভাবিক ভাবেই “না” এলো। কাকলি রায়হানকে বললো তাকে ফলো করতে।
অফিস ছুটির সময়, ঘরমুখী মানুষের ঢল। কাকলি ধাম ধাম করে লম্বা লম্বা স্টেপে হেঁটে চলছে। রায়হান শুধু কাকলিকে ফলো করার তাগিদে একটু পর পর ফুটপাথ থেকে রাস্তায় নেমে পড়ছে। একটা গাড়ি পেছন থেকে আচমকা এমনভাবে হর্ণ দিলো যে রায়হান হঠাৎ ফুটপাথে উঠতে গিয়ে একজনের গায়ে জোরে ধাক্কা দিলো। লোকটা অগ্নি দৃষ্টিতে রায়হানের দিকে তাকিয়েই হন হন করে হাঁটতে থাকলো।
রায়হান চিৎকার করে “সরি” বললো। সেই চিৎকারে দুঃখ প্রকাশ কম বিরক্তই বেশি। অসভ্যের মত হর্ণ বাজানো গাড়ির ড্রাইভারের অধৈর্য্য, ফুটপাথের লোকটার বিরক্তচাহনি আর কাকলির ফুটপাথ দিয়ে তাকে হাঁটানোর সিদ্ধান্তের বিরূদ্ধে যেন তীব্র গর্জন।
কাকলি পেছন ফিরে তাকিয়ে বুঝলো রায়হানের তাকে ফলো করতে কষ্ট হচ্ছে। রায়হান কাছাকাছি আসতেই তাকে ইশারায় সামনে হাঁটতে বললো।
– আমি আপনাকে ফলো করি, আপনে সামনে হাঁটেন।
– কই যাইতেছি আমরা?
– গোল চক্করের থার্ড এক্সিটে যান, তারপর আমি বলতেছি।
– আপনি রেস্টুরেন্টের নাম বলেন, আমি গুগল ম্যাপে দেখে যাইতে পারবো।
– তাতো পারবেনই, শুধু হাতের মোবাইলটা যখন খাপা দিয়ে নিয়ে দৌড় দিবে তখন ধরতে পারবেন না।
রায়হান সামনে হাঁটছে। প্রথমে গোল চক্কর, তারপর জেব্রাক্রসিং না মেনেই ডিভাইডার টপকে রাস্তার উল্টাদিকের ফুটপাথে উঠে এলো। তারপর পিছনে ফিরে দেখে কাকলি মাথা ঘুরিয়ে ডানে বামে তাকিয়ে রাস্তা পাড় হবার চেষ্টা করছে।
রায়হান কল্পনায় নিজের পিঠ চাপড়ে দিলো। কাকলির সামনে নিজেকে বেশ স্মার্ট মনে হলো। ঢাকায় চলাফেরার হ্যাক যে তার মধ্যে গেঁথে আছে সেটা কাকলি একটু বুঝুক।
রাস্তার এপাশটা বেশ অন্যরকম। ফুটপাথ নেই, পর পর কয়েকটা বড়লোকি খাবারের দোকান। প্রত্যেকটারই নিজস্ব পার্কিং আছে, ছোট্ট করে একটু লন আছে। তাই এদিকটায় পায়ে হাঁটার লোকের ভীড় নেই। এই প্রথম মনে হলো ঢাকার বিকেলের ঝির ঝির বাতাস তার চিবুক ছুঁয়ে গেলো।
রেস্তোরাঁটা যেহেতু কাকলির চেনা তাই কাকলিকেই জিজ্ঞেস করলো বাইরে নাকি ভেতরে বসবে। মনে মনে চাচ্ছিলো ভেতরের এসিতে শান্ত মত বসতে, বাইরের ট্রাফিকের লাউড সাউন্ড রায়হান নিতে পারেনা। গলার স্বর উঁচু করে কথা বলতে হয়, কেমন যেন একটা ইরিটেশন হয়। আজকের মত এমন গুরুত্বপূর্ণ মিটিংএ গলার স্বর এবং মুখের রেখা যতটা সম্ভব শান্ত থাকুক সে চায়।
ভাবতে ভাবতে কাকলিকে অনুসরণ করে কাউন্টার ক্রস করে আরেকটা খোলা জায়গায় চলে এসেছে। ঠিক ব্যাকইয়ার্ড না, হবে কিছু একটা। একটু শেড দেয়া, পাশে কৃত্তিম পানি প্রবাহ এবং একটা বাঁশ ঝাড়।
কাকলি তাকে ডান দিকে ইশারা করে বললো,
– ওয়াশ কেবিন ওদিকে। আপনি আগে যাবেন নাকি আমি?- আপনি যান। আমি একটু বসি। এত দৌড় ঝাঁপের পর ঠান্ডা পানির তৃষ্ণা হচ্ছে।
কাকলি চলে যেতেই মেবাইলটা পকেট থেকে বের করলো। মা টেক্সট করেছে, “ঠিকমত পৌঁছেছিস? কাকলিকে চিনতে পেরেছিস?? কোনো সমস্যা হলে আমাকে কল দিবি।” রায়হান ছোট করে লিখলো “সব ঠিক আছে”।
খাবার আসতে আসতে রায়হান একটু ফ্রেশ হয়ে এলো। রায়হান ভোজন রসিক না, তবে রেস্টুরেন্টে বসে হেল্দি খাবার খেতে সে পছন্দ করেনা। আজকের মেনু কাকলি দেখেছে। রায়হান বলেছিলো জায়গাটা যেহেতু আপনার পরিচিত তাই আপনি ভালো জানবেন এখানকার কোন কোন খাবারগুলো মজার। ফিরে এসে দেখে ড্রিংকস আর স্টার্টার সার্ভ হয়ে গেছে।
২.
