মতামত- লেখা অভিমন্যু ফয়েজী
মেলবোর্ন ১১ মে- এই সরকারের সব কাজের মধ্যেই এক ধরনের মিথ্যাচার এবং দ্বিচারিতা কাজ করে। দেশের মানুষের জন্য কোন ভালো খবর এলেও এদের কুশীলবদের দেখা যায় পুরোটা নিজেদের কৃতিত্ব হিসেবে দাখিল করতে। এই প্রবণতাকে বলে “শাসনতান্ত্রিক কপটতা” (“Ruler Hypocrisy”)। ক্ষমতার কুশীলবদের কমবেশী এটি প্রয়োগ করতে হয়, কিন্তু বর্তমান সরকারের সময় এটি অনেকটাই সীমার বাইরে একটি ভিন্ন ধরনের রূপ নিয়েছে। এই ভন্ডামির একটি প্রকাশ হলো, ভালো জিনিসকে নিজেদের বলে দাবী করা, এবং খারাপ জিনিসকে প্রতিপক্ষের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া। এর আগে আরো বেশ কিছু ঘটনা এমন ঘটেছে। আজ আমরা কথা বলবো একেবারেই নতুন একটি বিষয়ে।
শাসনতান্ত্রিক কপটতা প্রকাশ করার জন্যও এক রকমের কপট বা ভন্ড মানুষ লাগে। বর্তমান প্রশাসনের এমন কয়েকজন কপটের একজন মাহফুজ আলম যাঁকে আবার বিগত আন্দোলনের মাষ্টারমাইন্ড মনে করা হয়। তো এই শাসনতান্ত্রিক ভন্ড আমাদের জানিয়েছেন যে, কয়েক দিন আগে “রিপোর্টার উইদআউট বর্ডার” নামের আন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তৃক সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বোঝাতে যে পরিমাপক বা ইনডেক্সটি ব্যবহার করা হয় সেটিতে বাংলাদেশ ২০২৫ এ ষোল ধাপ এগিয়েছে। খুব ভালো; আমরা আনন্দিত।
কিন্তু সমস্যাটি অন্য জায়গায়। সেটি একটু বলি।
ষোল ধাপ এগোনোর কারন হিসেবে এই ভদ্রলোক আমাদের জানাচ্ছেন (বাংলা ট্রিবিউন, https://www.banglatribune.com/national/896773/বিশ্ব–মুক্ত–গণমাধ্যম–সূচকে–১৬–ধাপ–এগিয়েছে), “…গণমাধ্যমে সরকারের হস্তক্ষেপ না থাকায় বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে এক বছরে ১৬ ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ।…গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগের কথা উল্লেখ করে উপদেষ্টা [মাহফুজ আলম] বলেন, বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ দেশের সব গণমাধ্যম এখন সরকারের প্রভাবমুক্ত। কোনও গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে সরকারের পক্ষ থেকে টেলিফোন করে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে না। দেশের গণমাধ্যমকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করতে সরকার ইতোমধ্যে বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের ১৬ ধাপ উন্নতি প্রমাণ করে— সরকার দেশের গণমাধ্যমকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করতে কাজ করছে।” অসাধারন! নয় কি? কিন্তু শুভঙ্করের ফাঁকিটি এরপরই আপনার দৃষ্টি আকর্ষন করবে।
আপনি যদি গবেষনা পদ্ধতি চর্চা করেন তবে আপনার মনে প্রথম প্রশ্ন যেটি জাগবে সেটি হলো, ২০২৫ সাল কি শেষ হয়েছে? মাত্রতো এপ্রিল মাস গেলো! এরপর উপাত্ত সংগ্রহ এবং এগুলোকে বিশ্লেষনোপযোগী করার জন্যও সময় লাগে। আপনি এও জানেন যে, এই পরিমাপকটি ব্যবহারে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার নামের প্রথিতযশা সংস্থাটি শুধু সংখ্যাতাত্ত্বিক নয়, গুনগত (কোয়ালিটিভ) উপাত্তও বিশ্লেষন করে। এই পুরো কাজটির জন্য প্রচুর সময় লাগে। সেক্ষেত্রে যেকোন পদ্ধতিবিজ্ঞানের চর্চা করা মানুষের মনে প্রশ্ন জাগবে, এঁরা যদি পুরো এপ্রিল পর্যন্তও ডেটা সংগ্রহ করেন তবে সেসব বিশ্লেষন করে চার মাসের ভিত্তিতে ২০২৫ এর জন্য ইনডেক্স স্কোর কিভাবে দিচ্ছেন যেটি আমাদের তথ্য উপদেষ্টা গর্বের সাথে আমাদের জানাচ্ছেন?