মেলবোর্ন, ২৫ মে- বাইরে থেকে দেখলে ২০ মে’র বৈঠকটি একটি সাধারণ রুদ্ধদ্বার আলোচনা বলেই মনে হতো—বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন নেতা ও নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস এবং দেশের তিন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানদের মধ্যে আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে আলোচনা।
তবে এই বৈঠকটি এমন এক সময়ে হলো, যখন সরকারের অভ্যন্তরীণ কাজকর্ম সম্পর্কে অবগত একাধিক কর্মকর্তা আল জাজিরাকে জানিয়েছেন যে ঢাকায় একটি ক্রমবর্ধমান ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চলছে। বাংলাদেশের সামাজিক ও মূলধারার সংবাদমাধ্যমে যেটি ‘ঠান্ডা লড়াই’ হিসেবে চিত্রিত হয়েছে—সেনাবাহিনী ও অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে—এই টানাপড়েন এখন ইউনূসের ভূমিকার ভবিষ্যতকেই হুমকির মুখে ফেলেছে। অথচ মাত্র নয় মাস আগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের পতনের পর তিনিই ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন।
২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনা ভারত পালিয়ে যান, তার ১৫ বছরের শাসনের বিরুদ্ধে একটি গণবিক্ষোভের মুখে পড়ে, যে সময়ে তার বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের অভিযোগ উঠেছিল।
এই বৈঠকটি এমন এক সময়ে হয়েছে, যখন ইউনূস পদত্যাগ করতে পারেন এমন গুজবও শোনা যাচ্ছিল। তবে শনিবার আরেকটি মন্ত্রিসভা বৈঠকের পর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান ও উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা (ইউনূস) আমাদের সঙ্গেই আছেন— তিনি পদত্যাগের কিছু বলেননি-এবং অন্য উপদেষ্টারাও আছেন; আমরা আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করছি।”
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এই অচলাবস্থা এখনও শেষ হয়নি।
আমরা এখন বিশ্লেষণ করছি বাংলাদেশে সাম্প্রতিক এই অস্থিরতা এবং এটি কীভাবে দেশের পুনরায় নির্বাচনী গণতন্ত্রে ফেরার প্রচেষ্টাকে প্রভাবিত করতে পারে।
সেনাবাহিনী ও সরকারের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে কেন?
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মোতায়েন রয়েছে ২০২৪ সালের জুলাই থেকে, সেই গণবিক্ষোভের পর থেকে যেটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের পথ তৈরি করেছিল। ওই সময় বেসামরিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কার্যত ভেঙে পড়েছিল—পুলিশ সদস্যরা দেশব্যাপী ধর্মঘট শুরু করলে বহু থানায় কেউ থাকত না এবং জননিরাপত্তা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
যদিও আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে পুলিশ আবার দায়িত্বে ফিরে আসে, সেনাবাহিনীর উপস্থিতি রাখা হয়েছে একটি নাগরিক-সামরিক সমঝোতার অংশ হিসেবে, দেশের চলমান অস্থিরতার কারণে।
বুধবার বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান ওয়াকার-উজ-জামান প্রকাশ্যে আহ্বান জানান, যেন চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তিনি সতর্ক করেন যে, বেসামরিক দায়িত্বে সেনাবাহিনীর দীর্ঘমেয়াদি মোতায়েন দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে দুর্বল করতে পারে।

দি ডেইলি স্টারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার ক্যান্টনমেন্টে একটি উচ্চপর্যায়ের সমাবেশে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার বলেন, “বাংলাদেশের প্রয়োজন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। এটা সম্ভব শুধু একটি নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমেই, অনির্বাচিত সিদ্ধান্তগ্রহণকারীদের দ্বারা নয়।”