রায়হানের সেদিন বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত এগারোটা। মনে মনে খুশি হলো মা নিশ্চই ঘুমিয়ে পড়েছে। কাজের মেয়েটা দরজা খুলে দিয়েই মা’র বেডরূমের দিকে তাকিয়ে বললো, “খালাম্মা, ভাইয়া আসছে”।
রায়হান জুতা খুলতে খুলতে আড় চোখে দেখলো মা ডাইনিং টেবিল পর্যন্ত চলে এসেছে। নিজের ঘরের দিকে রওনা দিবে এমন সময় মা’ই জিজ্ঞেস করলো
– কিরে কেমন দেখলি?
– কি দেখলাম?
– মেয়ে, আবার কি!
“মেয়ে তো দেখিনি মা, সালোয়ার কামিজ পরা পোলা দেইখা আসলাম”। মনে মনে এটা বলতে চাইলেও মুখে বললো
– কেন তুমি দেখো নাই?
– হ, দেখসিনা আবার। তোর বকুল খালাম্মার খালতো ভাইয়ের মেয়ে।
– তাইলে আমারে জিগাও কেন?
– তর পছন্দ হইছে?
– মেয়ে তো আমার তে লম্বা।
– কইছে তরে, তর কানের লতি পর্যন্ত হইবো বেশি হইলেও।
– লম্বায় ছুডো হইলেও যে স্বাস্থ্য, বিয়া হইলে উঠতে বলতে ঘুষাইবো।
– দরকার আছে, তর জন্য এইডাই ঠিক আছে!
রায়হান কাজের মেয়েটার মাথায় একটা টোকা দিয়ে বললো, যা আমার টাওয়েল নিয়ে আয়। বাথরূম থেকে ফ্রেশ হয়ে বের হবার সময় নাভির উপরটা কেমন যেন চিন চিন করে উঠলো। রায়হানের মনে পড়লো কাকলির কথা।
রায়হান গত সপ্তাহে একটা পাত্রী দেখতে গিয়েছিলো। মেয়েটা খুব সুন্দরী। একটা পারিবারিক পরিবেশে পাত্রী দেখার আয়োজন। মেয়েটার মুখটা বেশ সুন্দর, কিন্তু চোখ দু’টা জানি কেমন। কেমন মানে বলে বোঝানো যাবেনা। কথা বলার সময় মনে হয় প্যারানয়েড, পলক ফেলে না। রায়হানের দিকে তাকায়নি কিন্তু আরেকজনের দিকে তাকিয়ে কথা শুনছিলো, দেখেই কেমন ভয় লেগেছিলো রায়হানের।
এবার দেশে আসার পর থেকে সপ্তাহে গড়ে দেড়টা করে মেয়ে দেখেছে। রেস্টুরেন্টে গেলে রায়হানই বিল দিয়েছে আর বাসা হলে মিষ্টি নিয়েছে। এই প্রথম আজ তাকে বিল দিতে হয়নি, কাকলি নাকি টেবিল বুকিং দেয়ার সময় পে করেছিলো।
আজব মাতব্বর টাইপের মেয়ে। ডিনার করার সময় তার বাসা থেকে কয়েকবার ফোন আসলো। প্রতিবারই বলতে শোনা গেল, “আমি ফেরার পথে দোকান খোলা থাকলে নিয়ে আসবো”। কিছু মানুষ থাকে মাতব্বরি এনজয় করে, কাকলি হলো সেই টাইপ।
পাত্রী পছন্দ না হলে খুব বিপদ। “না” ডেলিভারি করাটা খুব কঠিন। কত্তো যে সুন্দর করে কভার পড়াতে হয়। তারপরও পরিবারে এমন একজন থাকবে যে অতিরিক্ত মাত্রায় পজিটিভ, যে কোনো সমস্যাতেই সমস্যা দেখবেনা।
রায়হান যদি বলে মেয়ের বয়সটা একটু কম লাগে না, সে বলবে মেয়েদের বয়স কম থাকাই তো ভালো। রায়হান যদি বলে মেয়ের কথা বলাটা ক্ষ্যাত ক্ষ্যাত, সে বলবে বিদেশে তো বাংলা বলবেনা। রায়হান যদি বলে মেয়ের মনে হয় অন্য কাউকে পছন্দ, কেমন মন খারাপ করে ছিলো। সে বলবে, ওর মন ভালো করার দায়িত্ব তো এখন থেকে তোমার।
এইসব অতি চালাক ম্যাচ মেকারদের কবল থেকে মুক্তি পাওয়া মোটেও সহজ না।
