মেলবোর্ন, ২৮ মে— লালমনিরহাটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার একটি বিমান ঘাঁটি চীনের সহায়তায় তৈরির খবরে নড়েচড়ে বসেছে ভারত সরকার।
ভূরাজনৈতিক ও সামরিক গুরুত্বের কারণে পাল্টা জবাব হিসেবে ত্রিপুরার আগরতলায় পরিত্যক্ত বিমানবন্দর চালুর উদ্যোগ নিচ্ছে দেশটি।
মঙ্গলবার ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের রংপুর বিভাগের লালমনিরহাটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার একটি বিমান ঘাঁটি চীনের সহায়তায় পুনরায় চালুর পরিকল্পনার খবর ভারতের প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
এই উদ্বেগের কারণ হলো, লালমনিরহাট বিমান ঘাঁটি চালু হলে তা চীনের জন্য দিল্লির দোরগোড়ায় সামরিক উপস্থিতি গড়ার সুযোগ তৈরি করবে। কারণ, ঘাঁটিটি ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে।
আরও উদ্বেগের কারণ হলো, এই ঘাঁটি ভারতের শিলিগুড়ি করিডর থেকেও মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে।

শিলিগুড়ি করিডর, যেটি ‘চিকেনস নেক’ নামে পরিচিত, এটি মাত্র ২২ কিলোমিটার প্রশস্ত একটি ভূখণ্ড, যা ভারতের সাতটি উত্তর-পূর্ব রাজ্যকে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত রেখেছে।
এই করিডরের পশ্চিমে নেপাল এবং উত্তরে ভুটান রয়েছে। ভারতের সঙ্গে এই দুই দেশের সম্পর্ক স্থিতিশীল। কিছু সূত্র বলছে নেপালের জনগণ ২০১৮ সালে বিলুপ্ত হওয়া ২৪০ বছরের পুরনো হিন্দু রাজতন্ত্র ফেরানোর জন্য রাজা জ্ঞানেন্দ্র শাহকে সামনে আনতে চাইছে।
এনডিটিভির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “তবে দক্ষিণ সীমান্ত থেকে উদ্বেগজনক বার্তা আসছে।”
যদি চীন সত্যিই লালমনিরহাট বিমান ঘাঁটি সংস্কারে অর্থায়ন করে, তাহলে এর আওতায় তারা সেখানে যুদ্ধবিমান, রাডার, নজরদারি সরঞ্জামসহ সামরিক সরঞ্জাম মোতায়েন করতে পারবে।
এই পরিস্থিতিতে ভারত উত্তর ত্রিপুরার কৈলাশহরে ৩০ বছর আগে বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি বেসামরিক বিমানবন্দর দ্রুত চালুর প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
এই বিমানবন্দরটি বেসামরিক ব্যবহারের জন্যই থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে যুদ্ধ বা জরুরি অবস্থার সময়ের কথা বিবেচনায় রেখে উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্যান্য প্রধান বিমানবন্দরের মতো এখানেও যুদ্ধবিমান ও বিমানের উড়ান, অবতরণ ও জ্বালানি নেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হবে।
তবে কৈলাশহর বিমানবন্দরটি পুনরায় চালুর পেছনে শুধু লালমনিরহাটের জবাব নয়। বরং এটি একটি রাজনৈতিক বার্তাও, যা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান নিয়ে ভারতের উদ্বেগের বহিঃপ্রকাশ।

২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দুই দেশের সম্পর্ক উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে ওঠে।
শেখ হাসিনা ভারতের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র ছিলেন। তিনি চীনের উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে একটি নির্ভরযোগ্য প্রতিরোধ হিসেবে কাজ করতেন। তবে তার সরকারের বিরুদ্ধে চাকরি ও কলেজ কোটা নিয়ে ছাত্রদের প্রতিবাদে ব্যাপক উত্তেজনা তৈরি হয়। শেষপর্যন্ত তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন এবং শান্তিতে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়।
এনডিটিভি বলছে, এই সরকার এখনও নির্বাচন ঘোষণা করেনি। ভারতের প্রত্যাশার তুলনায় ইউনুস সরকার চীন ও পাকিস্তানের প্রতি বেশি ঝুঁকে পড়েছে এবং দিল্লির প্রতি কম সদয় হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে ভারত সীমান্ত ঘেঁষা এবং ‘চিকেনস নেক’ এর এত কাছে একটি চীনের সহায়তায় পরিচালিত বিমানঘাঁটির সম্ভাবনা নিয়ে চরম উদ্বিগ্ন।
ইতিহাস থেকে যা জানা যায়
এনডিটিভি লিখেছে, ত্রিপুরার কৈলাশহর বিমানবন্দরটি ১৯৯০-এর দশকে বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তার আগে ১৯৭১ সালের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
৫৪ বছর আগে এই বিমানবন্দর থেকেই ‘কিলো ফ্লাইট’ নামের একটি গোপন বাংলাদেশি প্রতিরোধ ইউনিটের প্রথম মিশন শুরু হয়। এটি ভারতীয় বিমানবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হিট-অ্যান্ড-রান (আঘাত করে সরে যাওয়া) পদ্ধতির একটি বাহিনী ছিল।
কিলো ফ্লাইট ইউনিটে ছিল কানাডিয়ান তৈরি ডিএইচসি-৩ ওটার বিমান এবং ফরাসি অলুয়েট-২ হেলিকপ্টার। এগুলোতে রকেট ও মেশিনগান ছিল।

