মেলবোর্ন, ০২ জুন— ইতিহাসের যেন পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের যেভাবে ‘ভারতীয় চর’ আখ্যায়িত করেছিল পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী। ঠিক একইভাবে বেলুচিস্তানের স্বাধীনতাকামীদেরও ‘ফিতনা-এ হিন্দুস্তান’ আখ্যায়িত করার মাধ্যমে ভারতীয় চর বলা হচ্ছে।
সম্প্রতি বেলুচিস্তানের খুজদার জেলায় একটি সামরিক স্কুল বাসে আত্মঘাতী বোমা হামলায় তিন স্কুলছাত্রীসহ পাঁচজন নিহত হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ভাষ্য অনুযায়ী, এই হামলার পেছনে রয়েছে ভারত-সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলো। তবে এই দাবির পক্ষে তারা কোনো দৃঢ় প্রমাণ দেয়নি।
ডনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এর আগের সপ্তাহে বেলুচিস্তানের সোরাবে সশস্ত্র গোষ্ঠী বালুচ লিবারেশন আর্মির (বিএলএ) সদস্যরা একটি ব্যাংকে হামলা চালায় এবং স্থানীয় প্রশাসনিক ভবনে গোলাগুলিতে একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা নিহত হন। ইসলামাবাদ এসব হামলার জন্যও ভারতকে দায়ী করছে।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এবং সরকারের অভিযোগ, বালুচ ইয়াকজেহতি কমিটি (বিওয়াইসি) নামে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারী সংগঠনটিও আসলে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা রয়ের একটি ছদ্মবেশী প্রচারণা।
এ অভিযোগের ধারাবাহিকতায় পাকিস্তান ভারতের নৌবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা কুলভূষণ যাদবের প্রসঙ্গও টেনে এনেছে, যাকে তারা বালুচিস্তানে ভারতীয় গোয়েন্দা তৎপরতার প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করে। তবে ভারত বলছে, যাদবকে ইরান থেকে অপহরণ করা হয়েছিল এবং তার বিরুদ্ধে পাকিস্তানের অভিযোগ ভিত্তিহীন।
পাকিস্তান এখন যেমন বালুচ বিদ্রোহীদের ভারতের চর হিসেবে দেখাতে চাইছে, ১৯৭১ সালের পূর্ব পাকিস্তানেও তারা মুক্তিযোদ্ধাদের একইভাবে ‘ভারতীয় ষড়যন্ত্রের অংশ’ বলে অভিযুক্ত করেছিল। অনেক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমই বলছে, ইসলামাবাদের অভিযোগ সত্য নয়। বেলুচিস্তানের বিদ্রোহ অনেকটাই স্থানীয় রাজনৈতিক ও মানবাধিকার দমন-পীড়নের ফলাফল।
পরিসংখ্যানেও বালুচদের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। ২০২৩ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী যেখানে পাকিস্তানে মোট সাক্ষরতার হার ৬০ দশমিক ৭ শতাংশ। সেখানে সেখানে বেলুচিস্তানের সাক্ষরতার হার পাকিস্তানের সব প্রদেশের তুলনায় কম- মাত্র ৪২ দশমিক ১ শতাংশ।
২০২৩ সালে যেখানে পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ছিল ১ হাজার ৬৬৪ ডলার। সেখানে বেলুচিস্তানের মাথাপিছু আয় ছিল জাতীয় গড়ের থেকেও ৩৮ শতাংশ কম- মাত্র ১ হাজার ১০৬ ডলার।
যা এক অর্থে ৭১ পূর্ববর্তি পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্বপাকিস্তানের বৈষম্যকেই যেন ফুটিয়ে তুলেছে। ১৯৫০ সালে দুই অংশের মাথাপিছু আয়ের পার্থক্য যেখানে ছিল মাত্র ৪ শতাংশ। ১৯৭০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬১ শতাংশে। একই অবস্থা ছিল শিক্ষাখাতেও।
বেলুচিস্তান পাকিস্তানের প্রাকৃতিক সম্পদে সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী অঞ্চল। কিন্তু স্থানীয় জনগণের অভিযোগ ইসলামাবাদ সেগুলো শোষণ করে নিয়ে যাচ্ছে, বিনিময়ে তারা কিছুই পায় না। একই রকম অভিযোগ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালীদেরও। অভিযোগ ছিল, পূর্ব পাকিস্তানের পাট থেকে অর্জিত বৈদেশিক মূদ্রা অধিকাংশ ভাগই ব্যয় হতো পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে।
এ ছাড়াও বেলুচিস্তানের মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে- বালুচদের গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং সেনা অভিযানের মাধ্যমে দাবিয়ে রাখা হচ্ছে। নিয়মিত ভাবেই সেখানে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটছে।
তবে পাকিস্তানের সেনা নিয়ন্ত্রিত বর্তমান সরকার বরাবরই এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। তারা দাবি করেছে, ভারতের চক্রান্তেই সন্ত্রাসী কার্যকলাপ হচ্ছে। সাধারণ বালুচ জনগোষ্ঠী এখনও দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে গঠিত পাকিস্তানের ওপরই আস্থাশীল।