এর আগেরবার একটা মেয়ে বেশ পছন্দ হয়ে গেলো। মা আর আব্বা গিয়ে আংটি কিনে আনলো। এন্গেজমেন্টের তারিখ ঠিক হলো, আপা তার পুরো পরিবার নিয়ে হাজির। মেয়ের জন্য টুকটাক কেনাকাটাও করা হলো। মেয়ের বাবা প্রস্তাব দিলেন আগে বিয়ের মোহরানা নিয়ে কথা বলতে চান। সবাই বললো ঠিক আছে। রায়হানের মনে হলো মেয়েটা জানি কোথায় ইনসিকিউরড ফিল করছে, তার উপর ভরসা রাখতে পারছেনা। বিয়ের আগেই বিচ্ছেদ নিয়ে বিচলিত। মানা করে দিলো।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে কিছুক্ষণ ফোনে পেপার পড়লো রায়হান। তারপর ফোনটা টেবিলে রাখতে গিয়ে খেয়াল করলো কাকলির সিভিটা। কবে যেন মা রেখে গেছিলো, দেখা হয়নি। দুপুরে বের হবার আগে ফোন নম্বরটা সেভ করে নিয়েছিলো। ইনকেস যদি কল দিতে হয়।
সিভিটাতে কাকলির স্কুল কলেজের নাম। নাহ, বয়জ স্কুলে যায়নি, এমনকি কো এডুকেশনেও না। স্ট্রেন্জ! ইউনিভার্সিটিতে খালি কো এডুকেশন। আচ্ছা এমন শক্ত একটা মেয়ের বায়োডাটা দিয়ে বিয়ে করানোর ব্যাপারটা জানি কেমন কেমন লাগেনা !
রায়হানের এই এক সমস্যা। পাত্রী দেখলেই খুঁত বের করে। মনে হয় এই ছুটিতেও পাত্রী পাবে না।
কি মনে করে কাকলির নম্বরটায় হোয়াটসএপ টেক্সট করলো।
– ধন্যবাদ ট্রিট দেবার জন্য।
তারপর তিন বিন্দুর নৃত্য দেখার জন্য অপেক্ষা করতে করতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লো।
৩.
… কাল অনেক রাতে ম্যাসেজ দেখেছি। তাই উত্তর দিতে দেরী হলো।
… সমস্যা নাই।
… নাস্তা করেছেন?
… হুমম
… উইকেন্ডে কি করবেন?
… আপাতত নাস্তা করার পর আবার ঘুম পাচ্ছে। তীব্র কফির অভাব বোধ করছি। দুধ চা আমার হজম হয়না।
… এমনি দেশে আসলে নিশ্চই অনেক ব্যস্ততা থাকে?
… না, তেমন না। আপনার শিডিউল কি?
… কিছু না। শুক্রবারে বাসায় দুপুরের খাবার আয়োজন থাকে, সবাই বাসায় থাকে। বিকালে ছবি আঁকতে যাই, মানে শিখতে যাই। তাও প্রতি শুক্রবার না।
… আপনি ছবি আঁকেন?! স্ট্রেন্জ!
… স্ট্রেন্জ কেন?
… তাইকোয়ান্ডো লেসনে যান সেটা হলেও মানাতো।
… হাসির ইমোজি
… আজকে বিকালে ছবি না আঁকলে হয়না?
… আজকের সাবজেক্ট হলো শ্যাডো এন্ড শেডস। ভীষণ ইম্পর্টেন্ট।
… আচ্ছা ছবি আঁকা শেখেন কেন?
… তা তো জানিনা, রঙ তুলি নিয়ে কাজ করতে ভালো লাগে।
… গান পারেন?
… পাত্রী দেখা তো কাল শেষ হয়ে গেছে, নাচ-গানের কথা তো কাল জিজ্ঞেস করেননি।
… হুমম। কাল অনেক কিছুই জানতে ইচ্ছা হয়নি। আজ হচ্ছে। এক্সট্রা টাইম কি পাওয়া যাবে? পরীক্ষার হলের মত? যেহেতু পরীক্ষা শুরু হতে দেরী হয়েছিলো কাল।
… যাবে।
… আপনার আর্টস্কুলের ঠিকানা দিন আর কখন শেষ হবে বলুন। আমি পৌঁছে যাবো।
… আচ্ছা। শর্ত আছে, রিক্সায় আসবেন। আমি অনভিজ্ঞ ড্রাইভারের গাড়িতে উঠিনা।
… আচ্ছা। তবে আমারও একটা শর্ত আছে।
… কি?
