মতামত
লেখা: শামীম আহমেদ
টরন্টো, মে ২৩, ২০২৫- এই লেখাটি আগামী দুই-তিনদিনের জন্য বিশেষ করে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জুম্মার নামাজ ও বায়তুল মোকাররমকে কেন্দ্র করে ক্যান্টনমেন্ট নিয়ে জুলাই ষড়যন্ত্রকারী ও মাস্টারমাইন্ডরা একটা ডার্টি গেইম খেলতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে, যেটি নিয়ে সবার সতর্ক থাকা উচিৎ। আবার এই সতর্কতা ভবিষ্যতেও সবার কাজে আসবে বলে মনে করি।
রাজনীতি বিষয়টা জাস্ট একটা ছেলেখেলা হিসেবে নেয়া উচিৎ নয় বলে মনে করি। বাংলা অভিধান বিবেচনায় রাজনীতি শব্দের অর্থ রাজার নীতি। সময়ের পরিক্রমায় রাজার নীতি একটু ঘুরে ফিরে রাজার ন্যায় বিচারে রূপান্তরিত হয়। অর্থাৎ কেবল রাজার প্রণীত নীতি হলেই হবে না, সেটা ন্যায় বিচার নিশ্চিত করে কিনা সেটাও বিবেচনা করতে হবে। আস্তে আস্তে রাজারা ক্ষমতাহীন হয়েছে, প্রেসিডেন্ট আর প্রধানমন্ত্রী এসেছে, এসেছে তাদের মন্ত্রী, সাংসদ, পরামর্শরাও। রাজনীতি বিভক্ত হয়েছে বহুভাবে; তবুও সেই মাথার দিকে শ’খানেক মানুষ আর পায়ের দিকে কোটি কোটি মানুষের দেশ নিয়ে যে মস্তকের খেলা সেটাই রাজনীতি। এরপর ফেইসবুক এসেছে, সেখানে উল্লাস, হুমকি, রাগ, উষ্মা দেখলে বোঝা যায় কেন রাজনীতি ভেবেচিন্তে খেলতে হয়। বেশীরভাগ মানুষ ওটা পারে না। সমর্থক হওয়া সহজ, কর্মী হওয়া কঠিন। দায়িত্ব নিতে হয়। বুঝতে হয়। বুঝে শুনে চাল দিতে হয়।
তাই বলছি রাজনীতি ভেবেচিন্তে করুন, ভেবেচিন্তে খেলুন। আমাদের রাজনীতি গত কয়েক দশকে জুম্মার নামাজ কেন্দ্রিক হয়ে গেছে। বায়তুল মোকাররম কেন্দ্রিক হয়ে গেছে। আর হয়েছে ক্যান্টনমেন্ট কেন্দ্রিক। সবগুলোই বিপজ্জনক, কোনোটাই হওয়া উচিৎ ছিল না। যখন যুক্তির টেবিল ভেঙে পড়ে, আলোচনার স্রোতে ভাটা নামে, বিবেচনাপ্রসূত মানুষরা অধৈর্য হয়ে যান; তখনই কেবল রাজনীতি জুম্মার দিন মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। তখনই কেবল রাজনীতি বায়তুল মোকাররমের দিকে ছুটতে থাকে। তখনই কেবল রাজনীতি ক্যান্টনমেন্টকে ঘিরে থাকে।
দীর্ঘমেয়াদে দেশের ভাল চাইলে রাজনীতিকে বায়তুল মোকাররম, ক্যান্টনমেন্ট এবং জুম্মাবার থেকে দূরে রাখতে হবে। বিশেষত বাংলাদেশ এখন এমন এক ক্রান্তিকালে পৌঁছে গেছে যে এই বিষয়গুলো গভীরভাবে চিন্তার সময় এসেছে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলি। শুনুন।
আল্লাহর সাথে আপনার সম্পর্ক আপনার ইবাদতের। ইবাদতের স্থান কিছু ঐতিহাসিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। মক্কা, মদিনা কিংবা জেরুজালেমের মসজিদে নামাজ পড়ার ফজিলত এবং আবেগ নিশ্চয় অনেক বেশী। বায়তুল মোকাররমের ইসলামে আলাদা কোন ফজিলত নেই। এটি আমাদের জাতীয় মসজিদ। দেশ যখন শান্ত, তখন অজস্র মানুষের সাথে এখানে নামাজ পড়ার শান্তি আলাদা। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমানের রাজনীতি ঐ পর্যায়ে নাই। তাই ন্যায়পরায়ণতাও নাই।
