মেলবোর্ন, ১১ মে- ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি ঘোষণার মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরই একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরতির ‘লঙ্ঘন’ করার অভিযোগ এনেছে। এই যুদ্ধবিরতি এসেছে টানা চার দিনের সীমান্ত উত্তেজনা ও গোলাগুলির পরে, যা বিগত কয়েক দশকের মধ্যে দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে অন্যতম তীব্র সামরিক মুখোমুখি সংঘর্ষ।
বিস্ফোরণের শব্দ, পাল্টা অভিযোগ
ভারতশাসিত কাশ্মীরের শ্রীনগর ও জম্মু শহরে শনিবার রাতেই বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে বলে স্থানীয় বাসিন্দারা ও বিবিসির সংবাদদাতারা জানিয়েছেন। আকাশে আলোর ঝলকও দেখা গেছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রী বলেন, “গত কয়েক ঘণ্টায় বারবার আমরা যে বোঝাপড়ায় এসেছিলাম তার লঙ্ঘন ঘটেছে। আজ সন্ধ্যায় আমরা যে সমঝোতায় পৌঁছেছিলাম, এটি তার সরাসরি লঙ্ঘন।” তিনি জানান, ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী যথাযথ জবাব দিচ্ছে এবং পাকিস্তানকে আহ্বান জানিয়েছেন যাতে তারা এই লঙ্ঘনের বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়।
পাকিস্তানের পাল্টা প্রতিক্রিয়া
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র জানান, “আজ ঘোষিত যুদ্ধবিরতির প্রতি পাকিস্তান আন্তরিকভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যদিও কিছু এলাকায় ভারতের দ্বারা লঙ্ঘন হচ্ছে, তবুও আমাদের বাহিনী দায়িত্বশীলতা ও সংযমের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে।”
তিনি আরও বলেন, “যুদ্ধবিরতির সুষ্ঠু বাস্তবায়নে কোনো সমস্যা থাকলে তা দুই দেশের মধ্যে উপযুক্ত পর্যায়ে যোগাযোগের মাধ্যমে সমাধান হওয়া উচিত। স্থলসীমান্তে থাকা সেনারাও যেন সংযম প্রদর্শন করে।”
সংঘর্ষের পটভূমি
উল্লেখযোগ্য যে, গত ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পহেলগামে এক ভয়াবহ জঙ্গি হামলায় ২৬ জন পর্যটক নিহত হন, যার মধ্যে ২৫ জন ভারতীয় এবং একজন নেপালি নাগরিক ছিলেন। ভারত দাবি করেছে, হামলাকারীরা হিন্দু পুরুষদের লক্ষ্যবস্তু করছিল। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ভারত পাকিস্তান ও পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরে ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র ও আর্টিলারি দিয়ে হামলা চালায়।
পাকিস্তান তাদের ভূখণ্ডে হামলার অভিযোগ অস্বীকার করে। পাকিস্তানের দাবি, ভারতীয় বাহিনীর বিমান হামলা ও সীমান্ত গোলাগুলিতে পাকিস্তান ও পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে মোট ৩৬ জন নিহত হয়েছে। অন্যদিকে, ভারতের সেনাবাহিনী জানিয়েছে যে পাকিস্তানি গোলাবর্ষণে কমপক্ষে ২১ জন ভারতীয় বেসামরিক নাগরিক মারা গেছে।
যুদ্ধবিরতি ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
এই উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যেই শনিবার সকালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে ঘোষণা করেন, ভারত ও পাকিস্তান তাৎক্ষণিক ও পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় সম্ভব হয়েছে।
পরে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, এই সমঝোতা বাস্তবায়নে ‘তিন ডজনেরও বেশি দেশ’ কূটনৈতিকভাবে যুক্ত ছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেন, ভারত ও পাকিস্তান একটি নিরপেক্ষ স্থানে একটি বিস্তৃত আলোচনার জন্য সম্মত হয়েছে। তিনি জানান, তিনি এবং মার্কিন ভাইস-প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স, উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে গত ৪৮ ঘণ্টা ধরে নিবিড় আলোচনায় ছিলেন।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, “সংঘাত নিরসনে সব প্রচেষ্টাকে আমরা স্বাগত জানাই।”
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমার বলেন, “আমরা কয়েক দিন ধরেই এই আলোচনা প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। আজ যুদ্ধবিরতির ঘোষণায় আমি সন্তুষ্ট। এখন কাজ হলো, একে স্থায়ী ও কার্যকর করে তোলা।”
দুই দেশের অবস্থান
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর বলেন, “দুই দেশ আজ অস্ত্রবিরতির বিষয়ে একটি বোঝাপড়ায় পৌঁছেছে। ভারত সবসময় সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কঠোর ও আপসহীন অবস্থান বজায় রেখেছে এবং তা বজায় রাখবে।”
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ এক জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে বলেন, “এই যুদ্ধবিরতি সবার মঙ্গলের জন্য হয়েছে। আমরা চাই এই শান্তি স্থায়ী হোক।”
কাশ্মীর—চিরাচরিত বিরোধের কেন্দ্র
কাশ্মীর অঞ্চল ভারতের এবং পাকিস্তানের উভয় দেশের দাবির বিষয়, তবে উভয় দেশই অঞ্চলটির কিছু অংশ পরিচালনা করে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটেন থেকে স্বাধীনতার পর অঞ্চল বিভাজনের সময় থেকেই কাশ্মীর দুই দেশের মধ্যে দ্বন্দ্বের মূল কেন্দ্রবিন্দু। এ নিয়ে তারা দুটি যুদ্ধেও জড়িয়েছে।
এখন প্রশ্ন উঠছে, এই যুদ্ধবিরতি কতটা দীর্ঘস্থায়ী হবে, আর দুই পক্ষ কি সত্যিই শান্তির পথে এগিয়ে যেতে পারবে?
সূত্র: বিবিসি