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যেয়ে যা জানা গেলো (সংস্থাটির ওয়েব সাইটে তাঁদের গবেষনা পদ্ধতি দেয়া আছে), প্রতি বছরের ইনডেক্স প্রনয়নে সংস্থাটি তার আগের বছরের উপাত্ত বিশ্লেষন করে। সেক্ষেত্রে এটি পরিস্কার যে, এঁরা বাংলাদেশের জন্য ২০২৫ এর ইনডেক্স প্রনয়নে ২০২৪ এর উপাত্ত ব্যবহার করেছেন। তার মানে ২০২৫ এ ভালো ইনডেক্স স্কোরের জন্য ক্রেডিট যদি সরকারকে দিতে হয় তবে সেটি আওয়ামী লীগ এবং অন্তর্বর্তীকালীন উভয় সরকারের ভাগ করে নেয়ার কথা। কিন্তু মাহফুজ আলমের কথা শুনে মনে হলো, পুরো ক্রেডিটটি তাঁদের প্রাপ্য। এক্ষেত্রে মনে রাখা রাখা দরকার, আওয়ামী লীগ ২০২৪ এ বেশীর ভাগ সময় জুড়ে ক্ষমতায় ছিলো (৪ আগষ্ট)। তাহলে ২০২৪ এর বেশীর ভাগ সময় জুড়ে যারা ক্ষমতায় তাদের কোন ক্রেডিট না দিয়ে পুরোটা নিজেরা খেয়ে নিলেন? এ কেমন কথা?
মাহফুজের পক্ষে এটি একটি সম্ভাবনা হতে পারে যে, ২০২৪ এর সাত মাসে আওয়ামী লীগের পারফরমেন্স খুবই খারাপ ছিলো, কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের পারফরমেন্স সেই তুলনায় এতই ভালো ছিলো যে, প্লাস –মাইনাস করে বর্তমান স্কোরটি হয়েছে, এবং সে কারনেই এ স্কোরের পুরো ক্রেডিটটি বর্তমান সরকারের প্রাপ্য। এমন দাবীটিই মাহফুজ করেছেন। কিন্তু আবারো বলি, আপনি যদি পদ্ধতিবিজ্ঞানের মানুষ হন তবে আপনার মনে আসবে, বেশী ভালো ভালো নয়; ডাল কুছ কালা হ্যায়।
তো ডাল আসলেই কালা সেটি বোঝার অনেক উপায় আছে। আওয়ামী লীগের ২০২২ এবং ২০২৩ এর পারফরমেন্স আপনার সামনে আছে। এর ওপর ২০২৪ এ বাংলাদেশে সাংবাদিক নির্যাতন কিম্বা অন্যান্য সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও দমন পীড়নের কাহিনীও ওই রিপোর্টার উইদাউট বর্ডার এর বিশ্লেষক এবং আপনাদের সামনে আছে। একই ভাবে আগষ্ট পরবর্তী সময়ে মিডিয়াতে কী চলেছে তার তথ্যও তাঁদের কাছে আছে; মবজাস্টিজের শিকার হতে হয়েছে মিডিয়ার অনেক বড় পাওয়ার হাউজকে; একইসাথে আন্দোলন পরবর্তী সময়ে সাংবাদিকদের চাকরী হারানো, ইত্যাকার নানান্ খবর সংস্থাটির কাছে নিশ্চয়ই আছে।
তো এই চিন্তা থেকে আমি একটি বিশ্লেষন তৈরী করার চেষ্টা করলাম যে, আওয়ামী লীগকে যদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার থেকে আলাদা করা যায় তবে আসলে ২০২৪ এর চিত্রটি কী দাঁড়ায়? এটি করতে যেয়ে ফোরকাস্ট মডেল ব্যবহারের চিন্তাটি আমার মাথায় আসে। অর্থাৎ যদিও রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার তাদের মিডিয়ার স্বাধীনতা বিষয়ক স্কোরটি তৈরী করে বছর হিসেবে, আমি এআই এর সাহায্য নিয়ে চেষ্টা করেছি ফোরকাস্ট মডেল প্রয়োগের মাধ্যমে বের করা যে, ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তুলনামূলক অবদান কতটা ছিলো ২০২৫ এর ইনডেক্সটিতে।
