মেলবোর্ন, ২৬ মে— সংস্কার একটি চলমান ও ধারাবাহিক প্রক্রিয়া বলে মন্তব্য করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, অল্প ও বেশি সংস্কার বলতে কিছু নেই।
সীমিত সংস্কার চাইলে আগামী ডিসেম্বরে আর বৃহৎ পরিসরে সংস্কার চাইলে ২০২৬ সালের মধ্যে ভোটের যে কথা প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলে আসছেন, দৃশ্যত তার জবাব দিলেন তিনি।
রবিবার বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করা ন্যাশনাল পিপলস পার্টি-এনপিপির অষ্টাদশ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আলোচনায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বিএনপি নেতা এসব কথা বলেন। ভিডিও বার্তাটি তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পাতায়ও পোস্ট করা হয়েছে।
তারেক রহমান সতর্ক করেন, পরাজিত আওয়ামী লীগ ফিরে আসার পথ খুঁজছে এবং কোনো অযুহাতে নির্বাচন দিতে যত দেরি হবে, এই দলটি তত সুযোগ পাবে।

অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার নিয়ে যে কথা বলছে, সেই বিষয়টিও উঠে আসে বিএনপি নেতার বক্তব্যে। তিনি বলেন, “অল্প কিংবা বেশি সংস্কার বলেও কিন্তু কিছু নেই। রাষ্ট্র ও রাজনীতির প্রয়োজনে সংস্কার একটি চলমান ও ধারাবাহিক প্রক্রিয়া।”
জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে জনপ্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য সরকারের প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন অব্যাহত রাখার কথাও বলেন তিনি।
বিএনপি নেতা বলেন, “দেশবাসী আশা করে অন্তর্বর্তী সরকার প্রধানের নেতৃত্বে জনগণ অবিলম্বে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে অবাধ, নিরপেক্ষ একটি জাতীয় নির্বাচন দেখতে পারবে।”
আগের দিন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির প্রতিনিধি দলের আলোচনায় ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন দাবির বিষয়টিও তুলে ধরেন তারেক রহমান। তবে সরকারের তরফে কোনো দিনক্ষণ স্পষ্ট না করায় হতাশার কথাও উঠে আসে তার বক্তব্যে।
তিনি বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানের সঙ্গে দেখা করে রাজনৈতিক দলগুলো আবারও জাতীয় নির্বাচনের তারিখ, সুস্পষ্ট দিনক্ষণ ঘোষণার দাবি জানিয়েছে। বিএনপির দাবি আগামী ডিম্বেরের ভেতরে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে।”
অন্তর্বর্তী সরকারের জবাবদিহিতা নিয়ে প্রশ্ন
তারেক রহমান মনে করেন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের জবাবদিহিতা নেই।
তিনি বলেন, “হাজারো শহীদের রক্তের ওপর প্রতিষ্ঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের নৈতিক এবং রাজনৈতিক বৈধতার হয়ত সংকট নেই। তবে অবশ্যই এই সরকার জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক নয়। সরকার যেহেতু জবাবদিহিমূলক নয়, সেহেতু নৈতিক কারণে সরকারের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা জনগণের সামনে স্পষ্ট থাকা প্রয়োজন।”
“জনগণকে অন্ধকারে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোকে অনিশ্চয়তায় রেখে শেষ পর্যন্ত কোনো পরিকল্পনাই কার্যকর এবং টেকসই হয় না, হবেও না- বলেন তিনি।
সরাসরি ভোটে নির্বাচিত, অন্তর্বর্তী বা তত্ত্বাবধায়ক-সরকারের চরিত্র যাই হোক না কেন, জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য করা না গেলে তারা অজান্তেই স্বৈরাচারী হয়ে উঠে বলেও মন্তব্য করেন তারেক রহমান।
এজন্য ‘হুমকি ধমকি ’উপেক্ষা করে হলেও সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা জারি রাখার আহ্বান জানান তিনি।
গণতান্ত্রিক সরকার না থাকায় সংকট