তাদের সঙ্গে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি ডিসি-৩ ডাকোটা বিমান, যেটি লজিস্টিক সাপোর্ট দিত।
এই কিলো ফ্লাইট ইউনিট পরবর্তীতে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গঠনের ভিত্তি তৈরি করে।
কৈলাশহরের গুরুত্ব
কৈলাশহর বিমানবন্দর পুনরায় চালু করার মাধ্যমে ত্রিপুরার বিমান সংযোগ উন্নত হবে। বর্তমানে এই রাজ্যে কার্যত একটি মাত্র বড় বিমানবন্দর রয়েছে, যা রাজধানী আগরতলায়।
২০২৫ সালের ২৬ মে ভারতের বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল বহুদিন পরিত্যক্ত এই বিমানবন্দর এবং তার আশপাশের এলাকা পরিদর্শন করে।
পরিদর্শনের পর তারা সাংবাদিকদের বলেন, “পরবর্তী পরিকল্পনা রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে করা হবে।”
চীনের সংশ্লিষ্টতার তথ্য নেই: বাংলাদেশ সেনাবাহিনী
এনডিটিভির এই প্রতিবেদনের একদিন আগে সোমবার ঢাকায় বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন সেনাবাহিনীর মিলিটারি অপারেশনসের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজিম-উদ-দৌলা।
ঢাকা সেনানিবাসের অফিসার্স মেসে অনুষ্ঠিত এই ব্রিফিংয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সেনাবাহিনী তাদের অবস্থান জানায়।
দৈনিক প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, লালমনিরহাট বিমানবন্দর নিয়ে অতীতে অনেক টানাপোড়েন ছিল উল্লেখ করে একজন সাংবাদিক জানতে চান, এই বিমানবন্দর ভবিষ্যতে অন্য কোনো দেশের ব্যবহারের সম্ভাবনা রয়েছে কি না? এ ক্ষেত্রে চীন ও ভারত দুটি দেশের প্রসঙ্গ টানেন ওই সাংবাদিক।
জবাবে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজিম-উদ-দৌলা বলেন, ‘দেশের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে আমাদের প্রয়োজনীয়তাও বেড়েছে। লালমনিরহাটের বিমানবন্দরটি অনেক পুরোনো, তবে ব্যবহার হয়নি। প্রয়োজনের নিরিখে সেটাকে আবার সচল করা হচ্ছে। নতুন করে কাজে লাগানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।’
ব্রিগেডিয়ার নাজিম বলেন, ‘দেশের সম্পদ দেশের প্রয়োজনে ব্যবহার হবে, এটাই তো স্বাভাবিক। এত দিন প্রয়োজন হয়নি, ব্যবহার হয়নি। এখন প্রয়োজন পড়েছে, ব্যবহার হচ্ছে। নতুন করে সংস্কার করা হচ্ছে। কলেবর বৃদ্ধি করা হচ্ছে। সেখানে নতুন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হবে।’
চীন ওই বিমানবন্দর ব্যবহার করবে কি না, এ বিষয়ে নাজিম-উদ-দৌলা বলেন, এ–সংক্রান্ত কোনো তথ্য তার কাছে নেই।
তিনি মনে করেন, দেশের নিরাপত্তা বা স্বার্থ বিঘ্নিত হয়, এ রকম কোনো দেশকে অনুমতি দেওয়ার বা সম্পৃক্ত করার ব্যাপারে নিশ্চয়ই সরকার ভেবে দেখবে।