মেলবোর্ন, ২৮ মে— গত ৮ মে রাত আটটার কিছু পর জম্মুর আকাশে দেখা যায় লাল ফ্লেয়ারের আলো। পাকিস্তান থেকে আসা ড্রোন ঠেকাতে ভারতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তখন গুলি ছুড়ছে। দক্ষিণ এশিয়ার এই দুই চিরবৈরী পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে সম্পর্ক যতটা পুরনো, যুদ্ধের ধরন এখন ততটাই নতুন।
এতদিন যুদ্ধবিমান, কামান আর ক্ষেপণাস্ত্রের দাপট থাকলেও এবার ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ হয় ড্রোন ফ্রন্টে। চার দিনের টানা সংঘর্ষে দুই পক্ষই নজিরবিহীন হারে ব্যবহার করেছে মানববিহীন আকাশযান বা আনম্যানড এরিয়াল ভেহিক্যাল-ইউএভি।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, এই সংঘর্ষের পর ভারত ও পাকিস্তান ড্রোনে বিনিয়োগ আরও বাড়াচ্ছে।
দুই পক্ষই ড্রোনকে এখন সামরিক কৌশলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে দেখছে। কারণ এগুলো ব্যবহার করলে পাইলটের জীবন হুমকির মুখে পড়ে না, আবার লক্ষ্যবস্তুতে নির্ভুল বার্তাও পৌঁছানো যায়—তাও যুদ্ধ বাধানোর বড় ঝুঁকি ছাড়াই।
ভারতের ড্রোন ফেডারেশনের প্রধান স্মিত শাহ জানান, ভারতীয় সরকার আগামী এক থেকে দুই বছরের মধ্যে প্রায় ৪৭০ মিলিয়ন ডলার খরচ করতে পারে ইউএভি খাতে, যা আগের তুলনায় তিনগুণ বেশি। মে মাসেই জরুরি সামরিক ক্রয়ের জন্য ভারত বরাদ্দ দিয়েছে আরও ৪.৬ বিলিয়ন ডলার।
আইডিয়াফোর্জ টেকনোলজির ভাইস প্রেসিডেন্ট বিশাল সাক্সেনা জানান, সেনাবাহিনীর আগ্রহের পরিপ্রেক্ষিতে এখন ড্রোন নির্মাতাদের দ্রুত ডেমো ও ট্রায়ালের জন্য ডাকা হচ্ছে, যেন সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়।

পাকিস্তানও পিছিয়ে নেই। ইসলামাবাদের প্রতিরক্ষা সূত্র জানিয়েছে, ব্যয়বহুল যুদ্ধবিমানের ঝুঁকি না নিয়েই পাকিস্তান এখন ইউএভি সংগ্রহ বাড়ানোর পথে হাঁটছে। চীন ও তুরস্কের সহায়তায় দেশটির নিজস্ব উৎপাদন সক্ষমতাও গড়ে উঠছে। বিশেষ করে তুরস্কের প্রতিরক্ষা কোম্পানি বায়কার ও পাকিস্তানের জাতীয় মহাকাশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পার্ক যৌথভাবে তৈরি করছে ওয়াইএইচএ-৩ ড্রোন, যা দু-তিন দিনের মধ্যেই উৎপাদন করা সম্ভব।
মে মাসের সংঘর্ষ: ঘনঘন গোলাগুলি আর ছায়াযুদ্ধ
২২ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকবাহী গাড়িতে হামলায় ২৬ জন নিহত হলে দিল্লি সরাসরি ইসলামাবাদকে দায়ী করে। ৭ মে প্রতিশোধ হিসেবে পাকিস্তানের তথাকথিত সন্ত্রাসী ঘাঁটিতে বিমান হামলা চালায় ভারত।
জবাবে ৮ মে পাকিস্তান সীমান্তজুড়ে প্রায় ৩০০-৪০০ ড্রোন ঢুকিয়ে ভারতের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানায়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর দাবি, ৩৬টি স্থানে একযোগে এসব ড্রোন পাঠানো হয়েছিল।
তুরস্কের আসিসগার্ড, ওয়াইএইচএ-৩ ও পাকিস্তানের নিজস্ব শাহপার-২ ড্রোন ছিল এই অভিযানে। তবে বিস্ময়করভাবে, ভারতের স্নায়ুযুদ্ধ যুগের পুরনো কামানগুলোকে আধুনিক রাডার ও সংযোগ ব্যবস্থায় আপগ্রেড করার পর সেগুলোই একের পর এক ড্রোন নামিয়ে দেয়।
ভারতের পক্ষ থেকে পাঠানো হয় ইসরায়েলি হ্যারপ, পোলিশ ওয়ারমেট ও ভারতীয় ঘরোয়া ইউএভি। কিছু ড্রোন সরাসরি সন্ত্রাসী অবকাঠামো লক্ষ্য করে হামলা চালায়। হ্যারপ ড্রোনগুলো আকাশে ঘোরাঘুরি করে থেকে ঠিক সময়ে নিচে নেমে আত্মঘাতী হামলা চালায়।

এই হ্যারপ ঠেকাতে পাকিস্তান ভুয়া রাডার স্থাপন করে বিভ্রান্ত করার কৌশল নেয় এবং নিচে নামার সময় গুলি করে সেগুলো নামিয়ে দেয়—এমন দাবি করে পাকিস্তানি সূত্রগুলো।
কে জিতল, সেটা ‘কে’ জানে! কিন্তু ড্রোনই ভবিষ্যৎ
দুই পক্ষই নিজেদের সফল দাবি করেছে। ভারতের সেনা কর্মকর্তারা বলছেন, বড় সামরিক প্ল্যাটফর্ম ঝুঁকিতে না ফেলে সফলভাবে হামলা চালানো গেছে। পাকিস্তান বলছে, তাদের ড্রোনগুলো নজর এড়িয়ে সফলভাবে ভারতীয় সামরিক স্থাপনায় আঘাত হেনেছে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান বলছেন, “ড্রোন প্রযুক্তি তুলনামূলকভাবে সস্তা, কিন্তু শক্তিমত্তার বার্তা দিতে সক্ষম।” নিউস্পেস ও আইডিয়াফোর্জের মতো কোম্পানিগুলো লুটার মুনিশন ড্রোনে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে, যেগুলো অপেক্ষা করতে পারে, লক্ষ্য বাছাই করে হামলা চালাতে পারে।
তবে ভারতের ইউএভি খাতের এক বড় দুর্বলতা হলো—এখনও চীনের তৈরি ম্যাগনেট ও লিথিয়াম ব্যাটারির উপর নির্ভরতা। এটি সরবরাহ চেইনে বড় সংকটের আশঙ্কা জাগায়।
ড্রোন ফেডারেশনের ভাষায়, “এই যুদ্ধ দেখিয়ে দিয়েছে—ড্রোন যুদ্ধ এখন আর কাল্পনিক ভবিষ্যৎ নয়, এটি এখনকার বাস্তবতা।”