… আমার সাথে ডিনার করতে হবে।
… খাওয়ানো কাটাকাটি করতে চান?
… হুমম।
… ঠিকাছে, আমি আর্ট স্কুলের লোকেশন টেক্সট করছি। দেখা হবে।
রায়হান খেয়াল করলো কাকলির সাথে তার কমিউনিকেশনে কোনো সমস্যা হয়না। মেয়েটার মধ্যে একটা প্রাকৃতিক ভাব আছে। চব্বিশ ঘন্টাও হয়নি কাকলির সাথে তার পরিচয়, অথচ কথা বলতে জড়তা লাগছেনা।
সব ঠিক আছে কিন্তু কাকলির ওজনটা আরেকটু কম হলে ভালো হতো। ইদানিং তো কাউকে এসব বলা যায়না। মোটারা “বডি শেমিং” বলে একটা বেশ ডিফেন্সিভ টার্ম বের করেছে, কিছু বলতে গেলেই সেটা দিয়ে ধরাশায়ী করে ফেলে।
এসব ভাবতে ভাবতে নিজেকে আলমারির আয়নায় একবার সামনা সামনি একবার সাইড থেকে চেক করে নিলো। মা যেভাবে সকাল সকাল বউয়া, ডিম ভাজি, গরুর মাংসের লেফট ওভার খাওয়াছে তাতে কাকলির সাথে ম্যাচ হয়ে যাবে।
একবার বিছানায় একবার সোফায় একবার মা’র বিছানায় শুয়ে যখন আর ভালো লাগছিলোনা তখন সিদ্ধান্ত নিলো আব্বার সাথে জুম্মার নামাজে যাবে। গোসল করে পরিষ্কার গেন্জি পরে জিনসের পা টা ফোল্ড করে স্যান্ডেল খুঁজছিলো। আব্বা টুপি বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
– পান্জাবী আনোনি?
– না।
– কিনে নিও।
– পরিনা, পান্জাবী পরতে ভালো লাগেনা।
– কবে থেকে?
– আব্বা চলোতো!
ছবি আঁকতে বসে কাকলি প্রথমে মনোযোগ দিলো এলবামে। রফিক স্যার তিনটা পছন্দ মত ছবি আনতে বলেছিলেন। কাকলির পছন্দের প্রথম ছবিটা হলো গ্রামের একটা পানা পুকুর, তিনটে কচুরিপানার ফুল ফুটে আছে। সেই ফুলের ছায়া পানিতে দেখা যাচ্ছে। দ্বিতীয় ছবিটা হলো একটা শালবনে রোদ আর ছায়ার খেলা। তিন নম্বর ছবিটা তার দাদির। বিছানার ওপর সাদা শাড়ি পরে বসে আছে দাদি, উল্টো দিকের জানালা থেকে আলো এসে দাদির মুখে পড়েছে।
রফিক স্যার ছবি তিনটা দেখে বললেন দাদির ছবিটাকে স্ক্রীনে প্রজেক্ট করতে। বাকি ছবি দুটোতে কমপ্লেক্স শ্যাডো, প্রথম দিনের জন্য একটু কঠিন হবে। আজকে ফেশিয়াল এক্সপ্রেশন আর স্কিন শ্যাডো ট্রাই করা যেতে পারে।
রফিক স্যারের নির্দেশ মত কাকলি প্যালেটে রং নিলো। স্যার বলে দিলেন উইন্ডসর-নিউটন মিডিয়াম নিতে, কারণ ওটা দ্রুত শুকায়। স্কীন শ্যাডো করতে হলে রঙের উপর রঙের প্রলেপ দিতে হবে, না শুকালে ফিনিশিং ভালো হবেনা।
কাকলিকে আল্ট্রা মেরিন ব্লু আর আইভোরি ব্ল্যাক নিতে দেখে স্যার বিচলিত হলেন। তারপর চোখ বন্ধ করে বলে চললেন,
– মানুষের ত্বকের রঙের মূল উপাদান হলো লাল আর সবুজ। ওখানে কালো বা নীলের ভূমিকা নেই। সাহিত্য বলে মানুষ ব্যাথায় নীল হয়ে যায়, আর দুঃখের কালো ছায়া মুখে পড়ে। কিন্তু শিল্পীর তুলিতে তা ফুটে ওঠে অন্য ভাবে। ত্বক তো উষ্ণ, কালো বা নীল হলো শীতল রং। আমি বলি তুমি প্যালেটে রং নাও। বাম থেকে ডানে ভিরিডিয়ান গ্রীন, তারপর ক্যাডমিয়াম রেড, তারপর ওকরা ইয়েলো এবং সব শেষে টাইটেনিয়াম হোয়াইট। তারপর রংয়ের সাথে রং মিশাও।
কাকলি প্রথমে পেন্সিল স্কেচ করে ব্যাকগ্রাউন্ড ওয়াশ দিলো। খুব মনোযোগ দিয়ে দাদির ছবিটা বার বার দেখে বোঝার চেষ্টা করছিলো কতগুলো শেড তার লাগতে পারে। প্যালেটে রং মেশাচ্ছে এমন সময় স্যারের বাসার কলিংবেল বেজে উঠলো। স্যার দরজা খুলতে গেলেন।
– কাকে চাই?
