মেলবোর্ন, ২৪ মে— ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দুই হাজারেরও বেশি ‘বাংলাদেশি’কে নিজের দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য তারা বাংলাদেশ সরকারের পদক্ষেপের অপেক্ষায় আছে।
ওই বাংলাদেশিরা বেআইনিভাবে ভারতে থাকছিলেন এবং তাদের প্রত্যর্পণের আগে পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশকে জানিয়েছে ভারত।
দিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বৃহস্পতিবার এক ব্রিফিংয়ে বলেছেন, “যেসব বিদেশিরা বেআইনিভাবে ভারতে আছেন, তারা বাংলাদেশি হোন বা যে কোনও দেশেরই হোন, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তিনি এও বলেছেন যে ২৩০০র-ও বেশি এমন বাংলাদেশি নাগরিক ভারতে রয়েছেন, যাদের প্রত্যর্পণ করতে হবে, কিন্তু বাংলাদেশ থেকে তাদের নাগরিকত্ব যাচাই সম্পূর্ণ না হওয়ার কারণে তাদের নিজ দেশে ফেরত দেওয়া যাচ্ছে না।

এদের মধ্যে এমন মানুষও রয়েছেন, যারা বেআইনিভাবে ভারতে এসে ধরা পড়েন এবং জেলের সাজা হয়। তবে সাজার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও পরিচয় ও নাগরিকত্ব যাচাই না হওয়ায় তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো যায়নি, জানান তিনি।
কী বলছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়?
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে রণধীর জয়সওয়াল বলেছেন, ভারতে যে কোনও দেশের নাগরিকই যদি বেআইনিভাবে বসবাস করেন, তাহলে আইন অনুযায়ী তাদের নিজ দেশে ফেরত দেবে ভারত।
“ভারতে একটা বড় সংখ্যায় বাংলাদেশি নাগরিক রয়েছেন, যাদের প্রত্যর্পণ করা হবে। আমরা বাংলাদেশকে জানিয়েছি এদের নাগরিকত্ব যাচাই করে দেখতে। প্রত্যর্পণের অপেক্ষায় আছেন, এরকম ২৩৬০ জনেরও বেশি মানুষের তালিকা রয়েছে। এদের অনেকেই তাদের কারাবাসের সাজা সম্পূর্ণ করেছেন,” বলেছেন মি. জয়সওয়াল।
তার কথায়, গত পাঁচ বছর ধরে এই বাংলাদেশিদের নাগরিকত্ব যাচাইয়ের কাজটা অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে।
তিনি বলেছেন, “আমরা বাংলাদেশকে অনুরোধ করব যে তারা যেন দ্রুততার সঙ্গে নাগরিকত্ব যাচাইয়ের কাজটা শেষ করে,” যাতে বাংলাদেশের কাছে যাদের প্রত্যর্পণ করার কথা, তাদের ফেরত দেওয়া যায়।
ভারত থেকে প্রত্যর্পণ যেভাবে হয়
ভারতে যদি কোনও বিদেশি বেআইনিভাবে প্রবেশ, অর্থাৎ বৈধ ভিসা ছাড়া প্রবেশ করে গ্রেফতার হন, তাহলে বিদেশি আইনের (ফরেইনার্স অ্যাক্ট) ১৪ নম্বর ধারায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়।
আদালত তাকে যতদিনের সাজা দেয়, সেই মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে কারা কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট ভারতীয় রাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানায়।
সেখান থেকে সেই তথ্য ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে বাংলাদেশের দূতাবাস, তারপরে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট থানায় পৌঁছায় নথি।
যাচাইয়ের পরে ওই একই পথে তা আবার ফিরে আসে ভারতের কারা কর্তৃপক্ষের কাছে।
এরপরের পদ্ধতি হল কারা কর্তৃপক্ষ স্থানীয় পুলিশের মাধ্যমে বিএসএফের সঙ্গে যোগাযোগ করে ওই বাংলাদেশি নাগরিককে হস্তান্তর করে। বিএসএফ আবার বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডসের সঙ্গে সমন্বয় করে সীমান্তে নিয়ে গিয়ে ফেরত দেয়।
যতদিন না এই পুরো পদ্ধতি শেষ হয়, সাজার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও ওই বাংলাদেশি নাগরিককে জেলেই থাকতে হয়। এদের বলা হয়ে থাকে ‘জান-খালাস’।
‘জান খালাস’ কী?
