মেলবোর্ন, ৩১ মে— পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসী সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়্যেবা (এলইটি)-এর জাতিসংঘ ঘোষিত ‘সন্ত্রাসী’ নেতা মুজাম্মিল ইকবাল হাশমির একটি ভাষণের ভিডিও সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে, যেখানে তাকে বলতে শোনা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে লস্কর-ই-তৈয়্যেবা।
গত ২৮ মে পাকিস্তানের গুজরানওয়ালায় দেওয়া একটি জ্বালাময়ী বক্তৃতায় হাজমি এই দাবি করেন।
পাকিস্তানের পারমাণবিক শক্তি হিসেবে ২৭ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত ‘ইয়ুম-ই-তাকবীর’ সমাবেশে বক্তব্য রাখতে গিয়ে হাশমি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আমরাই বাংলাদেশে তোমাদের পরাজিত করেছি।’ তিনি আরও গর্ব করে বলেন যে, ২০২৪ সালে হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির আগে যে বিক্ষোভ এবং ক্যাম্পাসে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছিল, তাতে লস্কর-ই-তৈবা জড়িত ছিল এবং জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগামে সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলায় লস্করের ভূমিকার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন।
তার দাবি অনুযায়ী, এলইটি বাংলাদেশের শিক্ষার্থী নেতৃত্বাধীন সেই গণবিক্ষোভে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, যা শেখ হাসিনার সরকারকে পতনের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
এই দাবি পুরো অঞ্চলে ঝড় তুলেছে এবং বাংলাদেশের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশে বিদেশি হস্তক্ষেপের বিষয়টি নিয়ে তৎপর প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার পেছনে পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসী হস্তক্ষেপের উদ্বেগকে আরও তীব্র করেছে।
মোদিকে হুঁশিয়ারি দিয়ে ওই নেতা যা বলেন তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, ‘মোদি তুই জেনে রাখ, পাকিস্তান এমন একটি দেশ যে কখনো তার কোনো শত্রুকে ক্ষমা করে নাই। মোদি তুই ভালো মতো জানিস, গত বছর বাংলাদেশে তোকে আমরা পরাজিত করেছি।’
সম্প্রতি ভারত-পাকিস্তানের হামলা-পাল্টা হামলার বিষয়টি টেনে মোদিকে কটাক্ষ করে তিনি আরও বলেন, ‘তোমরা রাতের অন্ধকারে হামলা করো (কাপুরুষের মতো), আমরা দিনের বেলায় তোমাদের সেই জবাব দিই।’
আঞ্চলিক উত্তেজনার মাঝে এক সাহসী দাবি
হাশমির উসকানিমূলক ভাষণ, যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক ছড়িয়ে পড়েছে এবং ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম India.com রিপোর্ট করেছে, যেখানে বলা হচ্ছে, লস্কর-ই-তৈয়্যেবার বিজয় হিসেবে ঘোষণা করেছে যে তারা শেখ হাসিনার শাসন পরাজিত করেছে, যা দীর্ঘদিন ধরে ভারতের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে বিবেচিত ছিল। হাজমি সরাসরি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “গত বছর বাংলাদেশে আমরা তোমাদের পরাজিত করেছি। যদি তুমি যুদ্ধক্ষেত্রে আসো, আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে যাব।” তার এই বক্তব্যে আরও প্রতিশোধের হুমকি রয়েছে।
এটি এমন সময় এসেছে যখন মে ২০২৫ এ ভারত পাকিস্তানের মুরিদকে এলাকায় এলইটি ক্যাম্পে হামলা চালিয়েছে, পেহেলগামে হামলার পরিপ্রেক্ষিত।
এলইটি, ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলার জন্য জাতিসংঘ ঘোষিত একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। তারা দীর্ঘদিন ধরে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় বাধা হয়ে আছে। বাংলাদেশের ২০২৪ সালের গণবিক্ষোভে দৃষ্টান্তমূলক অংশগ্রহণ তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষার বেপরোয়া বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়।
হাসিনার পতন: জনগণের বিদ্রোহ না বিদেশি ষড়যন্ত্র?
