মেলবোর্ন ৭ জুন- টেসলা ইতিমধ্যেই ২০২৪ সালের প্রথম প্রান্তিকে বড় আর্থিক ধাক্কা খেয়েছিল। এর মধ্যেই সিইও ইলন মাস্কের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সংঘাত পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। বৃহস্পতিবারের একমাত্র দিনে টেসলার বাজার মূল্য থেকে এক লাফে মুছে যায় ১৫২ বিলিয়ন ডলার—এটি কোম্পানির ১৫ বছরের পুঁজিবাজার ইতিহাসে একক বৃহত্তম পতন।
ঘটনার সূত্রপাত মাস্কের রাজনৈতিক অবস্থান ও কংগ্রেসে বিতর্কিত বাজেট বিল নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে মতবিরোধ থেকে। মাস্ক এই বিলকে “ঘৃণ্য” বলে অভিহিত করে তার সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম X-এ অনুসারীদের আহ্বান জানান বিলটি বাতিল করার জন্য।
ট্রাম্প পাল্টা জবাবে মাস্ককে “পাগল” বলেন এবং তার কোম্পানিগুলোর জন্য সরকারি চুক্তি ও ভর্তুকি বাতিলের হুমকি দেন।
মাস্ক সরাসরি লিখে ফেলেন, “Go ahead, make my day।”

এই অনলাইন যুদ্ধ মুহূর্তেই রাজনৈতিক বিরোধ থেকে ব্যবসায়িক বিপর্যয়ে পরিণত হয়। শেয়ারবাজারে এর প্রতিক্রিয়া ছিল তীব্র—টেসলার শেয়ারমূল্য ১৪ শতাংশ হ্রাস পায়, যা বিনিয়োগকারীদের জন্য চরম ধাক্কা। মাস্কের ব্যক্তিগত সম্পদ একদিনেই ৩৪ বিলিয়ন ডলার কমে যায়। বিশ্লেষকরা বলছেন, মাস্কের আচরণই এই সংকটের অন্যতম কারণ।
টেসলা ইতিমধ্যেই একাধিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। চীনের স্বল্পমূল্যের বৈদ্যুতিক যান প্রস্তুতকারকদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় হার, ইউরোপে বাজারে শ্লথতা এবং প্রথম প্রান্তিকে ২০ শতাংশ গাড়ি বিক্রির পতন—এসব কিছুর মাঝে রাজনৈতিক বিতর্ক কোম্পানির জন্য নতুন চাপ সৃষ্টি করেছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ট্রাম্পের প্রশাসন শুল্ক ছাড়, রপ্তানি সুবিধা ও সরকারি সহায়তা বন্ধ করতে পারে, যা টেসলার উৎপাদন ও ব্যবসায়িক পরিকল্পনায় বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
এদিকে মাস্কের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও কট্টর অবস্থান আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। জার্মানির উগ্র-ডানপন্থী AfD দলের প্রতি তার সমর্থন এবং এক আলোচিত জনসভায় বিতর্কিত অভিবাদনের ভঙ্গি—এসব নিয়ে ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন শহরে টেসলা বিরোধী প্রতিবাদ দেখা গেছে। নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কোয়ার এবং লন্ডনের রাস্তায় টেসলা-বিরোধী বিজ্ঞাপন দেখা গেছে, যেখানে কিছু ইভিকে “swasticar” বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। ভ্যাঙ্কুভার অটো শোতে টেসলাকে বাদ দেওয়া হয়েছে নিরাপত্তার আশঙ্কায়।
শুধু বাইরের প্রতিক্রিয়াই নয়, কোম্পানির অভ্যন্তরেও চাপ বাড়ছে। উৎপাদনে সমস্যা, সাইবারট্রাকের একাধিক রিকল, এবং নতুন মডেল আনতে ব্যর্থতা—এসব বিষয় বিনিয়োগকারীদের আশাহত করছে। টেসলার বর্তমান বাজার মূল্য অন্যান্য মার্কিন গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায় অনেক বেশি হলেও বাস্তব পরিস্থিতি বলছে, কোম্পানিটি তার আগের গতি হারিয়ে ফেলছে।
এর মাঝেই মাস্ক নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছেন রোবোট্যাক্সি ও হিউম্যানয়েড রোবটের। যদিও এই খাতে গুগলের Waymo অনেক এগিয়ে গেছে এবং টেসলা এখনও সীমিত পরিসরে পরীক্ষা চালাচ্ছে। মাস্ক বলছেন, অস্টিনে চলতি মাসে একটি পরীক্ষামূলক স্বয়ংক্রিয় গাড়ি পরিষেবা চালু হবে, যেখানে ১০ থেকে ২০টি Model Y গাড়ি চালানো হবে। তবে অনেকেই এটিকে বাস্তবায়নের আগে বিনিয়োগকারীদের মন জয় করার প্রচেষ্টা বলে মনে করছেন।
টেসলার অভ্যন্তরে নেতৃত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। নিউ ইয়র্ক ও মেরিল্যান্ডের অর্থ নিয়ন্ত্রকরা জানিয়েছেন, কোম্পানির বোর্ড মাস্কের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে। তারা বলছেন, মাস্কের আচরণ ও রাজনৈতিক বিতর্ক কোম্পানির ভবিষ্যতের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এমন এক সময়ে, যখন বিশ্বজুড়ে বৈদ্যুতিক গাড়ির চাহিদা বাড়ছে এবং টেক-ইনোভেশন কোম্পানিগুলো সামনের সারিতে আসছে, টেসলা এক অপ্রত্যাশিত সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ইলন মাস্কের নাম এখনও টেসলার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—টেসলা কি মাস্কের বাইরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে?
বর্তমানে মাস্ক-ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ডাক দিয়েছেন, যা মধ্যমপন্থীদের প্রতিনিধিত্ব করবে বলে দাবি। যদিও এই রাজনৈতিক উচ্চাশা ভবিষ্যতে কী ফল বয়ে আনবে, তা সময়ই বলবে। কিন্তু এ সপ্তাহের নাটকীয় ঘটনার পর এক বিষয় নিশ্চিত—টেসলা হোক বা মাস্ক, তারা হোয়াইট হাউসের প্রভাব থেকে সহজে মুক্তি পাচ্ছে না।