সেই সাথে আমি ফোরকাস্ট মডেল ব্যবহার করে এটিও বুঝতে চেয়েছি যে, আওয়ামী লীগ এবং বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি আলাদাভাবে ২০৩০ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকে তবে সাম্প্রতিক পারফরমেন্সের ভিত্তিতে তাদের ২০২৪– ২০৩০ পর্যন্ত মিডিয়ার স্বাধীনতা বিষয়ক স্কোরগুলো কেমন হবে। চ্যাটজিপিটির সহায়তায় আমি এই দুটি বিশ্লেষন এখানে তুলে ধরছি।
চ্যাটজিপিটি প্রথমে বিভিন্ন তথ্যের একটি কালানুক্রম তৈরী করেছে, এবং তার ভিত্তিতে ২০২৪ সালে মাসওয়ারী হিসেব বের করেছে। এই কালানুক্রমিক বিবরন এবং তার সাথে জানুয়ারী থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত গনমাধ্যমের স্বাধীনতা বিষয়ক মাসভিত্তিক স্কোরটি তৈরী করেছে। এ বিষয়ে একটি বিশদ ফর্মুলা তারা দিয়েছে। নীচে ২০২৪ এর প্রতিটি মাসের হিসেব এবং অনেকগুলোর মধ্যে বিশেষ ঘটনা যেগুলো চ্যাটজিপিটি স্কোর নিরুপনে বিবেচনায় নিয়েছে তার একটি সারনী দেয়া গেলো (দেখুন সারনী ১)। আর স্কোরগুলোর উত্থান–পতন দৃষ্টিগ্রাহ্য করার জন্য আমরা একটি লাইনগ্রাফ প্রনয়ন করেছি। (দেখুন লেখচিত্র ১)।
সারনী ১: মাসভিত্তিক পূর্বাভাসকৃত স্কোর এবং গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা


সারনী ১ এবং লেখচিত্র ১ আমাদের বলছে, ২০২৪ এর জানুয়ারী থেকে জুলাই পর্যন্ত এই ইনডেক্সের অনুমিত স্কোরের গড় ছিলো ৩৪.২৪ যেটি অগাষ্ট থেকে ডিসেম্বরে এসে কমে গিয়ে হয় ৩৩.২৫। এই শেষের সময়ে (আগষ্ট থেকে ডিসেম্বর) কমে যাওয়ার কারনে গড়টিও কমে গিয়ে দাঁড়ায় ৩৩.৭১; অর্থাৎ যদি এই শেষের চার মাস এই স্কোর না কমতো তবে সেটি কম পক্ষে ৩৪.২৪ হতো, অর্থাৎ প্রায় এক পয়েন্ট বেশী স্কোর থাকতো বাংলাদেশের। এই বিষয়টি এখানে আমরা উপস্থাপন করলাম বর্তমান সরকারের যে সব কৃতিত্ত্ব নিজে নিয়ে নেয়ার প্রবনতা আছে সেটিকে চ্যালেন্জ করার জন্য।
এবার দ্বিতীয় বিষয়টিতে চোখ দেয়া যাক। লেখচিত্র ২ খুব চমৎকারভাবে আওয়ামী লীগ এবং বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পারফরমেন্স বিবেচনায় নিয়ে দুটো তুলনামূলক অনুমিত (এষ্টিমেটেড) লাইন তৈরী করেছে; এই লাইন দুটো দেখাচ্ছে আওয়ামী লীগ এবং অন্তর্বর্তীকালীন এ দুই সরকারের পারফরমেন্স কেমন হতে পারে যদি তারা আলাদাভাবে ২০৩০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ক্ষমতায় থাকে। চ্যটজিপিটি উভয় রেজিমের মাধ্যমে এর জন্য একই স্কোর (৩৩.৭১) ধরে নিয়েছে জানুয়ারী ২০২৪এ। এরপর এটি দেখাচ্ছে, বর্তমান ইন্টেরিম সরকার ২০৩০ এর জানুয়ারী পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকলে সেসময় এটি কমে ২৬ হয়ে যাবে যেখানে এই লাইনটির শুরু ছিলো ৩৩.৭১। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের লাইনটি পরিস্কারভাবে দেখাচ্ছে, আওয়ামী লীগ যদি তার সর্বশেষ পারফরমেন্স বজায় রাখতে পারে, তবে এই স্কোরটি ৩৩.৭১ থেকে বেড়ে ২০৩০ এর জানুয়ারীতে ৩৭এ উন্নীত হবে।

এটুকুই ছিলো আমাদের আলোচনার বিষয়। আমাদের কাজ হচ্ছে পাঠকের কাছে উপাত্ত তুলে ধরা। এরপর পাঠকই এই উপাত্তের ভিত্তিতে বিষয়টির ওপর তাঁর মতামত তৈরী করবেন।
লেখক, অভিমন্যু ফয়েজী, ভার্জিনিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
(উল্লিখিত মতামত লেখকের নিজস্ব, এবং প্রতিষ্ঠানের অবস্থান বা দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত করে না।)