দেশে স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক সরকার না থাকায় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে স্থবিরতা নেমে এসেছে বলেও মনে করেন তারেক রহমান। বলেন, এক অনিশ্চিতকর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও তৈরি হয়ে। এ কারণেই বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের মধ্যে এক রকমের অস্থিরতা দেখতে পাচ্ছেন তিনি।
“এ কারণে জনগণ প্রতিদিন বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে রাজপথে নেমে আসছে। যদিও দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাদের এই দাবি দাওয়া শোনার কেউ নেই এই মুহূর্তে।”
আওয়ামী লীগকে নিয়ে সতর্কতা
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নাম না দিয়ে দলটির বিষয়ে তারেক রহমান সতর্ক করেন।
তিনি বলেন, “জনগণের ভোটে জবাবদিহিতামূলক সরকার প্রতিষ্ঠায় যে কোনো ধরনের অযুহাত কিংবা গড়িমসির সুযোগ নিয়ে পতিত পরাজিত, পলাতক স্বৈরাচার মাথাচাড়া দিয়ে উঠার অপেক্ষায় রয়েছে কিন্তু।”
জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ‘ফ্যাসিস্ট তাঁবেদার অপশক্তির’ পুনর্বাসনের পথরোধ করা সম্ভব বলেও মন্তব্য করেন বিএনপি নেতা।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগবিরোধী দলগুলোর ঐক্যেরও তাগিদ দেন তারেক রহমান। তিনি বলেন, “পতিত, পরাজিত, বিতাড়িত ফ্যাসিবাদ যেন কোনো রূপে, কোনো ক্রমেই ফিরতে রকমে ফিরতে না পারে, তার পুনরুত্থান ঘটতে না পারে, এই সময়ে সেটিই হোক বাংলাদেশের পক্ষে, গণতন্ত্রের পক্ষে প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য।”
রাষ্ট্রে স্বৈরাচার বা ফ্যাসিবাদ রুখে দিতে জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন বিএনপি নেতা। তিনি বলেন, “জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে সংসদ-সরকার গঠিত হলে অবশ্যই সেই সরকার জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য। এবং এর মাধ্যমে রাষ্ট্রে নাগরিকদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হয়।”
জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতা নিশ্চিত থাকলে সরকারের পক্ষে ফ্যাসিবাদী চরিত্র ধারণ করা সহজ হয় না বলেও মন্তব্য করেন তারেক।
এনবিআর বিলোপের সমালোচনা
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর বিলোপ করে অন্তর্বর্তী সরকারের আদেশেরও সমালোচনা করেন তারেক রহমান।
তিনি বলেন, “বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে এনবিআরের হয়ত সরাসরি কোনো ভূমিকা নেই। তবে রাজস্ব আদায়ের মাধ্যমে বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এনবিআরের ভূমিকা মুখ্য। এমন বাস্তবতায় বাজেট পাসের ঠিক আগ মুহূর্তে এনবিআরের সংস্কার চাপিয়ে দিয়ে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে যে একটি অচলাবস্থা সৃষ্টি করেছে, এটি আমাদের অর্থনীতির জন্য কিন্তু খুব ভালো বিষয় নয়।”
এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক সরকার সবচেয়ে বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে বলেও মন্তব্য করেন বিএনপি নেতা।
প্রতিটি নাগরিককে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে সোচ্চার থাকার তাগিদও দেন তিনি। বলেন, “দেশের জনগণ কিন্তু সরকারের করুণার পাত্র নয়। সরকার অবশ্যই জনগণের কথা শুনতে, জনগণের ন্যায্য দাবি মানতে বাধ্য। এখানে সরকারের মান অভিমান কিংবা রাগ বিরাগের কিন্তু কোনো সুযোগ নেই।”
দেশে ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলো ‘ফ্যাসিবাদের উত্থান’ মোকাবিলায় ৫ আগস্টের মতো ঐক্যবদ্ধ থাকবে বলেও আশাবাদী তারেক রহমান।