এই মন্তব্য তিনি করেন একটি বিরল ভাষণে, যেখানে তিনি ৩০ মিনিটের বক্তৃতা দেন এবং পরে এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নেন। সারাদেশ থেকে এবং জাতিসংঘে কর্মরত বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী সদস্যরাও এই অনুষ্ঠানে সরাসরি ও ভার্চুয়ালি অংশ নেন। এসময় সকলেই পূর্ণ সামরিক ইউনিফর্মে ছিলেন-যা ঐক্য ও সংকল্পের প্রকাশ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
“সেনাবাহিনী জাতিকে রক্ষার জন্য, পুলিশের কাজ করার জন্য নয়… আমাদের নির্বাচনের পর ব্যারাকে ফিরে যেতে হবে,”- এভাবেই দি ডেইলি স্টার-এ উদ্ধৃত হয়েছেন জেনারেল ওয়াকার।
তার এই মন্তব্য অন্তর্বর্তী ইউনূস প্রশাসনের সঙ্গে মতপার্থক্যের ইঙ্গিত দেয়। ইউনূস প্রশাসন এর আগে বলেছিল, তারা ২০২৬ সালের মাঝামাঝির আগে নির্বাচন করতে চায় না, কারণ তারা রাজনৈতিক ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য সময় নিতে চায় যাতে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা যায়।
স্থানীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের বিবেচনাধীন কিছু মূল উদ্যোগের বিরোধিতাও করছেন জেনারেল ওয়াকার।
উদাহরণস্বরূপ, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে একটি মানবিক করিডোর খোলার প্রস্তাবের বিষয়ে প্রতিবেদন অনুযায়ী তিনি বলেছেন, “কোনো করিডোর হবে না। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে কোনও দরকষাকষি নয়।”
তিনি সতর্ক করেন যে, এমন পদক্ষেপ বাংলাদেশকে একটি বিপজ্জনক ‘প্রক্সি সংঘাতে’ জড়িয়ে ফেলতে পারে। “শুধু জনগণের দ্বারা নির্বাচিত একটি রাজনৈতিক সরকারই এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে,-তিনি বলেছেন বলে দি ডেইলি স্টার জানিয়েছে।
সেনাপ্রধান নির্বাচনী ম্যান্ডেট ছাড়া অন্যান্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন-যার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশি ব্যবস্থাপনায় দেওয়া এবং ইলন মাস্কের স্যাটেলাইট ইন্টারনেট পরিষেবা স্টারলিংক চালুর মতো পদক্ষেপ- যেগুলো, তার মতে, জাতীয় নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।
“সেনাবাহিনী কাউকে আমাদের সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করতে দেবে না,”-দি ডেইলি স্টার তার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে।
এই মন্তব্য তিনি করেছেন এমন এক সময়ে, যখন জনমনে ব্যাপক গুঞ্জন চলছিল-যা এখনও পর্যন্ত সেনাবাহিনী বা সরকার কেউই আনুষ্ঠানিকভাবে অস্বীকার বা স্বীকার করেনি-যে ইউনূস প্রশাসন গত সপ্তাহে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকারকে পদ থেকে সরানোর চেষ্টা করেছিল। যদিও এটি নিশ্চিত নয়, এই গুজব জনপরিসরে প্রধান আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে এবং অন্তর্বর্তী সময়ে বেসামরিক-সামরিক সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
ফলে, সাংবিধানিক প্রক্রিয়া এবং জাতীয় সার্বভৌমত্বের ওপর জোর দিয়ে জেনারেল ওয়াকারের এমন স্পষ্ট বক্তব্য, সেই প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষকদের মতে, সেনাবাহিনীর ভেতরে অন্তর্বর্তী সরকারের ক্রমবর্ধমান বেসামরিক কর্মকাণ্ড নিয়ে উদ্বেগ বাড়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কি টানাপোড়েন আছে?