– কাকলি, ওর কাছে এসেছি।
– কিন্তু ও তো এখনো শেষ করেনি। কাজ করছে। শিল্পীর একাগ্রতা হলো তপস্যার মত। ওখানে ব্যাঘাত করা মানে ধ্যান ভঙ্গ করা। তা তুমি কাকলির কি হও?
– বন্ধু।
– কতদিনের পরিচয়? আমার কাছে কাকলি বেশ অনেকদিন যাবৎ ছবি আঁকতে আসে। তোমাকেতো কখনো দেখিনি।
– আমাদের অল্প দিনের পরিচয়।
– তুমি ভেতরে এসে বসতে পারো। আর কাকলির ছবি আঁকা দেখতে চাইলে স্টুডিওতেও বসতে পারো।
– না ঠিকাছে, আমি এখানেই অপেক্ষা করি।
– কফি দিতে বলবো?
– জ্বি, খেতে পারি।
কাকলি রং মেলাতে মেলাতে খেয়াল করলো দু’টা টেক্সট। চমকে ঘড়ির দিকে তাকালো। তারপর স্টুডিও থেকে বের হয়ে দেখে রায়হান কফি খাচ্ছে আর পা নাচাচ্ছে। কাকলিকে দেখে যেন স্বস্তি পেলো।
রফিক স্যারের বাসা থেকে বের হয়ে একটা রিক্সা নিলো ওরা। এবার রায়হান কথা শুরু করলো
– আপনার আর্ট টিচার তো বেশ জাঁদরেল।
– হুমম, স্যার চারুকলার শিক্ষক ছিলেন।
– তাইইই, উনিতো মানুষের এনাটমি ভালো বুঝেন না। বসার ঘরে কয়েকটা ছবিতে দেখি ইয়া বিরাট বিরাট মাথা ওয়ালা লোক।
– হুমম, ছবিতে তো গল্প থাকে, বড় মাথারও গল্প আছে।
– কিজানি, আমি ছবিটবি বুঝিনা।
– কি বোঝেন, পাত্রীর গুণগত মান?
– নাহ্, সেটাও বুঝিনা। বাসায় কিছু করার থাকেনা। তাই পাত্রী দেখে সময় কাটাই।
– আপনার বন্ধু-বান্ধব নেই?
– দেশে কম, কে কোথায় আছে তাও জানিনা।
– হুমম।
– আপনি আমাকে কোথায় নিয়ে যাবেন ডিনারে?
– জটিল প্রশ্ন। আচ্ছা রিক্সায় একটু ঘুরি, তারপর যখন ক্ষুধা লাগবে তখন খুঁজবো।
৪.
কাকলির সাথে রিক্সায় ঘুরতে খারাপ লাগছেনা। অনেক রকম গল্প হচ্ছে। কোনো কোনো গল্পের কোনো দরকার নেই, তবুও কথার ছলে ঢুকে পড়ছে।
রায়হান কাকলিকে বললো তার সম্বন্ধে যদি কিছু জিজ্ঞেস করার থাকে তাহলে যেন নির্দ্বিধায় প্রশ্ন করে। কাকলি জানিয়ে দিলো আপাতত নেই। রায়হান অবাক হলো,
– আমি কিন্তু প্রশ্ন ধরবো, ফেল করলে নম্বর কাটা যাবে।
– যাক কাটা, ফেল করলে কি আমি একা করবো? আপনিও তো করবেন। এটা তো আমাদের যৌথ পরীক্ষা।
– কাকলি শোনেন, কাল আমি পাত্রী দেখতে এসেছিলাম। আজ কিন্তু সেজন্য আসিনি। কেন এসেছি আমি জানিনা। তবে আপনার সাথে আমার বিয়ে নাও হতে পারে।
– এই প্রশ্ন কমন পড়েছে, এই ভাব সম্প্রসারণ আমার মুখস্ত ছিলো। বকুল ফুপি বলেছে আপনি অনেক পাত্রী দেখেছেন, পছন্দ হয়নি। এখন ঐ যে রাস্তার পাশে লোকটা বন্ধুক দিয়ে বেলুন ফুটানোর বোর্ড নিয়ে দাঁড়ানো ওখানে রিক্সা থামাতে বলেন, আমি হাত সই করবো।
– পাগল নাকি? এসব বাচ্চামো নট এলাউড।
– কোথায় নট এলাউড?
