মতামত
ড. শ্যামল দাস
মেলবোর্ন, ২৩ মে—ভূমিকা: আমি এই কথা লিখছি জেনেই যে, এটি হয়তো আমার জীবনের দীর্ঘস্থায়ী সন্দেহের দেয়ালে আরেকটি ইট হয়ে বসবে—যে আমি একজন ভারত–ঘেঁষা, র‘ এজেন্ট, “ওপারের লোক।” এই ছাপ, যা বিশ্বাসঘাতকতা থেকে নয় বরং বিশ্লেষণ এবং প্রশ্ন তোলার সাহস থেকে জন্ম যা বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সামাজিক পরিসরে আমার পথচলার ছায়াসঙ্গী হয়ে থেকেছে।
আমার বড় হয়ে ওঠা একটি বর্ণনাকে ঘিরে—যে ভারত বাংলাদেশকে শোষণ করে। আমাদের প্রতিটি দুঃখ–কষ্টের উৎস নাকি দিল্লি। এই বিশ্বাস এতটাই গভীরে প্রোথিত যে, তা যেন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চেতনায় অবতীর্ণ কোনো অলিখিত ধর্মগ্রন্থ। শুধু আমার পদবীর কারণে আমাকে ‘গাদ্দার’, ‘RAW দালাল’ ইত্যাদি উপাধি সারা জীবন বইতে হয়েছে। এমনকি শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সমিতির সভায়ও “শালীন” সহকর্মীদের বলতে শুনেছি, “এই শালাদের লাত্থি মেরে হেই পারে পাঠাইয়া দেওন দরকার।” কারণ? আমরা ভিন্নমত প্রকাশ করেছিলাম—আমি এবং আমার অগ্রজতুল্য ড. সুশান্ত দাস।
উন্নয়ন সমাজবিজ্ঞানের একজন ছাত্র হিসেবে আমি বহুবার বহু ফোরামে ভারতের নীতি ও আঞ্চলিক আধিপত্যবাদের সমালোচনা করেছি। তবুও সেই গায়ে গাঁথা ‘ওপারের লোক‘ এর ছাপ মুছে যায়নি।
তবে এই আলোচনা কোনো ব্যক্তিগত রাগ বা প্রতিশোধমূলক নয়—এটি একটি আত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক দায়বদ্ধতা। সম্প্রতি ভারত বাংলাদেশে ট্রানজিট বন্ধের যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তা বাংলাদেশের কোনো ক্ষতির কারণ হয়েছে কি না, সেটি জানা এবং বোঝার চেষ্টা থেকেই এই কাজের সূচনা। আগের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলের ঘটনাটিও স্মরণযোগ্য। যদি এই দুই নিষেধাজ্ঞার ফলে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়, তবে আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে—আওয়ামী লীগের সময়ে ভারতের সঙ্গে হওয়া সব চুক্তি নাকি শুধুই ভারতের পক্ষে গেছে—এই দাবি কতখানি সত্যি।
এই ক্ষুদ্র যাত্রাপথে আমি ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়ে ভারত–বাংলাদেশ চুক্তির কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক পর্যালোচনা করবো।
১. ভূমিকা
ভারত ও বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়ে বাণিজ্য, ট্রানজিট, জ্বালানি এবং অবকাঠামো সহযোগিতাকে কেন্দ্র করে নানা চুক্তি ও সমঝোতার মধ্য দিয়ে গঠিত হয়েছে। যদিও অনেকেই বলেন এসব চুক্তি কেবল ভারতের স্বার্থ রক্ষায় ব্যবহৃত হয়েছে, তবে একটি গভীর বিশ্লেষণ আমাদের বলে—বাংলাদেশও এইসব চুক্তি থেকে আর্থিক ও কৌশলগতভাবে উল্লেখযোগ্য লাভ অর্জন করেছে। এই গবেষণাপত্রে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলোর আর্থিক এবং কৌশলগত দিকসমূহ বিশ্লেষণ করা হয়েছে, যাতে বোঝা যায় বাংলাদেশ আদৌ নিস্ক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল কি না।
২. প্রধান চুক্তিসমূহ (২০০৯–২০২৪)
- ২০১০ সালের ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট ফর কোঅপারেশন।
- স্থলসীমান্ত চুক্তি (২০১৫): বহুদিনের সীমান্ত সমস্যা সমাধান।
- ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট চুক্তি: ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলে পণ্য পরিবহনে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের ব্যবহার।
- বন্দর ব্যবহারের চুক্তি: চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারে ভারতের অধিকার।
- জ্বালানি সহযোগিতা: বিদ্যুৎ বিনিময় ও যৌথ বিদ্যুৎ প্রকল্প।
৩. বাংলাদেশের আর্থিক ও কৌশলগত অর্জন
