মেলবোর্ন, ২৩ মে— বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাম্প্রতিক কিছু পদক্ষেপ জনসাধারণের মৌলিক স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করতে পারে বলে এক বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।
বুধবার (২১ মে) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সংস্থাটি বলেছে, বিচার ব্যবস্থায় সংস্কার ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ীদের বিচারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের বদলে সরকার এখন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের দমনে মনোনিবেশ করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি মাসের ১২ তারিখ সন্ত্রাসবিরোধী আইন ব্যবহার করে আওয়ামী লীগের সভা, সমাবেশ, প্রকাশনা এবং অনলাইন প্রচারণায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। আগের সরকারের আমলেও ক্ষমতার অপব্যবহার করে দমননীতি চালানো হয়েছে। নতুন সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের মতো মানুষের মৌলিক স্বাধীনতা লঙ্ঘন করবে অন্তবর্তীকালীন সরকার। একই সময়ে গুম নিয়ে একটি খসড়া আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিলেও তা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণ করছে না বলে জানিয়েছে এইচআরডব্লিউ।
সংস্থাটির এশিয়া অঞ্চলের উপপরিচালক মিনাক্ষি গাঙ্গুলি বলেন, শেখ হাসিনার সরকার রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন করতে আইনের অপব্যবহার করেছিল, তবে এখন একই ধরনের পন্থা আওয়ামী লীগ সমর্থকদের ওপর প্রয়োগ করাও মৌলিক স্বাধীনতার লঙ্ঘন। গুম বিষয়ক প্রস্তাবিত আইনটিও বিচার ও জবাবদিহির ক্ষেত্রে খুব একটা অগ্রগতি আনবে না।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ৫ আগস্ট তিন সপ্তাহব্যাপী বিক্ষোভে প্রায় ১ হাজার ৪০০ নিহত হওয়ার পর শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তখন গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেয়। যদিও কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তবে সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞা ও আইন সংশোধন হতাশাজনক।
এতে আরও বলা হয়েছে, এর আগে সরকার ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনের সংশোধন করে রাজনৈতিক দল ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিচারের সুযোগ রেখে ট্রাইব্যুনালকে ব্যাপক ক্ষমতা দিয়েছে। সংশোধিত আইনে এমনভাবে ‘সংগঠন’ সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে যা যেকোনও দল বা এর সমর্থকদের ওপর প্রয়োগ করা যেতে পারে। এতে করে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সংগঠনের অধিকার আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে লঙ্ঘিত হতে পারে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, শেখ হাসিনার শাসনামলে যেসব অপরাধ সংগঠিত হয়েছে, সেগুলোর বিচার অবশ্যই হওয়া উচিত, তবে কোনও রাজনৈতিক দলের প্রতি সমর্থনকে অপরাধ হিসেবে দেখা কিংবা সে দলের প্রতি সহমর্মিতা দেখানোয় শাস্তি দেওয়া গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার পরিপন্থি।
এতে উল্লেখ করা হয়েছে, ইতোমধ্যে অনেক অভিনেতা, আইনজীবী, সংগীতশিল্পী ও রাজনৈতিক কর্মীকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত করে গ্রেফতার করা হয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ—তারা ‘ফ্যাসিস্ট হাসিনার শাসনকে’ সমর্থন করতেন।
আওয়ামী লীগ আমলে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার বিলম্বিত হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এইচআরডব্লিউ। তারা বলেছে, গুম কমিশনের প্রস্তাবিত আইনে তাদের প্রতিবেদনের কোনও উল্লেখ নেই। বরং আইনটি ‘পদ্ধতিগত’ বা ‘ব্যাপক’ গুমের ঘটনা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আওতায় ছেড়ে দিয়েছে, যার লোকবল কম ও বিতর্কিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত।
খসড়া আইনের সমালোচনা করে সংস্থাটি বলেছে, খসড়া আইনে একটি নতুন সংস্থা গঠনের কথা বলা হয়েছে, জবরদস্তিমূলক গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকার জাতীয় কমিশন। তবে এর স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য কোনও ধারা অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। একইসঙ্গে একটি নতুন ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে, যার বিচারিক ক্ষমতা ‘বেসামরিক বা একক’ গুমের ক্ষেত্রে সীমিত থাকবে, আর ‘ব্যাপক’ গুমের ঘটনাগুলো এর আওতার বাইরে থাকবে।
এতে আরও বলা হয়েছে, আইনটির আরও কিছু দিক উদ্বেগজনক। উদাহরণস্বরূপ, আইনটি গুমের আদেশদাতা, সহায়তাকারী ও পরিকল্পনাকারীদের শাস্তিযোগ্য করে তোলে, তবে এর ‘কমান্ড রেসপনসিবিলিটি’ বা ঊর্ধ্বতন দায়বদ্ধতার প্রয়োগ রোম সংবিধির তুলনায় অনেক কঠিন। এতে এমনকি সামরিক ও অসামরিক নেতার মধ্যে পার্থক্যও করা হয়নি। যেসব ক্ষেত্রে গুমের শিকার নিহত হয়েছেন, সেখানে মৃত্যুদণ্ড প্রয়োগের সুযোগ রাখা হয়েছে—যা মানবাধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, মানবাধিকারের ভিত্তি গড়ে তুলতে হলে সরকারকে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের মতপ্রকাশের অধিকার রক্ষায় নেওয়া পদক্ষেপগুলো প্রত্যাহার করতে হবে এবং বিচার ও জবাবদিহির প্রক্রিয়ার প্রতি অঙ্গীকার রাখতে হবে। সরকার যেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রাক-বিচারিক আটক এড়িয়ে চলে এবং এগুলো যেন ব্যতিক্রম হয়, নিয়ম নয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
সংস্থাটি বলেছে, সরকারের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচারের নিশ্চয়তা—বিশেষত গুম ও বেআইনি হত্যাকাণ্ডের।
কমিশনের তথ্য ব্যবহার করে যেসব নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তাদের দায়মুক্তি তুলে নিয়ে বিচারের আওতায় আনা এবং নিখোঁজদের পরিণতি প্রকাশ করার তাগিদ দিয়েছে সংস্থাটি।
মিনাক্ষি গাঙ্গুলি বলেন, শেখ হাসিনার আমলে যেসব নির্যাতন হয়েছে, তা নিয়ে দেশজুড়ে ক্ষোভ রয়েছে। কিন্তু বিরোধীদলীয় সমর্থকদের অধিকার কেড়ে নেওয়া কোনও সমাধান নয়। বরং, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত গুমের ঘটনাগুলোর প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করে দোষীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।