– আপাতত রাস্তায়। এই যে রিক্সাওয়ালা ভাই, সামনের ঐ খাবারের দোকানের পাশে রাখবেন।
রায়হানের গতরাতে ঘুম হয়নি। কাল এত ক্লান্ত ছিলো যে বাসায় ফিরে সোফায় ঘুমিয়ে পড়েছিলো। ঘুম ভেঙে দেখে রাত সাড়ে এগারোটা। ড্রেস চেন্জ করে হাতমুখ ধোয়ার পর ঘুম উধাও।
এক কাপ চা নিয়ে ল্যাপটপটা খুলে বিছানায় বসে প্রথমে মেইল চেক করলো। তেমন কিছু নেই। প্রোমোশনাল মেইলগুলো রায়হান রেগুলার মুছে ফেলে। আনরীড মেইলের সংখ্যা দেখতে ভালো লাগেনা তার। যে কোনো রেড এলার্টে রায়হানের এলার্জি আছে, একটা চাপা বিরক্ত তৈরী করে।
রায়হানের ফেসবুক একাউন্ট নেই। নেই বললে ভুল হবে। আছে, কিন্তু কোথায় আছে সে জানেনা। তার মনে হয় এ পৃথিবীতে যা কিছু কন্টিনিউয়াস এটেনশন দাবী করে তা তার জন্য অনুপযোগী। রায়হান মূলত অলস শ্রেণীর লোক। কিছু নিয়ে লেগে থাকতে বিরক্ত লাগে বলে স্টুডেন্ট লাইফ থেকেই সময়ের আগেই লেখাপড়া শেষ করে রাখতো। ডেড লাইন জিনিসটাকে সে যার পর নাই ঘৃণা করে। লোকে এটাকে ভুল ভাবে, মনে করে সিরিয়াসনেস। আসলে সিরিয়াস হলে রায়হানের জীবন হয়তো অন্য রকম হতো।
কিছুক্ষণ ব্রাউজ করে, খবর দেখে, নেটফ্লিক্সে ডকুমেন্টারী দেখে আবার একটু তন্দ্রা এলো। তারপর আবার হঠাৎ অস্বস্তিতে ঘুম ভেঙ্গে গেল। বিরক্ত নিয়ে ওয়াশরূমে গেল। তারপর আবার কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ। ভোরের শীতল বাতাসে কেবল চোখের পাতা ভারী হয়ে এসেছে এমন সময় একের পর এক মসজিদ থেকে আযান ভেসে আসতে লাগলো। আব্বা ওয়াশ রূমে গেলেন, তার চটির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। নামাজ শেষ করে মা’কে ডাকছেন, “কোহিনূর, উঠতে পারবা? তোমার জন্য কুসুম গরম ওযুর পানি রাখছি, ঠান্ডা হয়ে যাবে।”
রায়হান তার বাবা-মা’র কনিষ্ঠ সন্তান। এ জীবনে আব্বা-মা দু’জনকে একলা কল্পনা করতে পারেনা, কখনও দেখেনি। আব্বা খুব অর্গানাইজড, আর মা নরম। রায়হান মনে হয় তার মায়ের ধাঁচ পেয়েছে, দেখে মনে হয় কোনো চাহিদা নেই, সরল জীবন। আসলে মন মত না হলে কোনো কিছুতেই আগ্রহ দেখাতে পারেনা।
সেদিন ঘুম থেকে উঠতে রায়হানের এগারোটা বাজলো। নাস্তা করে আব্বার সাথে ব্যাংকে গেলো। আব্বা বিল দিলেন, ফেরার পথে একটু বাজারে গেলেন। রায়হান গাড়িতে বসে থাকলো, চোখ বন্ধ করে রাখলো খানিকক্ষণ।
দুপুরের পর ক্যাজুয়াল লুক নিয়ে রিক্সায় উঠে বসলো। দুইবার রিক্সা বদলে কাকলির অফিসে। রিসিপশনে জিজ্ঞেস করে জানলো কাকলি অফিস আসেনি। মনটা আশংকায় ছেয়ে গেলো। কাল ওকে ওরকম একটা বাজে রেস্টুরেন্টে খাওয়ানো মোটেই ঠিক হয়নি। নিশ্চই সিক হয়ে গেছে। তারপর নিজের পেটে একটা টোকা মেরে দেখলো, নাহ এই পরিচিত পেট তো অপরিচিত জীবানুতে রিয়্যাকশন দেয়নি।
হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি খেলে গেলো, কাকলিকে বাসায় দেখতে গেলে কেমন হয়। অসুস্থ শরীরে রায়হানকে দেখলে ওর মনটা কি একটু ভালো লাগতে পারে? হুমম, লাগবে।
কাকলীর জন্য ফুল নিয়ে যাওয়াটা সিলি হবে। কি নেয়া যায়? ধুর, কিচ্ছু নিতে হবেনা। একটা গাছ নিলে কেমন হয়, খুব ছোট একটা গাছ? পানি টানি কম দিলেও চলে এমন গাছ? দেশে কোনো গাছের দোকান নেই। যেগুলো আছে সেগুলো নার্সারী, এখন কোথায় আবার নার্সারী খুঁজতে যাবে।
বেল চাপতেই যিনি দরজা খুললেন তিনি সম্ভবত কাকলির ভাবী। এরা যৌথ পরিবার। কাকলির বড় ভাই তাদের পারিবারিক ব্যাবসা দেখাশোনা করে, মোটর পার্টসের সোল ডিস্ট্রিবিউটর, বনেদী ব্যবসা। গতকাল রাত্রে রায়হান কাকলির সিভি থেকে জেনেছে যে ওরা দুই ভাই-বোন।
ভাবীকে পরিচয় দিলো রায়হান, ভাবী চিনলেন। তারপর অস্বস্তিতে গায়ের ওড়নাটা ঠিকঠাক করে মাথায় কাপড় দিলেন। ভাবীর ব্যস্ততা দেখে রায়হান নিজেই অস্বস্তিতে পড়ে গেলো। কাজের মেয়ে দুইটা পর্দার আড়াল থেকে হাসিমুখে উঁকি দিচ্ছিলো। ভাবী বললেন, আপনি একাই আসলেন, আপনার বাবা-মা আসলেন না?
