মেলবোর্ন, ১৫ মে— চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধে আপাতত ক্ষান্ত দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ৯০ দিনের জন্য উভয় দেশই উল্লেখযোগ্য হারে শুল্ক কমিয়েছে। এতে ভারতীয়দের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে যে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ভারত থেকে চীনের দিকে মনোযোগ সরিয়ে নিতে পারেন। যার ফলে ভারতীয় শেয়ারবাজারে প্রভাব পড়তে পারে।
কেউ কেউ চীনে স্বল্পমেয়াদী মূলধন প্রবাহের আশঙ্কা করছেন, আবার কেউ কেউ ভারতের শক্তিশালী কাঠামোগত প্রবৃদ্ধি এবং নির্দিষ্ট বাণিজ্য গতিশীলতা থেকে বিচ্ছিন্নতার ওপর জোর দিচ্ছেন। ভারতের উৎপাদন প্রতিযোগিতার ওপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব এখনও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়।
ডোনাল্ড ট্রাম্প পূর্ণোদ্যমে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরুর করার পর ধারণা করা হচ্ছিল, বিশ্ববাণিজ্যে ভারত সুবিধা পাবে। কিছু বিনিয়োগ ভারতে আসতেও শুরু করেছিল। আইফোন নির্মাণকারী কোম্পানি অ্যাপল বলেছিল, এখন থেকে তারা ভারতেই বেশি উৎপাদন করবে। কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে বিনিয়োগ কমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
ভারতের গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের প্রতিষ্ঠাতা অজয় শ্রীবাস্তব মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র-চীন পারস্পরিক শুল্ক ৯০ দিনের কমাতে রাজি হওয়ায় এখন ভারত ও চীনের শুল্কহার প্রায় কাছাকাছি। ফলে ভারত বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে যে লাভজনক ‘চায়না প্লাস ওয়ান’ ব্যবহার করেছে, সেই কৌশল দুর্বল হয়ে যেতে পারে।
‘চায়না প্লাস ওয়ান’ কৌশলের আওতায় সাধারণত কোম্পানিগুলো চীনের বাইরেও অন্য দেশে বিনিয়োগ করার কথা ভাবছিল। শ্রীবাস্তব বলেন, এখন সেই সুবিধা অনেকটাই সংকুচিত হয়েছে, কারণ, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন পরস্পরের সঙ্গে উত্তেজনা কমিয়ে আনায় ভারত ও চীনের শুল্কহার প্রায় সমান হয়ে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের এই পিছু হটার মধ্য দিয়ে বিনিয়োগকারীদের জন্য বার্তাটি স্পষ্ট বলে মনে করেন শ্রীবাস্তব। সেটা হলো, ‘ওয়াশিংটন আবারও বেইজিংয়ের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হচ্ছে।’ গত সোমবার যুক্তরাষ্ট্র ও চীন একমত হয়েছে, তারা আগামী ৯০ দিনের জন্য পরস্পরের ঘোষিত পারস্পরিক শুল্ক ও পাল্টা শুল্ক প্রত্যাহার করবে। এতে দুই প্রধান বাণিজ্য অংশীদারের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা নাটকীয়ভাবে প্রশমিত হয়েছে।
এই সমঝোতার অংশ হিসেবে চীন যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে শুল্কহার ১২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশে নামাবে এবং যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যের শুল্ক ১৪৫ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রস্তাব দিয়েছে। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যে ২৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছিল।
শ্রীবাস্তবের মতে, এই পরিবর্তন ‘চায়না প্লাস ওয়ান’ কৌশলকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে, যে কৌশলের ফলে বহু কোম্পানি তাদের উৎপাদন ভারত, ভিয়েতনাম ও মেক্সিকোর মতো দেশে সরিয়ে নিচ্ছিল।
শ্রীবাস্তব আরও বলেন, যদিও স্বল্প বিনিয়োগের সংযোজন জাতীয় কারখানা আপাতত ভারতে থাকতে পারে, কিন্তু প্রকৃত শিল্পভিত্তিক গভীর উৎপাদন কার্যক্রম থেমে যেতে পারে বা আবারও চীনে ফিরে যেতে পারে। বিনিয়োগকারীরা যুক্তরাষ্ট্রের দিকনির্দেশনা পর্যবেক্ষণ করছে এবং ভারত প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা নিশ্চিত করতে না পারলে অনেকে ভারতে আসতে দ্বিধাবোধ করবেন।
২০২০ সালের কোভিড-১৯ মহামারিতে বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়। পরবর্তী সময়ে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা ও বিভিন্ন দেশের সুরক্ষা নীতি গ্রহণের ফলে অনেক আন্তর্জাতিক উৎপাদন সংস্থা তাদের কার্যক্রমে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করে। এর অংশ হিসেবে অনেকে ভারত, ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগের কথা ভাবছিল।
এই প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যাপী উদীয়মান সরবরাহ কেন্দ্রগুলোর দিকে নজর রাখছিলেন বিনিয়োগকারীরা। ফলে ভারতের মতো রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল ও বিশাল বাজারের দেশ উল্লেখযোগ্য বিকল্প হয়ে উঠছিল। সেই সঙ্গে আছে দেশটির বিশাল তরুণ শ্রমশক্তি।
শ্রীবাস্তবের পরামর্শ, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত বাণিজ্যচুক্তিতে ভারত যদি ১০ শতাংশ শুল্ক সুবিধা ধরে রাখতে পারে, অর্থাৎ যদি তা ২ এপ্রিল প্রস্তাবিত ২৬ শতাংশে না ওঠে, তাহলেই বলা যাবে, ভারত চুক্তি করতে চৌকস। তবে কেবল বাণিজ্যনীতি নয়, ভারতের এখনই উৎপাদন খরচ কমানো, পরিবহন ও সরবরাহব্যবস্থার কাঠামো সংস্কারও নীতিগত ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলে তিনি মত দেন।
ভবিষ্যতে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) নিয়ে আলোচনার সময় ভারতকে সচেতন থাকতে হবে, যাতে গাড়ি ও ওষুধশিল্পের মতো সংবেদনশীল খাতগুলো অপ্রয়োজনীয়ভাবে উন্মুক্ত না হয়ে পড়ে। প্রকৃত ও অর্থবহ পারস্পরিক লাভ ছাড়া এসব খাত উন্মুক্ত করা থেকে বিরত থাকা জরুরি বলে মনে করেন অজয় শ্রীবাস্তব।
যেসব দেশের সঙ্গে আমেরিকার বাণিজ্য–ঘাটতি আছে, তাদের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে পরবর্তীকালে অনেক দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন বাণিজ্যচুক্তির লক্ষ্যে আলোচনা শুরু করলে ট্রাম্প ৯০ দিনের জন্য ওই শুল্ক স্থগিত করেন। এই সময়সীমা শুরু হয়েছে ৯ এপ্রিল থেকে। যদিও তা চীনের জন্য প্রযোজ্য ছিল না। গত সোমবার চীনের সঙ্গে পৃথক বন্দোবস্তে গেল যুক্তরাষ্ট্র।
সম্প্রতি ব্রিটেনের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তির আলোচনা শেষ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষজ্ঞ মহলের ব্যাখ্যা, সেই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র যা আদায় করবে, কার্যত তার ভগ্নাংশ সুবিধাও পাচ্ছে না ব্রিটেন। তাঁরা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনার সময় ভারতের প্রতিনিধিরা যেন এই বিষয় মাথায় রাখেন এবং সতর্ক পদক্ষেপ নেন। এমন একটি চুক্তি যেন করা যায়, যাতে উভয় পক্ষ লাভবান হয়।