লেখা – মাধবী চক্রবর্তী, ঢাকা
“বাবা যেন সবসময় থাকেন রাজার বেশে”
ছোটবেলায় আমরা অনেকেই বাবাকে রাজা বলে ভাবতাম। তিনিই তো আমাদের সব চাহিদার জাদুকর! বাজার থেকে খেলনা এনেছেন, স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন, কাঁধে তুলে দিয়েছেন আমাদের স্বপ্নের ভার। কিন্তু বড় হয়ে আমরা কি তাঁকে রাজার মতো রেখেছি?
প্রতিটি সন্তানের জীবনের নেপথ্য নায়ক একজন মানুষ, যিনি সকাল থেকে রাত অবধি নিঃশব্দে সংগ্রাম করে যান। তিনি আমাদের বাবা। তাঁর ভালোবাসা শব্দে নয়, কাজের ঘামে মিশে থাকে। তিনি ছায়া হয়ে থাকেন, কখনো পাহাড়ের মতো শক্ত, আবার কখনো আকাশের মতো নিঃসীম।
সংসারের নীরব সৈনিক:
একজন বাবা মানে এমন একজন মানুষ, যিনি নিজের শখ, আরাম, এমনকি কখনো নিজের স্বপ্নও বিসর্জন দেন সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য। তিনি সকালে আমাদের ঘুম ভাঙার আগেই বেরিয়ে পড়েন জীবিকার সন্ধানে এবং আমরা ঘুমিয়ে পড়ার পরও তাঁর ক্লান্ত চোখে থাকে আগামীর চিন্তা। একটা ভালো জুতা বা মোবাইল কেনার আগে সন্তানদের স্কুল ফি মেটাতে ভরসা রাখেন নিজের পুরোনো স্যান্ডেলেই। পকেটে যতই কম টাকা থাকুক না কেন, সন্তানের মুখে হাসি ফোটানোর মতো কারিগরি সব বাবাদের থাকে।
বাবার ভালোবাসা শব্দে নয়, দায়িত্বে:
মায়ের ভালোবাসা প্রকাশ্য, বাবার ভালোবাসা অধিকাংশ সময়ই গোপন। অনেক সন্তান বড় হয়েও বুঝে না, বাবার কাঁধে সংসারের কতটা ভার ছিল! বাবা হয়তো কখনো বলেন না “আমি তোমাকে ভালোবাসি”, কিন্তু সন্তান রাত জ্বরের ঘোরে কাঁপলে, তিনিই প্রথম ঘর থেকে বের হয়ে ওষুধ আনেন।
বাবা: এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা
জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে বাবা আমাদের শেখান কীভাবে হোঁচট খেয়েও উঠে দাঁড়াতে হয়। তিনি আমাদের শেখান কাজের মর্যাদা, সততা, সংগ্রাম, সময়ানুবর্তিতা— যেগুলো আমাদের পুরো জীবনের মূল ভিত্তি তৈরি করে। বাবা কখনো কোনো স্বীকৃতি চাননি, কোনো পদকও না। তিনি শুধু চেয়েছেন সন্তান যেন মানুষ হয়, সম্মানের সঙ্গে বাঁচে।
কিন্তু আমরা কী তাকে সে সম্মান ফিরিয়ে দিই? তাঁর মুখে হাসি খুব একটা দেখা যায় না, কারণ দায়িত্ব তাঁকে কঠোর হতে শিখিয়েছে। কিন্তু তাঁর চোখে যখন সন্তানের সাফল্যের ঝিলিক পড়ে, সেই একটুখানি গর্বই তাঁর বছরের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার।
সন্তানের দায়বদ্ধতা: বাবার প্রতি আমাদের কর্তব্য
আজ বাবা বসে আছেন বারান্দায়, চুপচাপ। কেউ তার কাছে এখন আর কিছু জানতে চায় না। কারো জীবনের কেন্দ্রে এখন আর তিনি নেই। কিন্তু এই বাবা একদিন ছিলেন একজন রাজা। আজ যেন তার রাজত্ব নিঃশব্দেই কাঁদে। আমরা অনেকেই ভুলে যাই, বাবা বুড়ো হচ্ছেন, তাঁর শক্তি ফুরোচ্ছে। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনিও চান একটু ভালোবাসা, একটু সময়, একটু সম্মান।
আমাদের উচিত—বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা, শুধুমাত্র বাবার দিবসে নয়, প্রতিদিন। তাঁকে সময় দেওয়া, তাঁর গল্প শোনা। তাঁকে বোঝানো, তিনি আমাদের জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর প্রয়োজনের সময় পাশে থাকা — যেমন তিনি ছিলেন আমাদের প্রয়োজনের সময়।
শেষকথা:
বাবা, তুমি থেমে যেও না। বাবারা যেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সন্তানদের কাছে রাজা হয়েই থাকেন — সম্মান, ভালোবাসা, ও যত্নে সিক্ত হয়ে। কারণ একদিন তিনি ছিলেন সেই মানুষ, যিনি নিজের রাজত্ব দিয়ে আপনার পৃথিবীটা গড়েছিলেন।
আজ বাবা দিবসে বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি সন্তান তাঁদের বাবাকে স্মরণ করছে। তবে এই দিন যেন শুধুই একটি “পোস্ট” বা “উপহার” এর মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে। বরং এ যেন হয় উপলব্ধির দিন — যে আমাদের জীবনে একটি মানুষ এমনও ছিলেন, যিনি আমাদের জন্য তাঁর জীবনকে খণ্ড খণ্ড করে ভেংগেছেন।
আমরা আজ যা কিছু হয়েছি, তার মূলে আছে একজন মানুষের ঘাম, পরিশ্রম, এবং নিঃশব্দ ভালোবাসা— তিনি আমাদের বাবা।
মাধবী চক্রবর্তী, ঢাকা
কন্টেন্ট ক্রিয়েটর ও লেখক