ক. ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট রাজস্ব
- ভারতীয় পণ্যের জন্য বাংলাদেশ প্রতি টনে ৫৮৯ টাকা ট্রানজিট ফি নির্ধারণ করে; এর সঙ্গে প্রতি কিলোমিটারে ১.৮৫ টাকা, কাগজপত্র প্রক্রিয়াকরণ, নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক খরচসহ আরও নানা চার্জ ছিল।
- এসব ফি বাংলাদেশের রাজস্ব আয় বাড়ায় এবং অবকাঠামো উন্নয়নের যুক্তি প্রদান করে।
খ. অবকাঠামো উন্নয়ন ভারতের অর্থায়নে বাংলাদেশে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে:
- আখাউড়া–আগরতলা রেল সংযোগ: ৪৭.৮ মিলিয়ন ডলার।
- খুলনা–মংলা বন্দর রেলপথ: ৩৮৮.৯২ মিলিয়ন ডলার লোন।
- মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট: ১.৬ বিলিয়ন ডলার।
এই প্রকল্পগুলো দেশের সংযোগ ব্যবস্থা এবং বিদ্যুৎ সরবরাহে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে।
গ. জ্বালানি বাণিজ্য
- ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বিদ্যুৎ বিনিময় দুই দেশের শক্তি সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারে সহায়তা করেছে।
৪. ভারতের লাভ
- লজিস্টিক সুবিধা: বাংলাদেশ হয়ে উত্তর–পূর্ব ভারতে পৌঁছানো প্রায় ১২০০ কিমি দূরত্ব কমিয়েছে, ফলে খরচ ও সময় উভয়ই সাশ্রয় হয়েছে।
- কৌশলগত সংযোগ: বাংলাদেশের সঙ্গে সংযোগ ভারতের অ্যাক্ট ইস্ট নীতিকে বাস্তবায়নে সাহায্য করেছে।
৫. মোট মূল্যায়ন: পারস্পরিকতা না একতরফা সুবিধা?**
এই যে বলা হয়—ভারতই সব কিছু পেল, বাংলাদেশ কিছুই পায়নি—এই ধারণাটি বিভ্রান্তিকর। যদিও ভারত উল্লেখযোগ্য কৌশলগত এবং লজিস্টিক সুবিধা অর্জন করেছে, বাংলাদেশও পরিকাঠামো উন্নয়ন, রাজস্ব আয় এবং জ্বালানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাস্তব ও পরিমাপযোগ্য লাভ করেছে। অনেক সময় এসব সুবিধা দৃশ্যমান না হলেও এগুলো দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও আঞ্চলিক মর্যাদা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
৬. ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলের প্রভাব: ক্ষতির হিসাব**
**ক. বাংলাদেশের আর্থিক ও কৌশলগত ক্ষতি**
**i. রপ্তানি রুটের বিঘ্ন ও খরচ বৃদ্ধি**
– জানুয়ারি ২০২৪ থেকে মার্চ ২০২৫ পর্যন্ত বাংলাদেশ প্রায় ৩৪,৯০০ টন তৈরি পোশাক ভারতে ট্রান্সশিপ করে ৩৬টি দেশে পাঠিয়েছিল, যার মূল্য ছিল প্রায় ৪৬২.৩৪ মিলিয়ন ডলার।
– ট্রান্সশিপমেন্ট বন্ধ হওয়ায় এসব রপ্তানির রুট এখন দীর্ঘ ও ব্যয়বহুল। রপ্তানিকারকদের খরচ ১৫–২০% পর্যন্ত বাড়তে পারে।
**ii. আটকে পড়া চালান ও তাত্ক্ষণিক আর্থিক ক্ষতি**
– ১৯ মে ২০২৫ পর্যন্ত ৩৬টি ট্রাক প্রায় ৫ কোটি টাকার তৈরি পোশাক নিয়ে বেনাপোল-পেট্রাপোল সীমান্তে আটকে পড়ে।
**iii. দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত প্রভাব**
– দেশের রপ্তানির ৮০% তৈরি পোশাক শিল্প সময়নিষ্ঠ সরবরাহের ওপর নির্ভরশীল। এখন বিলম্ব ও খরচ বৃদ্ধির ফলে বাজার হারানোর ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
– নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে সহজ বাণিজ্যের সম্ভাবনাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়ম লঙ্ঘনের পর্যায়েও পড়তে পারে।
**খ. ভারতের আর্থিক ও কৌশলগত প্রতিক্রিয়া**
**i. ট্রান্সশিপমেন্ট থেকে রাজস্ব হারানো**
– ভারতীয় বন্দর ও বিমানবন্দর যেগুলো পূর্বে বাংলাদেশি রপ্তানি সামলাতো, এখন সেগুলোর কার্যক্রম কমে গিয়েছে। ফলে হ্যান্ডলিং ফি ও সংশ্লিষ্ট আয় হ্রাস পেয়েছে।
**ii. অভ্যন্তরীণ শিল্প ও ভোক্তা বাজারে প্রভাব**
– ভারতীয় পোশাক শিল্পের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। টি-শার্ট ও ডেনিমের মতো পণ্যের দাম ২–৩% পর্যন্ত বাড়তে পারে।