“জুলাই আন্দোলন” নামে পরিচিত ২০২৪ সালের এই বিদ্রোহ শুরু হয় সরকারি চাকরির কোটা ব্যবস্থা নিয়ে বিরোধিতার মাধ্যমে, কিন্তু দ্রুত তা হাসিনার ১৫ বছর দীর্ঘ শাসনের বিরুদ্ধে বিস্তৃত বিক্ষোভে রূপ নেয়, যার সময়কাল ছিল একনায়কতন্ত্র এবং দুর্নীতির অভিযোগে ছাপিয়ে। শিক্ষার্থী নেতৃত্বাধীন ও অর্থনৈতিক অসন্তোষে উত্তেজিত এই প্রতিবাদে ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে সামরিক বাহিনীর সমর্থন প্রত্যাহারের পর হাসিনার পতিন হয়।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, সংঘর্ষে প্রায় ১,৪০০ জন নিহত হয়, যা বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম রক্তক্ষয়ী রাজনৈতিক সংঘর্ষ।
যদিও এই বিদ্রোহ দেশীয় অভিযোগ থেকে উদ্ভূত বলে মনে হয়। তবে হাজমির দাবি একটি অন্ধকার ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত দেয়। এলইটি, যার ইতিহাস রয়েছে আঞ্চলিক ফাটল কাজে লাগানোর। ২০০০ দশকের শুরু থেকেই তারা বাংলাদেশে উপস্থিত ছিল, বিশেষ করে আহল-ই-হাদিস সম্প্রদায় এবং স্থানীয় জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (JMB) এর সঙ্গে সম্পর্কের মাধ্যমে। ২০১০ সালে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ এলইটির একটি সেল ভেঙে দেয়, যা জিহাদী কার্যক্রমের জন্য বোমা পাচার ও সদস্য সংগ্রহ করছিল। ২০২৫ সালের মে মাসে ভারতীয় পুলিশ বাংলাদেশের সীমান্তের কাছে দুজন পাকিস্তান প্রশিক্ষিত এলইটি সম্পৃক্ত সন্দেহভাজন সন্ত্রাসী গ্রেফতার করে, যা গ্রুপের সক্রিয় উপস্থিতি প্রমাণ করে।
বাংলাদেশে লস্করের কৌশল
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলেন, বাংলাদেশের ঢিলেঢালা সীমান্ত এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা এলইটি’র অপারেশনের জন্য আদর্শ ক্ষেত্র। এই সংগঠন দেশটিকে দালাল মাধ্যমে নকল মুদ্রা, অস্ত্র ও বোমা তৈরির সামগ্রী পাচারের জন্য ব্যবহার করে, যা মূলত ভারতের কাশ্মীর অঞ্চলে তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাতে ব্যবহৃত হয়। এলইটি’র ধর্মীয় প্রচারমূলক সংস্থা জামায়াত-উদ-দাওয়া কোটি কোটি টাকা সংগ্রহ করে থাকে, যখন এলইটি’র সদস্যরা ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে মার্কিন ও ভারতীয় দূতাবাসে হামলার পরিকল্পনা করেছিল, যার মধ্যে ২০০৯ সালের একটি ব্যর্থ হামলার চেষ্টাও রয়েছে।

হাজমির দাবি এলইটি হাসিনার পতনের পেছনে সক্রিয় ছিল বলে যে অভিযোগ তা গ্রুপের বেপরোয়া মনোভাবের প্রতি উদ্বেগ বাড়িয়েছে। ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে (Navbharat Times) বলা হয়েছে, এলইটি বাংলাদেশে সদস্য সংগ্রহ বাড়াচ্ছে, যেখানে তারা নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতার শূন্যতা কাজে লাগাচ্ছে।
The Economic Times-এ প্রকাশিত আরেকটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউনূস সরকারের একজন আইনজীবী উপদেষ্টা এবং এলইটি ‘সদস্য’ হারুন ইজহার-এর মধ্যে বৈঠক হয়েছে, যা সরকারি জড়িততার গুঞ্জন বাড়িয়েছে।
ইসলামি উত্থান ও এলইটি’র কৌশলগত সমন্বয়
২০২৪ সালের সরকার পতনের পর বাংলাদেশে ইসলামি গোষ্ঠীগুলোর উত্থান এলইটির প্রভাব বৃদ্ধির আশঙ্কা আরও তীব্র করেছে। হেফাজত-ই-ইসলাম, JMB এর মত গোষ্ঠী, যারা অন্তর্বর্তী সরকারের নরম মনোভাব থেকে উৎসাহ পেয়েছে, এলইটি’র সালাফি-জিহাদি মতবাদ ও ভারতবিরোধী এজেন্ডার সঙ্গে একরকম। তারা বাংলাদেশে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছে, যা এলইটি’র ভারতের উপমহাদেশ জুড়ে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যকে সমর্থন করে। ২০২৫ সালের মে মাসে পশ্চিমবঙ্গ থেকে তিনজন JMB সদস্য গ্রেফতার হয়, যারা এলইটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং ভারতের “গাজওয়াতুল হিন্দ” বা “ভারত বিজয়” পরিকল্পনার জন্য অস্ত্র ও বোমা সংগ্রহের চেষ্টা করছিল।