– না, আমি কাছেই এসেছিলাম, ভাবলাম কাকলির সাথে দেখা করে যাই। ওর কি অফিস থেকে ফিরতে দেরী হবে?
– না, কাকলিতো ছুটি নিয়েছে দুই দিন। ওর খুব কাছের বান্ধবীর আজ গায়ে হলুদ। স্কুলের বন্ধু। সবাই আজ রাতে একসাথে গল্পটল্প করবে। ফিরতে একটু রাত হবে হয়তো।
রিক্সায় করে বাসায় ফিরতে ফিরতে রায়হানের খুব রাগ হলো, অসম্ভব রাগ। কাল এতক্ষণ একসাথে গল্প করলো, একটা বারের জন্যও তো বললোনা আজ অফিস যাবেনা। ফোন থেকে কাকলির নম্বরটা মুছে দিলো আর হোয়াটস এপে ব্লক।
৫.
রায়হানের আজ গায়ে হলুদ, আগামীকাল শুক্রবার বাদ আসর আক্বদ। রায়হান পান্জাবী পরে ডান হাতের অনামিকা আর কড়ে আঙ্গুলে মেহেদী দিয়ে ঘুরঘুর করছে। মেজাজ একটু আগে বেশ খারাপ ছিলো, এখন স্বাভাবিক।
সকাল থেকে বাসার মধ্যে মানুষ জনের চলাচল বেড়ে গেছে। খুব নিকট আত্মীয়রা আশেপাশেই থাকেন, উনারা কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবেন। আপা সুনায়রাকে নিয়ে গতকাল চলে এসেছে, দুলাভাই একটু আগে এসে পৌঁছেছেন। এখন আয়েশ করে ডাইনিং টেবিলে বসে পরোটা দিয়ে কলিজা ভুনা খাচ্ছেন। মাঝে মাঝে রায়হানকে খোঁচাচ্ছেন।
– রাহান, একে বলে জামাই আদর। দেখছো আম্মা আমার জন্য রসমালাই আনায় রাখছেন। এরপর তোমার সাথে আমার কম্পিটিশন হবে। দখবোনে কার শ্বাশুড়ি ভালো, তোমার না আমার।
রায়হানের ডাক নাম রাহান। অলস বাঙালীর কাজ, সব কিছুর শর্টকাট চায়। কষ্টই যদি কম করবি তাহলে স্মার্টলি সব কিছু প্ল্যান করলেই হয়। এই যেমন আপাকে গতকাল শপিংএ যাবার আগে পই পই করে বলেছিলো ফিতা আলা পায়জামা না আনতে, ঠিক সেটাই এনেছে। বলে, চুড়িদার নাকি ইলাস্টিক সিস্টেম হয়না। এখন আবার গেছে বদলাতে।
আব্বা সকাল থেকে বাজার, খাওয়া-দাওয়া, গাড়ি এসব নিয়ে ছুটাছুটি করছে। অনেকবার বলা হলো বাইরে থেকে রেডিমেড খাবার অর্ডার দিতে, শুনলোনা। বাসার কেউ রাজি না, কারও নাকি অর্ডারের খাবার মজা লাগেনা । আর বাসার শেষ বিয়ে, অল্প গেস্ট, মেহমানদারী নিয়ে যেন অভিযোগ না থাকে।
দুলাভাই খাওয়া শেষ করে আবার রায়হানের পেছনে।
– তোমার ফ্লাইট কবে রাহান?
– বুধবার রাতে দুলাভাই।
– দেশে এসে তিন সপ্তাহ শুধু মেয়েই দেখলা, এখন যাবার আগে বিয়ে। টিকেট পেছানো গেলোনা?
– লাভ কি, যেতে তো হবেই।
– কালকের জন্য কমপ্লিট না শেরওয়ানি অর্ডার দিছো?
– আপনার মাথা খারাপ দুলাভাই! সং সেজে বিয়ে করতে যাবো?
– পরবা কি তাহলে?