কলকাতায় এই জান-খালাস বন্দিদের (যাদের সাজার মেয়াদ শেষ হয়েছে, কিন্তু এখনো কারাগার থেকে বের হননি) নিয়ে কাজ করেন, এমন মানবাধিকারকর্মীরা দীর্ঘদিন ধরেই এই প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়া দ্রুততর করার আবেদন জানিয়ে আসছেন।
তারা যেমন একদিকে প্রশ্ন তুলে থাকেন যে কেন নাগরিকত্ব যাচাইয়ের এই প্রক্রিয়া সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে শুরু না করে আগে থেকেই তা চালু করা হয় না কেন?
একই সঙ্গে তারা অভিযোগ করে থাকেন যে পরিচয় যাচাইয়ের কাজটা যেহেতু হয়ে থাকে বাংলাদেশে, সেখানেও যথেষ্ট বিলম্ব ঘটে থাকে।
পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার সামাজিক কর্মকর্তা সূরজ দাস নিয়মিতভাবেই ভারতে আটক হওয়া কিশোর-কিশোরীদের প্রত্যর্পণের প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়ে থাকেন।
তিনি বলছিলেন, “আমরা যেটা দেখি যে বাংলাদেশের তরফে নাগরিকত্ব যাচাইয়ে প্রচুর সময় লেগে যায়। প্রথমে তো বাংলাদেশ থেকে স্বীকারই করতে চাওয়া হয় না যে ওই ব্যক্তি সেদেশের নাগরিক। ‘নট ফাউন্ড’ বলে নোট দিয়ে দেয়। এরপরে যাদের পরিবারের সামর্থ্য আছে, তারা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে নথি জমা করলে দ্বিতীয়বার ভেরিফিকেশন হয়।”
“শিশু কিশোর এবং তাদের পরিবারের কাছ থেকেই আমরা জানতে পারি যে সেদেশে স্থানীয় স্তরে কিছু দালাল শ্রেণির মানুষও আছেন, যারা অর্থের বিনিময়ে দ্রুত নাগরিকত্ব যাচাইয়ের কাজ করে থাকে। সেই অর্থ যাদের দেওয়ার সামর্থ্য নেই, তাদের ভেরিফিকেশনও আটকিয়ে থাকে মাসের পর মাস,” জানাচ্ছিলেন মি. দাশ।
পুশ-ব্যাক না প্রত্যর্পণ?
প্রত্যর্পণের বাইরেও দুই দেশের সমন্বয়ের মাধ্যমে যে বন্দি বিনিময় হয়েছে, তার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ গত বছর ডিসেম্বর মাসে পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশায় আটক বাংলাদেশি মৎস্যজীবীদের ফেরত দেওয়া ও একই সময়ে বাংলাদেশে ধৃত ভারতীয় মৎস্যজীবীদের ফেরত আনার ঘটনা।

কিন্তু সম্প্রতি ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে কথিত বেআইনি বাংলাদেশি চিহ্নিতকরণের যে অভিযান চলছে, তাদের ক্ষেত্রে এইসব পন্থা অবলম্বন করা হচ্ছে না বলেই একাধিক নিরাপত্তা এজেন্সি বিবিসির কাছে নিশ্চিত করেছে।
মূলত গুজরাত, রাজস্থান এবং উত্তরপ্রদেশে এ ধরনের বিশেষ অভিযান শুরু হয়েছে।
ওই সব রাজ্যে বিবিসির সংবাদদাতারা জানিয়েছেন যে বাংলাদেশে ‘প্রত্যর্পণ’ করার কথা বলা হলেও তাদের প্রায় কাউকেই গ্রেফতার দেখানো হয় নি, আদালতের সামনেও হাজির করা হয়নি।
আটক হওয়ার পরে তাদের ‘ডিটেনশন সেন্টারে’ রাখা হচ্ছে, সেখান থেকে ধাপে ধাপে তাদের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী কোনো রাজ্যে নিয়ে গিয়ে সীমান্ত দিয়ে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
এই পদ্ধতিকেই বলা হয়ে থাকে ভারত থেকে ‘পুশ-ব্যাক’ বা বাংলাদেশে ‘পুশ-ইন’।
এক্ষেত্রে বেআইনি বলে যাদের চিহ্নিত করা হচ্ছে, তারা আসলেই বাংলাদেশের নাগরিক কি না, না কি তারা বাংলা-ভাষী ভারতীয়, এ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন মানবাধিকার কর্মীরা।