৫ অগাস্ট ২০২৪ এর পর রাজনীতি এখন দুর্বৃত্তদের হাতে। এই দুর্বৃত্তরা নিজেদের উদ্দেশ্যে হাসিলের জন্য জুলাই-অগাস্টে শত শত ছাত্রকে স্নাইপার দিয়ে গুলি করে মেরেছে, জাতি দেখেছে। এরা এখন দেশ ধ্বংস করে পালানোর পথ খুঁজছে। শেষ কামড়টা এরা দিতে চায় বায়তুল মোকাররম থেকে, শান্তিপ্রিয় মুসলমানদের জীবন নিয়ে জুয়া খেলে।
দেশে নানা সূত্র থেকে শোনা যাচ্ছে জঙ্গী, মৌলবাদী, অগাস্ট ষড়যন্ত্রকারীরা আগামী কিছুদিন বিশেষত আগামীকাল জুম্মাকে ঘিরে ষড়যন্ত্র করছে। আপনি যদি এই ষড়যন্ত্রের অংশ না হন, তাহলে এলাকার মসজিদে জুম্মা পড়ুন, সমস্যা কী? ঢাকা মসজিদের শহর। ৫ মিনিট হাঁটলেই মসজিদ পাওয়া যায়। বায়তুল মোকাররমে যেয়ে ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা না দেয়াই ভাল।
আরেকটা কথা বলি, যে কোন কিছু বিবেচনার সময় context বা পরিস্থিতি বিচার বিবেচনা করবেন। কোন সচেতন নাগরিকই সেনাবাহিনীকে রাজনীতিতে দেখতে চায় না। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান যে অরাজক পরিস্থিতি তাতে সেনাবাহিনী ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিকে ‘fighting chance’ দেয়ার আর কেউ আছে? আপনি যদি বাংলাদেশের রাজনীতির সমীকরণ থেকে আর্মি আর পুলিশকে সরিয়ে দেন, তাহলে আওয়ামী লীগের সামনে দাঁড়ানোর কেউ আছে? এত জনপ্রিয়, সবচেয়ে বেশী সমর্থক দলটাকে অনির্বাচিত, অগণতান্ত্রিক অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কীভাবে অত্যাচার নিপীড়ন করছে?
তাই এই মুহুর্তে সেনাবাহিনীকে প্রতিপক্ষ বানাবেন না। সেনাবাহিনী না থাকলে অগাস্ট ষড়যন্ত্রে আওয়ামী লীগের কোন মন্ত্রী এমপি জীবন নিয়ে নিরাপদে থাকতে পারত? ভেবে দেখেন। হ্যা সেনাবাহিনী চাইলে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি রক্ষা করতে পারত, দেশব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের নিদর্শন রক্ষা করতে পারত। সেই আলোচনা আপাতত ভবিষ্যতের জন্য তুলে রাখুন।
কিন্তু ভাবুন ইউনুস সরকার যেভাবে দেশকে বিক্রি করে দিচ্ছে তা থেকে বর্তমানে উত্তরণে আমাদের আশা কে দেবে? সেন্ট মার্টিন মার্কিনীদের দেবার জন্য এরা শুরুতেই পর্যটকদের যাত্রা বন্ধ করে দিয়েছে। একটা দেশ যেখানে মানুষ দূষণের জন্য নিঃশ্বাস নিতে পারে না, হর্নের জন্য কানে শোনে না, কারখানার বর্জ্যের দূষণে সব নদী মরে গেছে প্রায়, পলিথিনের জন্য কোন খাল-বিল টিকে নেই, সেখানে প্রবাল রক্ষায় এত আন্তরিক কেন এরা? আমি যারা গত ৯ মাসে সেন্ট মার্টিনে গিয়েছে, তাদের কাছে শুনেছি প্রবাল রক্ষায় এই সরকারের কোনো আগ্রহই নাই। শেখ হাসিনার জায়গায় ইউনুসকে বসানোর চুক্তির একটা অংশ হিসেবে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের এই বন্ধক রাখা।
চিন্তা করেন এরা রোহিঙ্গা ফেরত পাঠাবে বলে ২ লক্ষের বেশী রোহিঙ্গা দেশে ঢুকিয়েছে। আরাকান সেনারা পার্বত্য চট্টগ্রামে দেদারসে ঢুকছে। জাতিসংঘের ট্রাকে করে করিডোরের নামে মায়ানমারে কী পাঠানো হচ্ছে অনুমান করতে পারেন সহজেই। চট্টগ্রাম বন্দর ক্ষমতায় আসার চুক্তির অংশ হিসেবে ইউনুস বিদেশীদের দিয়ে দিয়েছে। ভারত অসন্তুষ্ট, চায়না অসন্তুষ্ট, রাশিয়া অসন্তুষ্ট। ইউনুস যাদের টাকায় নোবেল কিনেছে তাদের দাসত্ব করলে আমাদের বন্ধু আসলে কে?