হ্যাঁ। গত বছরের ৮ আগস্ট গঠিত হওয়ার পর থেকে অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন দিক থেকে ক্রমাগত চাপের মুখে রয়েছে। প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) যেখানে দাবি করছে, জাতীয় নির্বাচন চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হতে হবে, সেখানে এ বছরের শুরুতে গঠিত ছাত্র-নেতৃত্বাধীন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দল বলছে, যেকোনো নির্বাচনের আগে বৃহৎ সংস্কার এবং গত বছর ছাত্র আন্দোলনের ওপর চালানো নির্মম দমন-পীড়নের জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের দায়ী নেতাদের বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে।
বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি অন্যান্য দাবিও তুলেছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত একটি কথিত কারচুপিপূর্ণ ঢাকার মেয়র নির্বাচনে পরাজিত তাদের প্রার্থীকে পুনর্বহাল করতে হবে।
বৃহস্পতিবার বিএনপি এক সংবাদ সম্মেলনে বছরের শেষ নাগাদ নির্বাচন, পাশাপাশি দুইজন ছাত্র উপদেষ্টা ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করে। দলটি হুঁশিয়ারি দেয়, এসব দাবি পূরণ না হলে ইউনূস প্রশাসনের সঙ্গে চলমান সহযোগিতা বজায় রাখা সম্ভব হবে না।
শনিবার ইউনূসের বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং দেশের বৃহত্তম ইসলামি রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী (বিজেআই)-র সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে।
ইউনূস কি পদত্যাগ বিবেচনা করছিলেন?
শনিবার মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে ঘোষণা দেওয়া হয় যে, বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান হিসেবে ইউনূস পদত্যাগ করছেন না।
তবে চলমান অস্থিরতার মধ্যে তার পদত্যাগের গুঞ্জন আরও জোরালো হয়। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোতে খবর আসে, বৃহস্পতিবার বিকেলে মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে ইউনূস পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং জাতির উদ্দেশে এক টেলিভিশন ভাষণ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন-এমন খবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল।
সেই সন্ধ্যায় জুলাই মাসে আগের সরকারের বিরুদ্ধে হওয়া ছাত্র অভ্যুত্থানের নেতা এবং সদ্য গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) প্রধান নাহিদ ইসলাম ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন। তার সঙ্গে আরও ছিলেন দুইজন ছাত্র উপদেষ্টা। তারা ইউনূসকে পদে থাকার অনুরোধ জানান।
বৈঠক শেষে নাহিদ বিবিসি বাংলাকে নিশ্চিত করেন, ইউনূস সত্যিই পদত্যাগের কথা গভীরভাবে বিবেচনা করছিলেন।
শুক্রবার সন্ধ্যা নাগাদ অন্তর্বর্তী সরকারের একাধিক সূত্র আল জাজিরাকে জানায়, ইউনূস এখনও তার অবস্থান নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন।
ইউনূস কেন পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন?
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক চাপ ক্রমেই বাড়তে থাকায় ইউনূস পদত্যাগের চিন্তা করছিলেন বলে ধারণা করা হয়।
সমকাল পত্রিকায় উদ্ধৃত দুজন উপদেষ্টা বলেন, বৃহস্পতিবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে ইউনূস বলেন যে, রাজনৈতিক দল এবং অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে রাষ্ট্র সংস্কার এবং শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রূপান্তর বাস্তবায়নের জন্য এই সহযোগিতা জরুরি ছিল।
তিনি বলেন, তার দায়িত্ব পালন করা এখন প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্বাচন আয়োজনের চাপও বাড়ছে। “বর্তমান পরিস্থিতিতে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাবনা ক্ষীণ,” তিনি বলেন। তার আশঙ্কা, যেকোনো নির্বাচন হস্তক্ষেপের শিকার হবে কিংবা কারচুপি করা হবে এবং তিনি সেই দায় নিতে চান না।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়, ইউনূস তার সরকারি বাসভবন ঢাকার যমুনা স্টেট গেস্ট হাউসে তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁইয়া এবং এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের সঙ্গে বৈঠক করেন।
