লেখক: অ্যাডাম হার্ভে | অনুবাদ ও বিশ্লেষণ: OTN Bnagla
মেলবোর্ন, ১৫ জুন— ইরান এখন আহত, অপমানিত এবং দুর্বল—তবুও সেটি চূড়ান্তভাবে বিপজ্জনক এক রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক ইসরায়েলি হামলাগুলোর ফলে ইরানের সামরিক ও পরমাণু বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তারা নিহত হয়েছেন, কারও কারও মৃত্যু ঘটেছে তাদের নিজের বাড়িতেই। ইসরায়েলি কমান্ডোরা সফলভাবে ইরানের উচ্চ নিরাপত্তা-বেষ্টিত আকাশ প্রতিরক্ষা ঘাঁটিতেও হামলা চালিয়েছে। মোসাদের এজেন্টরা ড্রোন ব্যবহার করে ইরানের অভ্যন্তরে গোপনে প্রবেশ করেছে, যা দেশটির বহুল-আতঙ্কিত অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাব্যবস্থার দুর্বলতা প্রকাশ করেছে।
২০১৯ সালে লেখক তেহরানে সফরকালে একটি মন্ত্রিসভার প্রতিনিধি সাথে থাকা সত্ত্বেও একজন নিরাপত্তাকর্মী তাকে গুপ্তচর বলে সন্দেহ করে। অথচ একই নিরাপত্তা বাহিনী মোসাদের প্রবেশ ঠেকাতে ব্যর্থ।
পাল্টা জবাবে ইরানের সীমাবদ্ধতা
ইরানের জন্য এখন প্রতিশোধ নেওয়া অনেক কঠিন। দীর্ঘদিনের মিত্র বাশার আল-আসাদ এখন পলাতক। হিজবুল্লাহ, ইরানের অন্যতম প্রধান প্রক্সি বাহিনী, ইতিমধ্যেই নেতৃত্বহীন এবং ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। ইয়েমেনের হুথিরা মাঝে মধ্যে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়লেও তারা ইসরায়েলের অস্তিত্বের জন্য বড় হুমকি নয়।
এই পরিস্থিতিতে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা, ৮৬ বছর বয়সী আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেয়ীর উপর প্রবল চাপ রয়েছে। যদিও তার শাসন ব্যবস্থার পতনের সম্ভাবনা আপাতত নেই, এবং জনগণের মধ্যে ক্ষোভ থাকলেও তেমন শক্তিশালী কোনো বিরোধী দল বা সংগঠিত আন্দোলন নেই, তবুও প্রতিক্রিয়া না দেখালে তার নেতৃত্বকে দুর্বল মনে করা হবে।
সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ আশঙ্কা
সবচেয়ে সহজ এবং তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হতে পারে আরও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা—এটি ইসরায়েলের জন্য সরাসরি হুমকি। গত অক্টোবরেও ইরান প্রায় ১৮০টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল, যার মধ্যে প্রায় দুই ডজন তেল আবিবে আঘাত হানে।
তবে যদি ইসরায়েলে বড় ধরনের প্রাণহানি ঘটে, তাহলে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়াও হবে আরও ভয়াবহ এবং বিস্তৃত। তখন ইসরায়েল শুধু সামরিক ঘাঁটি বা পরমাণু গবেষণা কেন্দ্রে নয়, বরং রাজনৈতিক বা ধর্মীয় নেতৃত্বের ওপরও হামলা চালাতে পারে।
ইতোমধ্যেই ইরানের বিভিন্ন সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল ঘাঁটি ধ্বংস হয়েছে এবং দুর্বল আকাশ প্রতিরক্ষা এখন পর্যন্ত একটি ইসরায়েলি বিমানও ভূপাতিত করতে পারেনি।
এই মুহূর্তে ইরানের ভেতরে যে মাত্রার আতঙ্ক ও সন্দেহ বিরাজ করছে, তা অস্বাভাবিক নয়। যদি মসাদ এমনকি বিপ্লবী গার্ডের প্রধান হোসেইন সালামি বা সেনাবাহিনীর চিফ অফ স্টাফ মোহাম্মদ বারঘেরিকে খুঁজে বের করতে পারে, তাহলে তারা রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতাদেরও টার্গেট করতে পারে—এই ভয় ইরানকে এক দারুণ অনিশ্চয়তার মধ্যে রেখেছে।
বিকল্প লক্ষ্যবস্তু ও আন্তর্জাতিক ঝুঁকি
ইসরায়েলকে সরাসরি টার্গেট করা কঠিন হওয়ায় ইরান হয়তো বিকল্প লক্ষ্য বেছে নিতে পারে—যেমন, ইরাকে মার্কিন ঘাঁটি, সৌদি আরবের তেল শোধনাগার, পারস্য উপসাগরের নৌপথ, অথবা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ইসরায়েলি বা মার্কিন বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলা।
যদিও যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি হামলায় অংশ নেয়নি, ইরান এটিকে মার্কিন-সমর্থিত আক্রমণ হিসেবেই বিবেচনা করছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ও মার্কো রুবিও জানিয়েছেন, তারা এই হামলার পূর্বাভাস পেয়েছিলেন এবং এর প্রতি সমর্থনও জানিয়েছেন।
কূটনৈতিক সম্ভাবনা ও পরমাণু কর্মসূচি
ইরানের পরমাণু কর্মসূচি বন্ধে চলমান আলোচনা এখন কার্যত স্থবির। ইসরায়েল কৌশলে গুরুত্বপূর্ণ পরমাণু স্থাপনায় হামলা চালালেও, ইউরেনিয়াম মজুদের স্থানগুলোতে আঘাত হানেনি—যেগুলো মাটির গভীরে রক্ষিত।
এই হামলা হয়তো ইরানকে আলোচনার টেবিলে ফিরিয়ে আনতে পারে, তবে এটি ঠিক ততটাই সম্ভব যে, ইরান এখন সকল আলোচনার ভান ত্যাগ করে গোপনে পরমাণু সমৃদ্ধকরণ ত্বরান্বিত করবে, এমন এক গভীর স্তরে যেখানে মসাদ কিংবা ইসরায়েলি বিমানবাহিনী পৌঁছাতে পারবে না।
যদিও কৌশলগত দিক থেকে ইসরায়েলের এখন স্পষ্ট সুবিধা রয়েছে, ইরানের অপমানিত এবং কোণঠাসা অবস্থান তাকে আরও হিংস্র করে তুলতে পারে। এ ধরনের চাপ ও সীমাবদ্ধতায় দাঁড়িয়ে ইরান যে কোনও সময় আরও বিস্তৃত ও অনিশ্চিত প্রতিশোধমূলক হামলার পথে হাঁটতে পারে—যার প্রভাব শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, বরং পুরো বিশ্বে পড়তে পারে।
সূত্র: ABC News, Adam Harvey, Reuters