মেলবোর্ন, ১২ জুন— বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম ইতিহাসের সর্বোচ্চ স্বাধীনতা ভোগ করছে বলে দাবি করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
যুক্তরাজ্য সফরে থাকা সরকার প্রধান বুধবার দেশটির থিংকট্যাঙ্ক চ্যাথামস হাউজে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই দাবি করেন।
চ্যাথাম হাউসের পরিচালক ব্রনওয়েন ম্যাডক্স এই আলোচনায় প্রধান উপদেষ্টাকে নানা বিষয়ে প্রশ্ন করেন।
একটি প্রশ্ন ছিল, “বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরা হয়েছে বলে অনেকে বলে আসছেন। আপনি কী বলবেন?”
ইউনূস জবাব দেন, “এটা সত্য না। তারা জীবনের কখনও এত স্বাধীনতা পায়নি। তারা যা খুশি বলতে পারে।”
অর্থনীতি শূন্য না, ঋণাত্মক
দেশের অর্থনীতির অবস্থা তুলে ধরতে বলা হলে প্রধান উপদেষ্টা বলেন. “আমরা শূন্যতে না, আমরা ঋণাত্মকে আছি। শূন্য হলেও তো ইতিবাচকভাবে বলা যেত। এখান থেকে শুরু করা যায়।”
কেন ঋণাত্মক, তার ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের ওপর বিপুল সংখ্যক বিদেশি ঋণের বোঝা তৈরি হয়েছে। আমাদের অনেক মেগা প্রকল্প করা হয়েছে, যাতে করে এগুলো থেকে অনেক টাকা বানানো যায়। এখন অর্থ পরিশোধের সময় এসেছে, কিন্তু আমাদের কোনো অর্থ নেই।”
বাংলাদেশ থেকে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে গেছে বলে দাবি করে ইউনূস বলেন, “আমরা এখানে আছি যে, সম্পদ চলে গেছে, আমাদের ওপর ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়েছে।”
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তলানিতে বলেওও দাবি করেন তিনি। বলেন, “ব্যাংকিং খাত ধসে পড়েছে। …এই ব্যাংক খাত থেকে তাদের সমর্থকদেরকে টাকা দেওয়া হয়েছে, সেটা আর ফেরত দিতে হবে না। আমাদেরকে এটা পুনর্গঠন করতে হচ্ছে।”
সংকটের সময় প্রবাসী বাংলাদেশিরা বিপুল পরিমাণ রেমিটেন্স পাঠাচ্ছে জানিয়ে ইউনূস বলেন, “এটা আমাদেরকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। রেমিটেন্স বেড়েই চলেছে। এখন ব্যালেন্স অব পেমেন্ট সিচুয়েশন পুরোপুরি পাল্টে গেছে।”
আইএমএফ নিয়ে প্রশ্নে যে জবাব
উপস্থাপিকা প্রশ্ন রাখেন, “আইএমএফ তো পরের সরকারের অপেক্ষায় থাকতে চাইছে না। তারা চায় আপনারা জনগণের কাছ থেকে আরও বেশি কর আদায় করুন।”
এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ইউনূস বলেন, “আমরা সারা বিশ্বের সব দেশ থেকে সর্বাত্মক সমর্থন পেয়েছি। তারা ভাবছে, ‘অবশেষে আমরা একটি সরকার পেয়েছি যার সঙ্গে আমরা কথা বলতে পারি, আমরা কাজ করতে পারি’। তারা বলছে, ‘আপনার কী সহযোগিতা দরকার কেবল আমাদেরকে বলুন, আমরা সহায়তা করতে উৎসাহ নিয়ে অপেক্ষায় আছি’।
“এটা আমাদেরকে মানসিকভাবে উদ্দীপ্ত করেছে যে, আমরা একা নই। যুক্তরাজ্য এই দেশের একটি। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, চীন থেকে শুরু করে প্রতিটি দেশই সমর্থন ও সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে এসেছে।”
“আইএমএফও সহযোগিতা করছে। বিশ্বব্যাংকও সহায়তা করছে” বলে মন্তব্য করে আইএমএফের শর্ত মেনে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়হার বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়ার কথা তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টা।
তিনি জানান, এই পদক্ষেপ নিতে নানা শঙ্কা কাজ করলেও শেষে এর কোনো প্রভাব পড়েনি।
ভারত ও চীনের সঙ্গে নিয়ে সম্পর্ক কেমন?