পরে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া বক্তব্যে নাহিদ নিশ্চিত করেন, ইউনূস সত্যিই পদত্যাগের কথা ভাবছিলেন এবং তাকে উদ্ধৃত করে বলেন, “আমি যেন একপ্রকার জিম্মি হয়ে গেছি এই আন্দোলন আর রাজনৈতিক অচলাবস্থার মধ্যে।”
“আপনারা, সব রাজনৈতিক দল যদি কোনো ঐকমত্যে না পৌঁছাতে পারেন, তাহলে আমি এভাবে কাজ করতে পারব না,”-নাহিদ বলেন, ইউনূস এমন মন্তব্য করেন। তিনি ইউনূসকে ‘দৃঢ় থাকার’ অনুরোধ জানান এবং স্মরণ করিয়ে দেন, জুলাইয়ের অভ্যুত্থানের পর জনগণ তার ওপর যে প্রত্যাশা রেখেছে।
এদিকে, ইউনূসের উচ্চাভিলাষী সংস্কার কর্মসূচি ধাক্কা খাচ্ছে বলেও ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, পুলিশের মতো রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাগুলো এবং বেসামরিক প্রশাসন ক্রমেই অন্তর্বর্তী সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
অনেক উদাহরণের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য হচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)—যা আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও শুল্ক আদায়ের দায়িত্বে রয়েছে-তাকে দুটি পৃথক প্রতিষ্ঠানে ভাগ করার প্রস্তাব। সরকার বলছে, এটি বাংলাদেশের কর ব্যবস্থার দক্ষতা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নেওয়া হয়েছে। তবে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করছেন, কারণ তাদের আশঙ্কা এতে অভিজ্ঞ রাজস্ব কর্মকর্তারা উপেক্ষিত হয়ে পড়বেন।
বিএনপি কী চায়?
আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিএনপির নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, তার দল কখনোই চায়নি যে ইউনূস পদত্যাগ করুন। “কেউ তার পদত্যাগ চায়নি, আমরাও তা চাই না,” তিনি বলেন।
“মানুষ ভোট দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে, গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে চায়। তারা প্রায় দুই দশক ধরে এই অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে,” বলেন খসরু। “আমরা আশা করি তিনি একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করবেন এবং শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। তিনিও তো সে ভাবেই এসেছেন।”
তিনি প্রশ্ন তোলেন, নির্বাচন নিয়ে সময়ক্ষেপণের কারণ কী। “এই বিলম্ব কেন? এটা নিয়ে দেশে এখন তীব্র আলোচনা চলছে।”
খসরু বলেন, বিএনপি চায় প্রশাসন এখন একটি তত্ত্বাবধায়ক রূপে যাক-একটি ছোট পরিসরের মন্ত্রিসভা এবং কিছু বিতর্কিত ব্যক্তিকে সরিয়ে দিয়ে, বিশেষ করে যাদের রাজনৈতিক উচ্চাশা বা সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। “তারা ইতোমধ্যেই একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছে,” তিনি বলেন, ছাত্র প্রতিনিধিদের ইঙ্গিত করে। “অন্যরা পক্ষপাতদুষ্ট মন্তব্য করেছে। আপনি যদি একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিয়ে আন্তরিক হন, তবে তাদের সরিয়ে দিতে হবে।”
তিনি বলেন, সংস্কার ও নির্বাচন একসাথে এগিয়ে যেতে পারে, এতে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। “যেখানে ঐকমত্য আছে, সেখানকার সংস্কার কয়েক সপ্তাহেই শেষ করা সম্ভব।”
খসরু নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা প্রকাশ করেন এবং সুষ্ঠু ভোট নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনীর ভূমিকাকেও ইতিবাচকভাবে দেখেন। “এখন আর শেখ হাসিনার যুগ নয়,” তিনি বলেন, একটি নির্বাচন উপযোগী রাজনৈতিক পরিবেশের ইঙ্গিত দিয়ে।
সাবেক আওয়ামী লীগ নেতাদের বিচারের প্রশ্নে তিনি বলেন, বিচার প্রক্রিয়া একসাথে চলতে পারে। “বিচার বিভাগকে তার কাজ করতে দিতে হবে—যদি প্রয়োজন হয়, নির্বাচিত সরকার এটি চালিয়ে যাবে।”
“পূর্ববর্তী সরকারের আমলে বিএনপি সবচেয়ে বেশি নিপীড়নের শিকার হয়েছে,” তিনি আরও বলেন। “এই বিচারের বিষয়টি একটি জাতীয় ঐকমত্য।”
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ শুক্রবার টেলিভিশনে এক সাক্ষাৎকারে একই মত দেন, “যদি ইউনূস ব্যক্তিগতভাবে দায়িত্ব পালনে অক্ষম হন, তাহলে রাষ্ট্র বিকল্প খুঁজে নেবে।” তবে তিনি আরও যোগ করেন, “তিনি একজন বিশ্বব্যাপী সম্মানিত ব্যক্তি, আমরা আশা করি তিনি পরিস্থিতি বুঝবেন এবং ডিসেম্বরের মধ্যেই একটি নির্বাচন রোডম্যাপ ঘোষণা করবেন।”
অন্য রাজনৈতিক দলগুলো কী চায়?
এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বিএনপির বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করে আল জাজিরাকে বলেন, “জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর সব দলই অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে থাকার কথা ছিল, কিন্তু বিএনপি পুরনো পেশিশক্তির রাজনীতিতেই ফিরে গেছে-এটাই সংকটের মূল।”
তিনি ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে বলেন, “বিএনপি ও সব রাজনৈতিক দলকে জাতীয় স্বার্থে একত্রিত হতে হবে।”
এদিকে, ঢাকাজুড়ে বিক্ষোভ এবং পর্দার আড়ালে বৈঠক চলতে থাকে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পাঁচটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা, যাদের মধ্যে এনসিপিও রয়েছে, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের (আইএবি) প্রধান মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিমের ডাকে দলটির প্রধান কার্যালয়ে এক জরুরি বৈঠকে যোগ দেন।
তারা সকল ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তিকে’ ঐক্যবদ্ধ হয়ে জাতীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষার আহ্বান জানান এবং বলেন, প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর ইউনূসের অধীনে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পক্ষে সব দলকে থাকতে হবে। এসব দলের অনেকেই, যেমন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী (বিজেআই), মনে করে, নির্বাচন হওয়ার আগে কিছু মূল সংস্কার-যেমন আনুপাতিক ভোটব্যবস্থা চালু করা এবং অতীতের নিপীড়নের জন্য দায়ীদের জবাবদিহির আওতায় আনা-প্রয়োজন, না হলে আবারও কর্তৃত্ববাদী শাসনের পুনরাবৃত্তি হতে পারে। তারা মনে করে, এই পরিবর্তন ছাড়া নির্বাচন হলে জনআস্থা ভেঙে পড়বে এবং আরেকটি রাজনৈতিক সংকট দেখা দিতে পারে।
জামায়াতের প্রধান শফিকুর রহমান ফোনে ওই বৈঠকে অংশগ্রহণ করে প্রস্তাবে সমর্থন জানান। বৃহস্পতিবার তিনি ইউনূসকে সব দলের অংশগ্রহণে একটি সংলাপ আয়োজনের আহ্বান জানান।
এরপর শুক্রবার রাতে শফিকুর রহমান ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকের অনুরোধ জানান, প্রস্তাবিত সময় ছিল শনিবার সন্ধ্যা ৬টা।
শুক্রবার রাতে আল জাজিরার সঙ্গে কথা বলার সময় এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, “যত গুজবই থাকুক না কেন, আমরা বিশ্বাস করি ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
তিনি যোগ করেন, “জনগণের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও বিশাল প্রত্যাশা রয়েছে।”
রাজনৈতিক বিভাজনের কথা স্বীকার করলেও তুষার বলেন, “যদি সবাই দলীয় এজেন্ডা পেছনে ফেলে জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়, তাহলে এই সংকট সংলাপের মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব।”
এরপর কী হতে পারে?
