বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন (OTN Bangla):
মূল লেখক: জন লায়ন্স, সম্পাদক, আমেরিকাস, ওয়াশিংটন ডিসি
প্রকাশিত, মেলবোর্ন, ১৭ মে—২০২৫ সালের মধ্যপ্রাচ্য সফরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও দেখালেন তার বিখ্যাত “দ্য আর্ট অফ দ্য ডিল” দর্শনের সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন দিক। এই সফর জুড়ে, ট্রাম্পের অগ্রাধিকার ছিল স্পষ্ট: কূটনৈতিক সম্পর্কের চেয়েও বড় ছিল ব্যবসায়িক সুযোগ, যার সুবিধাভোগী হতে পারে কেবল যুক্তরাষ্ট্র নয়—তার নিজের পরিবারও।
সৌদি আরবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার নতুন অধ্যায়
যেখানে আগের মার্কিন প্রেসিডেন্টরা মধ্যপ্রাচ্যের সংকট—বিশেষ করে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত—নিয়ে চিন্তিত ছিলেন, ট্রাম্প সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে সৌদি আরবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তিনি সৌদি সরকারের সঙ্গে ২২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অস্ত্র ও বিমান চুক্তি স্বাক্ষর করেন—মার্কিন ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ অস্ত্র বাণিজ্য।
বুশ এবং ওবামা প্রশাসন যেখানে সৌদিদের মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং ৯/১১ হামলার (যার সঙ্গে সৌদি নাগরিক ও ওয়াহাবি মতবাদ জড়িত) প্রেক্ষিতে সতর্ক ছিলেন, ট্রাম্প সেখানে কোটি কোটি ডলারের অস্ত্র এবং চুক্তির “উপহার” নিয়ে হাজির হন। ২০১৮ সালে সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে ইস্তানবুলে সৌদি কনস্যুলেটে হত্যার ঘটনায় বাইডেন প্রশাসন সৌদি আরবের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নেয়। কিন্তু ট্রাম্পের দৃষ্টিতে, অতীত ভুলে গিয়ে সৌদিদের অর্থনৈতিক দিকটাই ছিল মুখ্য।
কুশনার ও ‘অ্যাব্রাহাম চুক্তি’
এই চুক্তিগুলোর পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেছেন ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনার। তিনি ইসরায়েল ও আরব দেশগুলোর মধ্যে ‘অ্যাব্রাহাম অ্যাকর্ডস’ স্বাক্ষরের পথে মধ্যস্থতা করছিলেন। সৌদি আরব ও ইসরায়েল একটি চুক্তির দ্বারপ্রান্তে ছিল—কিন্তু ৭ অক্টোবর হামাসের হামলা তা ব্যাহত করে।
ট্রাম্প প্রশাসন ছাড়ার পর কুশনার নিজের বেসরকারি ইকুইটি ফার্ম Affinity Partners প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে সৌদি পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড সরাসরি ২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে। উপদেষ্টাদের আপত্তি উপেক্ষা করে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান নিজেই বিনিয়োগ অনুমোদন করেন।
গাজার দুর্ভিক্ষের মাঝেও ইসরায়েল উপেক্ষিত
এই সফরে ট্রাম্প ইসরায়েলে যাননি। মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক মার্কিন কূটনীতিক ডেনিস রস বলেন, এটি “চমকপ্রদ” যে ট্রাম্প তিনটি আরব দেশে গিয়েছেন কিন্তু ইসরায়েল উপেক্ষা করেছেন। যদিও তিনি গাজার দুরবস্থার কথা স্বীকার করে বলেন, “অনেক মানুষ না খেয়ে আছে। অনেক ভয়াবহ ঘটনা ঘটছে। আমাদের সহায়তা করতে হবে।”
ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্টও গাজার মানবিক সংকটের তীব্র সমালোচনা করেন—বলেছেন, “এটি একেবারেই সহ্যযোগ্য নয়, বন্ধ করা দরকার এখনই।”
কাতারে বিশাল বিমান চুক্তি ও বিতর্কিত উপহার
সৌদি সফরের পর ট্রাম্প যান কাতারে। সেখানেও এক বিশাল চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়—কাতার এয়ারওয়েজ ১৬০টি জেট কিনছে, যার মূল্য ৯৬ বিলিয়ন ডলার। একইসঙ্গে, কাতার সরকার একটি নতুন বিমান উপহার দেয়ার প্রস্তাব দেয় ট্রাম্পকে, এয়ার ফোর্স ওয়ানের বিকল্প হিসেবে।
ট্রাম্প সেই উপহার নিতে রাজি হয়েছেন এবং বলেন, “না নেওয়া বোকামি হবে।” এই উপহার ঘিরে ঘনীভূত হয়েছে দুর্নীতির শঙ্কা। কাতারের সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসনের ঘনিষ্ঠতার পাশাপাশি, কাতার হামাসকে সমর্থন দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত। ফলে বিমানে নজরদারি ও নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
সিরিয়ায় চমকপ্রদ সাক্ষাৎ
ট্রাম্প এই সফরে এক চমকপ্রদ সিদ্ধান্ত নেন—তিনি সাক্ষাৎ করেন আহমেদ আল-শারার সঙ্গে, যিনি হায়াত তাহরির আল-শাম (HTS) নামক একটি সুন্নি জিহাদি সংগঠনের নেতা এবং সিরিয়ার নতুন শাসক। কিছুদিন আগেও মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগ HTS-কে সন্ত্রাসী সংগঠন বলে গণ্য করত এবং আল-শারার মাথার দাম ছিল ১০ মিলিয়ন ডলার।
বাশার আল-আসাদ পালিয়ে গেলে, আল-শারার ক্ষমতা দখল করেন। HTS পূর্বে তুরস্ক ঘেঁষা ছিল এবং ইরানঘেঁষা শিয়া সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল।
ইরানের সঙ্গে সম্ভাব্য পারমাণবিক চুক্তি
এই সফরে ট্রাম্প ইরানের সঙ্গে নতুন এক চুক্তির ইঙ্গিত দেন। তিনি বলেন, “ইরানে পারমাণবিক অস্ত্র কখনোই থাকবে না।” এটি ওবামা প্রশাসনের পরমাণু চুক্তির অনুরূপ একটি কাঠামো হতে পারে—যেখানে ইরানকে একটি সীমিত বেসামরিক পারমাণবিক কর্মসূচির অনুমতি দেওয়া হবে।
ইতোমধ্যে চার দফা আলোচনা সম্পন্ন হয়েছে, পঞ্চম দফা আসন্ন।
পুতিনের অনুপস্থিতি ও ট্রাম্পের উদাসীনতা
সফরের মাঝপথে জানা যায়, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইস্তানবুলে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সঙ্গে শান্তি আলোচনায় যোগ দেবেন না।
ট্রাম্প অবশ্য তা নিয়ে উদ্বিগ্ন নন—বরং বলছেন, এই যুদ্ধ সমাধান করা সম্ভব, তবে শুধুমাত্র যদি “আমি নিজে থাকি”।
এই সফর স্পষ্ট করেছে— বিশ্ব শান্তির সংকটে, যদিও তিনি মুখে যুদ্ধের অবসান চান, ট্রাম্পের অগ্রাধিকার হলো চুক্তি এবং ব্যবসা।
প্রকাশিত: ওটিএন বাংলা, ১৭ মে ২০২৫
অনুবাদ: সম্পাদকীয় বিভাগ
মূল উৎস: ABC News