উপস্থাপিকার প্রশ্ন ছিল, “আমরা চীন ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে আসি। শেখ হাসিনা সরকার ভারতের সঙ্গে অনেকটা সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে। তিনি এখন সেখানে আছেন। এরপর থেকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক কিছুটা শীতল। অন্যদিকে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক এখন উষ্ণ। আপনার পররাষ্ট্র নীতি আসলে কী?”
ইউনূস বলেন, “আমরা সবার কাছে যাচ্ছি। আগেই বলেছি সারা বিশ্বের সব দেশের সরকার আমাদের প্রতি খুবই সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক দেখাচ্ছে। আমরা থ্যাংকফুল। আমরা সম্পর্ক আরও গভীর করতে চাই। আমরা এমন সহযোগিতা চাইছি যা এর আগে কখনও তারা করেনি।”
এরপর তিনি দুর্নীতির কথা তোলেন। বলেন, এটি বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা। এ নিয়ে তিনি বিশ্বনেতাদের সঙ্গেও কথা বলছেন। এ থেকে উত্তরণের পথ খুঁজছেন।
এই সমস্যা থেকে উত্তরণের বিষয়ে আত্মবিশ্বাসের কথা তুলে ধরে ইউনূস বলেন, “এটা একটা ঐতিহাসিক মুহূর্ত। আমরা এখন এটা করতে না পারলে আর কখনও পারব না। আমরা নিজেদের বলেছি, ইতিহাস আমাদের জন্য জানলা খুলে দিয়েছে। আমাদেরকে কাজটা করতে হবে যা কোনো সরকার করতে পারেনি।”
সব সরকারের সমর্থক ও স্বার্থগোষ্ঠী থাকলেও অন্তর্বর্তী সরকারের তা নেই বলে মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, “আমাদের তো কারও ভোটের দরকার নেই। আমাদের নৈতিক মনোবল আছে।”
দুর্নীতি নির্মূলে সরকারি সেবা এক ছাতার নিতে আনতে বাংলাদেশ সার্ভিস সেন্টা প্রতিষ্ঠার কথা জানান ইউনূস। বলেন, সেখানে প্রশিক্ষিত তরুণরা সব সরকারি কাজ করে দিচ্ছে।
বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে সরকার কী করছে?
বহুজাতিক জ্বালানি কোম্পানি শেভরনের এক প্রতিনিধি প্রশ্ন রাখেন, “সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে আপনার সরকার কী পদক্ষেপ নিচ্ছে, বিশেষ করে জ্বালানি খাতে?”
জবাবে ইউনূস বলেন, “আমরা খুবই সক্রিয়। আমরা ইনভেস্টরস সামিট করেছি। শেভরনও এতে অংশ নিয়েছে। আমরা অন্য অনেক আমন্ত্রণ জানিয়েছি, আমরা তাদেরকে এমন সব প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।”
বাংলাদেশ বিশ্বের প্রডাকশন হাব হতে চাইছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের তরুণ জনগোষ্ঠী আছে যারা তোমাদের জন্য কাজ করতে প্রস্তুত। আমরা অন্য সব সুযোগ সুবিধা দিতে প্রস্তুত আছে। কেবল প্লাগ অ্যান্ড প্লের মতো তোমরা তোমাদের কারখানা এখানে নিয়ে এসো এবং পণ্য সারা বিশ্বে বিক্রি করো।
“আমরা আরও প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আমাদের বন্দর সুবিধাকে বিশ্বমানের করে দেব, যাতে করে বাংলাদেশে কোনো পণ্য আনা বা এখান থেকে নিয়ে যেতে কোনো সমস্যা না হয়।”
বাংলাদেশে বিনিয়োগ করলে আঞ্চলিক বাজার ধরা যাবে বলেও মন্তব্য করেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, “এখানেও একটি বড় বাজার আছে। নেপালে পণ্য পাঠানো যাবে। নেপালের কোনো সমুদ্রবন্দর নেই। আপনারা নেপাল, ভুটান, ভারতের সেভেন সিস্টারসে পণ্য পাঠাতে পারবেন।
“এই অঞ্চল নিজেই একটি খুবই একটি সম্ভাবনাময় বাজার।”