রাজনৈতিক বিশ্লেষক রেজাউল করিম রনি আল জাজিরাকে বলেন, ইউনূসের পদত্যাগ নিয়ে আলোচনাটি হয়তো অন্তর্বর্তী কাঠামোর অভ্যন্তরে ঐক্যের অভাব নিয়ে ক্রমবর্ধমান হতাশার প্রতিফলন। “গণঅভ্যুত্থানের পর যে ঐক্য তৈরি হয়েছিল, তা সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর কারণে এখন দুর্বল হয়ে পড়ছে,” তিনি বলেন। “পদত্যাগের আলোচনা একটি বার্তা হতে পারে যে এই ঐক্য নতুন করে গঠন করতে হবে।”
রনি মনে করেন, সরকারের কিছু নিয়োগ রাজনৈতিক দলগুলোকে বিমুখ করেছে এবং এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে যে, কিছু ব্যক্তি কি কেবল সংস্কারের ম্যান্ডেট নিয়ে কাজ করছেন, নাকি তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক এজেন্ডা রয়েছে। তিনি বলেন, “এটা হতে পারে এমন একটি কারণ, যার জন্য সরকার বড় পরিসরে রাজনৈতিক সহযোগিতা অর্জন করতে এবং কার্যকরভাবে পরিচালিত হতে পারছে না।”
রনি আরও বলেন, “এই মুহূর্তে নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নেওয়া মানে হতে পারে সরকারকে বিএনপির সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে সংযুক্ত দেখানো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জনগণেরই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আছে, তারা কাকে নেতা হিসেবে চায়।”
তবে এনসিপির নাহিদ ইসলাম ভিন্নমত পোষণ করেন।
শুক্রবার রাতে ফেসবুকে এক পোস্টে তিনি সতর্ক করে বলেন, গণতান্ত্রিক উত্তরণকে বানচাল করার এবং ১/১১ স্টাইলের আরেকটি ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে।
‘১/১১’ বলতে বোঝায় ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি, যখন রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং দুই বছর ধরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া স্থগিত রাখে।
নাহিদ লিখেছেন, বাংলাদেশকে বারবার বিভক্ত করা হয়েছে, জাতীয় ঐক্য ধ্বংস করা হয়েছে, দেশকে দুর্বল রাখার জন্য।
তিনি ইউনূসকে দায়িত্বে থেকে সংস্কার, বিচার এবং ভোটাধিকার বাস্তবায়নের আহ্বান জানান। তিনি লেখেন, ড. ইউনূসকে দায়িত্বে থেকেই রাজনৈতিক সব সংকটের সমাধান করতে হবে।
তিনি এনসিপির দাবিসমূহও তুলে ধরেন। এগুলো সময়মতো জুলাই সনদ ঘোষণা, ঘোষিত সময়ের মধ্যেই নির্বাচন (যা ইউনূস বারবার বলেছেন ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুলাইয়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে), নির্বাচনের আগে একটি ‘জুলাই সনদ’-এর মাধ্যমে মূল সংস্কার, জুলাইয়ে নিহতদের দৃশ্যমান বিচার এবং সংবিধান প্রণয়নের রূপরেখা, যা একটি সাংবিধানিক পরিষদ ও সংসদের জন্য একযোগে নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে।
এদিকে, জনমনে উদ্বেগ বাড়ছে। শুক্রবার বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে একটি সতর্কতা জারি করে, যেখানে বলা হয়, আগের দিন ছড়িয়ে পড়া একটি ভুয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তি সেনাবাহিনীর লোগো ব্যবহার করেছিল-যা ‘জনগণ ও সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ানো এবং বিভেদ তৈরির একটি সুস্পষ্ট প্রচেষ্টা’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, “গুজবে বিশ্বাস করবেন না। বিভ্রান্ত হবেন না।”
সপ্তাহান্তে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে এখন দেশের সব নজর মুহাম্মদ ইউনূসের দিকে-তিনি কী সত্যিই দৃঢ়ভাবে অবস্থান নিতে পারবেন এবং গত বছরের নাটকীয় গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের দ্বিতীয় রূপান্তরকালে একটি নতুন ঐকমত্য গড়ে তুলতে পারবেন কি না।