– চিন্তা কইরেন না, খালি গায়ে যামুনা।
আত্মীয় স্বজনে বাসা মোটামুটি ভরে গেছে ততক্ষণে। কাজিন-নিস-নিফিউ, চাচী-মামী-খালা। কাচ্চির ঘ্রানে চারিদিকে মো মো করছে। সেটা ছাপিয়েও কাঁচা ফুলের মিষ্টি শীতল একটা সুবাস হলুদের স্টেজের আসে-পাশে। কেউ একজন হাল্কা করে গান বাজিয়ে রেখেছে, আরেকজন সেটা মাথা ধরার দোহাই দিয়ে বন্ধ করে দিয়ে গেলো।
বকুল খালাম্মা এসেছেন। রায়হানের মা’কে জড়িয়ে ধরে কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, কোহিনূর তোকে আমি বলছিলাম, রাহানের মেয়ে পছন্দ হইবো। ঐ মেয়ে ওগো বাসার প্রাণ।
মা রায়হানের দিকে তাকালেন, রায়হান না দেখার ভান করে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। গত তিনদিনে কত রকম তাল বেতাল যে ছেলেটা করলো তা বকুলকে কি করে বলবে। খায়না, কথা বলেনা, গোসল করেনা। শেষ মেষ বলে কাকলিদের বাসায় যাও তোমরা।
বকুল খালাম্মার কাছে খবর পাওয়া গেল কাকলিদের বাসা থেকে তত্ত্ব আসছে। তিনটা ডালা আসলো আর অনেক মিষ্টি। সাথে এক টুকরি ফল। যিনি এসব নিয়ে আসলেন তিনি একটা সোনালী-রূপালী হ্যান্ডমেড পেপার বক্স আপার হাতে দিয়ে বললেন এটা রায়হান ভাইয়ের জন্য।
রায়হান প্যাকেট খুলে দেখে দু’টা টিশার্ট। একটা সাদা আর একটা কালো। দু’টার বুকেই রেক্ট্যাঙ্গুলার শেপে হ্যান্ড পেইন্ট করা। একটা টেরাকোটার মত আর আরেকটা পেন এন্ড ইংক টাইপের। সাথে ছোট্ট একটা চিরকুট।
“আব্বু আর ভাইয়া কাল আপনার জন্য শেরওয়ানি কিনে এনেছে। জানি আপনার পরতে ভালো লাগবেনা। এই টিশার্ট দু’টো আমার হাতে করা। শেরওয়ানির বদলে এটা পরে আসলেও মন খারাপ করবোনা।”
রায়হান হন্ত-দন্ত হয়ে বসার ঘরে গিয়ে ডালা খুলতে বললো। একটা মেরুণ ব্রোকেডের উপর কালো সিল্কের বর্ডার দেয়া শেরওয়ানি। গলার কাছে তিন লহরী পার্লের মালা। সবাই হাসি চেপে রায়হানের দিকে তাকালো। রায়হান বললো, খারাপ নাহ, আপা গলার মোতির মালাটা কেটে বাদ দেয়া যায় কিনা দেখতো।
শুক্রবার আছরের পর পরই ওরা রওনা হলো। সবাই মিলে বিশ বাইশ জন। কাজি সাহেব বিয়ে পড়ানোর জন্য কাগজে সব নাম টাম ঠিক করে লিখছেন। মোহরানা লিখেছেন পঞ্চাশ লাখ টাকা। দুলাভাই কিছু বলতে চাচ্ছিলেন, রায়হানের বাবা ছেলের দিকে তাকালেন। রায়হান বললো সমস্যা নাই।
আক্বদ হয়ে গেলো। এবার বাসায় ফেরার পালা। রায়হানকে শ্বশুর বাড়িতে রেখে দেবার গুন্জন শোনা গেলো। রায়হান তার আব্বাকে বললো সে আর মাত্র তিন দিন দেশে আছে। কাকলিকে এমেরিকা নিয়ে যাওয়ার প্রসেসটাতো খুব জটিল। সে চায় ফিরে যাবার আগে কাকলির সাথে তাদের কিছু সুন্দর পারিবারিক সময় কাটুক।
রায়হানের বাবা কাকলির বাবাকে বুঝিয়ে বললেন। কথা দিলেন রায়হান চলে গেলে কাকলিকে তিনি নিজে এসে দিয়ে যাবেন। তাঁর বাসায় কাকলির কোনো অযত্ন হবেনা।
কান্নাকাটির পর্ব শেষ করে কাকলিকে নিয়ে তার শ্বাশুড়ি গাড়ির দিকে গেলেন। সামনের সীটে ড্রাইভারের পাশে রায়হানের বাবা। কাকলির পাশের সীটটা ফাঁকা। রায়হান পেছনে উঠলোনা, কাকলির দিকে একটু তাকালো। তারপর ড্রাইভারকে বললো,
– আপনি দেখেন ঐ মাইক্রোতে জায়গা আছে হয়তো। আমি নিজে ড্রাইভ করবো।
ফারজানা সুমি, হেলসিংকি, ফিনল্যান্ড।