সম্পাদনীয়
মেলবোর্ন, ২৪ মে—বাংলাদেশের রাজনৈতিক ট্রানজিশনের এই গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সম্ভাব্য পদত্যাগ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক এবং জল্পনা তুঙ্গে। তিনি নিজেই বিভিন্ন আলোচনায় স্বীকার করেছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে তাঁর কাজ করা দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। নিউইয়র্ক টাইমস-এর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, নির্বাচন নিয়ে ক্রমবর্ধমান চাপ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতৈক্যের অভাবের কারণে ইউনূস হুমকি দিয়েছেন পদত্যাগের।
২০২৪ সালের ছাত্র-নেতৃত্বাধীন গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর মুহাম্মদ ইউনূসকে দেশের অন্তর্বর্তীকালীন নেতৃত্ব হিসেবে দেখা হচ্ছিল। তাঁর আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি অনেককেই আশাবাদী করেছিল যে তিনি একটি নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সুসম্পন্ন করতে পারবেন। কিন্তু সেই প্রত্যাশা এখন ভেঙে পড়েছে।
ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টির প্রধান নাহিদ ইসলাম BBC বাংলাকে বলেছেন, অধ্যাপক ইউনূস হতাশ হয়ে বলেছিলেন, “যদি কাজ করতে না পারি… আমি এসেছিলাম পরিবর্তনের জন্য, কিন্তু এইভাবে কাজ করা অসম্ভব”। এমন মন্তব্য শুধু হতাশার বহিঃপ্রকাশ নয়, এটি এক গভীর প্রশাসনিক ব্যর্থতার দিকেও ইঙ্গিত করে।
প্রথম আলো-তে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ফেলো মোবাশ্বার হাসান মন্তব্য করেন, “মুহাম্মদ ইউনূস একজন চমৎকার ব্যাংকার হতে পারেন, প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রেও তিনি দারুণ হতে পারেন; কিন্তু তাঁর যে ঘাটতি রয়েছে, দিনের পর দিন সেটা স্পষ্ট হচ্ছে—তাঁর দৃঢ় ও শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব নেই।” তিনি আরও বলেন, ইউনূস বরং তাঁর উপদেষ্টাদের দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হন। এই মন্তব্য বাংলাদেশের বর্তমান প্রশাসনিক অনিশ্চয়তার বাস্তব প্রতিচ্ছবি।
রাজনীতিকদের অভ্যন্তরীণ বিরোধ, বিএনপির রোডম্যাপ দাবি, এবং সামরিক বাহিনীর ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের হুঁশিয়ারি সব মিলিয়ে ইউনূসের সরকার কার্যত এক অস্থির চাপে পড়ে গেছে। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, “দেশ ক্রমেই বিশৃঙ্খল অবস্থার দিকে যাচ্ছে, প্রশাসনিক কাঠামো কার্যত ভেঙে পড়েছে।”
একইসঙ্গে বিএনপির নেতারা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, নির্বাচনের জন্য নির্দিষ্ট রোডম্যাপ না পেলে তাঁরা সরকারের প্রতি সমর্থন তুলে নেবেন। অথচ ইউনূস প্রশাসন এখনো পর্যন্ত কোনও নির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করতে পারেনি।
এই বাস্তবতার প্রেক্ষিতে, অধ্যাপক ইউনূসের পদত্যাগ একদিকে তাঁর ব্যক্তিগত পরিত্রাণ হতে পারে, অন্যদিকে জাতীয় সংকট আরও ঘনীভূত করতে পারে। তবে একথা সত্য যে, যদি নেতৃত্ব দৃঢ় না হয়, যদি সিদ্ধান্তে দায়িত্ববোধ না থাকে, তবে সেই নেতৃত্ব ধরে রাখা শুধু চেহারার সৌন্দর্য ধরে রাখার সমান।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন নোবেলজয়ী, বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত একজন উন্নয়নকর্মী। কিন্তু রাজনীতির বাস্তবতা, প্রশাসনিক কঠোরতা এবং সামাজিক প্রত্যাশার ভার অনেক বেশি। তিনি যদি সত্যিই বিশ্বাস করেন যে, তিনি এ দায়িত্ব পালনে সক্ষম নন, তবে তাঁর পদত্যাগ শুধু ব্যক্তিগতভাবে সঠিক নয়, বরং রাজনৈতিকভাবে নৈতিক একটি সিদ্ধান্ত হতে পারে।
এই মুহূর্তে জাতিকে প্রয়োজন দৃঢ় নেতৃত্ব, স্বচ্ছতা ও কার্যকর রোডম্যাপ। মুহাম্মদ ইউনূস থাকুন বা না থাকুন, জাতির দাবি—গণতান্ত্রিক উত্তরণ হোক কার্যকর ও বিশ্বাসযোগ্য পথে।
সম্পাদনীয়: প্রদীপ রায়, সম্পাদক, OTN Bangla