**iii. কূটনৈতিক ও কৌশলগত ক্ষয়**
– হঠাৎ করে এই সিদ্ধান্ত কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি করতে পারে।
– বাংলাদেশ বিকল্প বাণিজ্য পথ ও অংশীদার খুঁজে নিতে পারে, যার ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রভাব কমে যেতে পারে।
৭. তুলনামূলক টেবিল: বর্তমান ও ভবিষ্যতের লাভ-ক্ষতি**
তুলনামূলক টেবিল: বর্তমান ও ভবিষ্যতের লাভ–ক্ষতি
ক্যাটাগরি | বাংলাদেশ (পূর্ববর্তী অর্জন) | ভারত (পূর্ববর্তী অর্জন) | বাংলাদেশ (আগামী ২ বছর – পূর্বাভাস) | ভারত (আগামী ২ বছর – পূর্বাভাস) |
ট্রানজিট ফি ও বন্দর আয় | ভারতীয় পণ্য থেকে বছরে $1.5M+ | উত্তর–পূর্ব ভারতে ২০–৩০% খরচ সাশ্রয় | বছরে $৩–৫M হারানোর সম্ভাবনা | ৩০–৪০% লজিস্টিক দক্ষতা হ্রাস |
তৈরি পোশাক ট্রান্সশিপমেন্ট | $৪৬২.৩৪M রপ্তানি সুবিধা | দ্রুত রপ্তানি/আমদানি সুবিধা | খরচ ১৫–২০% বৃদ্ধি, রপ্তানি হ্রাস সম্ভাব্য | দাম বৃদ্ধি, ₹১০০০ কোটি ব্যবসা স্থানান্তর |
জ্বালানি বাণিজ্য | বিদ্যুৎ রপ্তানির আয় | নির্ভরযোগ্য গ্রিড সাপোর্ট | বহাল, তবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর নির্ভরশীল | একই, কিন্তু বিকল্প নির্ভরতা গড়ে উঠতে পারে |
অবকাঠামো প্রকল্প | $২B+ ভারতীয় বিনিয়োগ | উন্নয়ন অর্থায়নের মাধ্যমে প্রভাব | প্রকল্প স্থগিত বা বিলম্বিত হতে পারে | আঞ্চলিক সদিচ্ছার হ্রাস |
কৌশলগত অবস্থান | নেপাল/ভুটান বাণিজ্যে কেন্দ্র (২০২৫–এর আগে) | সিলিগুড়ি করিডোর বাইপাস | আঞ্চলিক ট্রানজিট লিভারেজ হারানো | অ্যাক্ট ইস্ট গতি হ্রাস |
৮. উপসংহার
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ভারত-বাংলাদেশ চুক্তিগুলোর মাধ্যমে দুই দেশই বাস্তবিকভাবে লাভবান হয়েছে। বাংলাদেশ রাজস্ব, অবকাঠামো ও জ্বালানি বিনিময় সুবিধা পেয়েছে; ভারত পেয়েছে কৌশলগত ও লজিস্টিক সুবিধা। কিন্তু ট্রান্সশিপমেন্ট ও ট্রানজিট বাতিলের ঘটনা আমাদের শেখায়—এই ধরনের আঞ্চলিক সহযোগিতা খুবই প্রয়োজন, কিন্তু এটি নাজুক হয়ে পড়তে পারে অবিশ্বাস কার্যকর থাকলে; সে কারনেই উভয় দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার জন্য একটি ভারসাম্যপূর্ণ কূটনৈতিক নীতি প্রয়োজন যেখানে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের সংস্কৃতি চালু থাকা দরকার।
**তথ্যসূত্র**
১. দ্য ডেইলি স্টার (২০২৩)। “ভারতীয় পণ্যের জন্য ট্রানজিট ফি প্রতি টন ৫৮৯ টাকা নির্ধারিত।”
২. ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস (২০২৫)। “ভারত-বাংলাদেশ ট্রান্সশিপমেন্ট সম্পর্কের উত্থান ও পতন।”
৩. টাইমস অফ ইন্ডিয়া (২০২৫)। “৫ কোটি টাকার কাপড় সীমান্তে আটকে।”
৪. টেক্সফ্যাশ (২০২৫)। “বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিতে ভারতীয় নিষেধাজ্ঞার ধাক্কা।”
৫. ইকোনমিক টাইমস (২০২৫)। “ভারত বাংলাদেশ থেকে আমদানির ৪২% সীমিত করল।”
৬. রয়টার্স (২০২৫)। “ভারত স্থল সীমান্ত দিয়ে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা প্রত্যাহার করল।”
৭. এপি নিউজ (২০২৩)। “ভারত-বাংলাদেশ যৌথ মৈত্রী বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তথ্য।”
৮. রিগ্লোবাল (২০২৪)। “দক্ষিণ এশিয়ায় বিদ্যুৎ বিনিময়ে অগ্রগতি।”
৯. বাংলাদেশ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় (২০২২)। “বন্দরের বার্ষিক আয় প্রতিবেদন।”
১০. বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (২০২৩)। “বিদ্যুৎ আমদানি-রপ্তানি পরিসংখ্যান।”
১১. এডিবি ও বিশ্বব্যাংক (২০২১–২০২৩)। “বাংলাদেশে ভারতের অর্থায়নে অবকাঠামো প্রকল্প।”
১২. ডব্লিউটিও ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন ডেটাবেস।
ড. শ্যামল দাস, ভার্জিনিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র