বাংলাদেশের বন্ধু এখন আমাদের সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনী প্রধান পরিষ্কার করে বলেছেন তিনি করিডোর দিবেন না। বাংলাদেশের নব্বই শতাংশ মানুষ এই হিউম্যানেটারিয়ান করিডোর চায় না। তারা চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশীদের হাতে তুলে দিতে চায় না। তারা সেন্ট মার্টিন অন্য দেশের ঘাঁটি বানাতে চায় না।
সেনাবাহিনীও তা চায় না। সেনাবাহিনী প্রধান সেটা পরিষ্কার করে বলেছেন। বিমান বাহিনী ও নৌবাহিনীর প্রধানও তার সাথে আছেন। সেনাবাহিনীর জুনিয়র সদস্যরা করিডর দিতে গিয়ে মায়ানমার আর ভারতীয় সেনাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হতে চায় না বলে পরিষ্কার জানিয়েছে। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার বলেছেন ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দিতে হবে।
ইউনুস ইতিমধ্যে জেনারেল ওয়াকারকে সরিয়ে নতুন সেনাপ্রধান বসানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে মাননীয় রাষ্ট্রপতির অসম্মতির কারণে। দেশ বেঁচে ফেলতে না পারলে ইউনুসকে তার ডিপ স্টেট কোনো প্রটেকসান দেবে না জানিয়েছে। ইউনুস ভয় পেয়েছে। পদত্যাগ করতে চেয়েছে। শেষ চেষ্টা হিসেবে সে এখন জামায়েত ইসলামীর শরাপন্ন হয়েছে। এই জামায়েত ইসলামীর সাথে অগাস্ট ষড়যন্ত্রের কুশীলবরা বসে জুম্মাবারে বায়তুল মোকাররম থেকে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করতে পারে জেনারেল ওয়াকারকে সরানোর দাবী নিয়ে – এই পরিকল্পনা হচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে।
দেশের এই ক্রান্তিকালে তাই ষড়যন্ত্রকারীদের রুখে দিন। পাড়ার মসজিদে জুম্মা পড়ুন। আল্লাহর কাছে ষড়যন্ত্রকারীদের থেকে পানাহ চান। সেনাবাহিনীর পাশে থাকুন। ইউনুস চাইছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি আর সেনাবাহিনীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে। এটা হতে দেবেন না। সেনাবাহিনীকে জেনারেল ওয়াকারের নেতৃত্বে থাকতে হবে। কেবল তারাই এই মুহুর্তে দেশ বেচে দেয়া থেকে বাংলাদেশকে বাঁচাতে পারে।
মনে আছে এটা রাজনীতি? এই মুহুর্তে আপনার মিত্র কে সেটি আপনার বুঝতে হবে।
একইভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে একতাবদ্ধ করতে আওয়ামী লীগ-বিএনপিকে একসাথে কাজ করতে হবে। ৫ অগাস্টের পর সারা দেশের লুটপাট অত্যাচার নিপীড়নের ৭০ ভাগ ছাত্রদের আবরণে বিএনপিই করেছে। সেটা আমরা জানি। সে বিষয়ে ভবিষ্যতে আলাপ হতে পারে। কিন্তু এই মুহুর্তে ইউনুসের দেশ বিক্রি ঠেকাতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে মাথায় রেখে একযোগে কাজ করতে হবে জামায়েত, ইউনুস, পঞ্চতান্ডব, ডার্টি মাস্টারমাইন্ড ও অগাস্ট ষড়যন্ত্রকারীদের রুখে দাঁড়াতে, ছুঁড়ে ফেলতে।
বিএনপি ১৯ বছর ক্ষমতার বাইরে, নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাবার এমন সুবর্ণ সুযোগ তাদের সামনে আর কখনও আসেনি। ইউনুস তাদের ক্ষমতায় যেতে দিবে না। বিএনপি যদি ক্ষমতায় যেতে চায়, তাদের আওয়ামী লীগের সাথে একযোগে আন্দোলন করে ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে।
রাজনীতি সহজ জিনিস নয়। এখানে strategy বা কৌশল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চিৎকার করার জন্য কোটি কোটি মানুষ লাগে। কিন্তু কিছু মানুষকে বিবেচনাপ্রসূত হতে হয়। একটা বড় খাদ পার হবার জন্য মাঝে মাঝে আপনাকে একটু পিছে গিয়ে দৌড়ে এসে লাফ দিতে হয়। এখন সেই সময়। পিছে যাওয়া হয়েছে। এখন দৌড়ে এসে লাফ দিতে হবে। আপনার লাফ দেবার সঙ্গী কারা হবে সেটি বুদ্ধিমত্তার সাথে নির্বাচন করুন।
জয় বাংলা।
লেখক: শামীম আহমেদ, টরন্টো, অন্টারিও
উল্লিখিত মতামত লেখকের নিজস্ব, এবং প্রতিষ্ঠানের অবস্থান বা দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত করে না।