পাকিস্তানের কূটনৈতিক সক্রিয়তাও সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। ঢাকা থেকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ২০২৫ সালে বিশেষভাবে সক্রিয় ছিলেন, মানবিক কর্মসূচির আড়ালে স্থানীয় ইসলামি নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। প্রতিবেদনে বলা হয় পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এলইটি ও JMB কে আল-খিদমত ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সমর্থন দেয়, যা রোহিঙ্গা শরণার্থী সহায়তা কর্মসূচি হিসেবে পরিচিত। চট্টগ্রামে এই “মানবিক করিডোর” মূলত দুর্বল জনগোষ্ঠীকে দোসরী করার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে, যেখানে এলইটি সদস্যরাও জড়িত। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ একইভাবে আল-খিদমতের মাধ্যমে পাকিস্তানের হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলেছিল, যা এখন আরও প্রকট হচ্ছে।
এলইটি’র স্থানীয় ইসলামি গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ততার আরেক প্রমাণ ২০০৪ সালের রিপোর্ট, যেখানে বলা হয়েছে তাদের সম্পর্ক আছে হরকাত-উল-জিহাদ-আল-ইসলামি বাংলাদেশ (HuJI-B) এর সঙ্গে, যাদের লক্ষ্য বাংলাদেশকে ইসলামি রাষ্ট্রে পরিণত করা। তাদের সর্বোচ্চ সময়ে প্রায় ১৫ হাজার সদস্য ছিল বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মাদ্রাসা থেকে। ইউনুস সরকারের এই কর্মকাণ্ড রোধে ব্যর্থতা, এবং মাজার খান নামের এক কূটনীতিকের JMB-কে অর্থায়নের অভিযোগ, বাংলাদেশ অস্থিতিশীল করার জন্য একটি সুসংগঠিত ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত দেয়। হাজমির ভাষণ ও প্রচার এই অস্থিতিশীলতাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে, যা বাংলাদেশে ইসলামি উত্থানের পেছনের বড় খেলোয়াড় হিসেবে এলইটিকে প্রতিষ্ঠিত করছে।
ভারতের উদ্বেগ ও ভবিষ্যৎ পথ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সীমান্তের শিথিল নিরাপত্তা এলইটির জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করেছে। এই সংগঠন বাংলাদেশকে একটি লজিস্টিক্যাল হাব হিসেবে ব্যবহার করে ভারতে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালানোর জন্য অস্ত্র, বোমা এবং অর্থ পাচার করছে। এ ছাড়াও এলইটি’র ধর্মীয় সংগঠন জামায়াত-উদ-দাওয়া দেশের মধ্যে প্রচুর তহবিল সংগ্রহ করে থাকে, যা তাদের কার্যক্রমকে সহায়তা করে।
ভারত, এলইটি’র সীমান্তপারে সন্ত্রাসের সাথে লড়াই করছে, এই ঘটনাগুলোকে গভীর উদ্বেগের সাথে দেখছে। হাসিনা, যিনি এখন দিল্লিতে নির্বাসনে রয়েছেন, ইউনূস সরকারকে বিদেশি শক্তির সাথে যোগসাজশের, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের, এবং সেন্টমার্টিন্স দ্বীপের মতো কৌশলগত সম্পদ হস্তান্তরের অভিযোগ করেছেন। হাজমির বক্তৃতা ও এলইটি’র কর্মকাণ্ড ভারতের উদ্বেগকে আরও তীব্র করেছে যে পাকিস্তানের পৃষ্ঠপোষকতায় একটি অঞ্চলীয় অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি চেষ্টায় রয়েছে।
সামনের পথ
ভারত সম্ভবত তার সন্ত্রাসবিরোধী প্রচেষ্টা বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায় জোরদার করবে, যাতে এলইটি’র উচ্চাকাঙ্ক্ষা রুখে দেওয়া যায়।
বর্তমানে হাজমির দাবি যাচাই-বাছাই হয়নি, তবে এগুলো এলইটি’র স্থায়ী হুমকির সরু নজির হিসেবে কাজ করছে। প্রচার কিংবা সক্রিয় হস্তক্ষেপের মাধ্যমে, এলইটি’র ছায়া বাংলাদেশের বিদ্রোহের উপর দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা পরিমণ্ডলে একটি বিপজ্জনক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। আঞ্চলিক শক্তি ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সতর্ক থাকতে হবে যেন এলইটি বাংলাদেশকে বিশৃঙ্খলার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে না পারে। তথ্যসূত্র: ডেকান ক্রনিকল ও দ্য এশিয়া পোস্ট