মেলবোর্ন, ১২ জুন— ইসরায়েল সরকারের সবচেয়ে বিতর্কিত মন্ত্রী ইতামার বেন-গভির ও বেজালেল স্মোটরিচ-এর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, নরওয়ে এবং যুক্তরাজ্য। তাদের বিরুদ্ধে পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে সহিংসতা উসকে দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। নিষেধাজ্ঞার আওতায় তাদের ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং সম্পদ জব্দ করা হবে।
এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছেন এবিসি নিউজ, বিবিসি ও রয়টার্স।
বিশ্বের প্রভাবশালী পাঁচটি দেশের এমন সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল।
অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেনি ওং বলেন, এই দুই নেতা “চরমপন্থী সহিংসতা এবং ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার লঙ্ঘনে” উসকানি দিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, “ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করার আহ্বান এবং নতুন ইসরায়েলি বসতি স্থাপনের পক্ষে চরমপন্থী বক্তব্য ভয়ানক ও বিপজ্জনক। এই ধরনের কার্যকলাপ গ্রহণযোগ্য নয়।”
“আমরা এ নিয়ে ইসরায়েল সরকারের সঙ্গে ব্যাপকভাবে আলোচনা করেছি, তবুও সহিংস অপরাধীরা উৎসাহ ও দণ্ডমুক্তির সঙ্গে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।”
“আপনারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে উপেক্ষা করেছেন”, বললেন ওং।
বেন-গভির ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর জোট সরকারের জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী এবং মি. স্মোটরিচ অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
সেনেটর ওং আরও বলেন, “এই নিষেধাজ্ঞা জারির অর্থ এই নয় যে অস্ট্রেলিয়া ইসরায়েলের নিরাপত্তার প্রতি তাদের সমর্থন থেকে সরে এসেছে—বিশেষ করে ৭ অক্টোবর, ২০২৩ সালের হামাসের মর্মান্তিক হামলার পর।”
পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেনি ওং আরও বলেন, “আজকের এই পদক্ষেপগুলো তাদের লক্ষ্য করে নেওয়া হয়েছে, যারা আমাদের দৃষ্টিতে ইসরায়েলের নিজের নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন করছে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা ইসরায়েলের জনগণের সঙ্গে দৃঢ় বন্ধুত্ব বজায় রাখতে চাই—যা আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক, মূল্যবোধ এবং তাদের নিরাপত্তা ও ভবিষ্যতের প্রতি প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে গড়ে ওঠেছে।”
মন্ত্রী ওং স্পষ্ট করে দেন যে, নিষেধাজ্ঞাগুলো মূলত বেন-গভির এবং স্মোটরিচের পশ্চিম তীর সংক্রান্ত আচরণের কারণে আরোপ করা হয়েছে। তবে তিনি বলেন, এসব পদক্ষেপ গাজা সংকট থেকে আলাদা করে দেখা যায় না।
তিনি বলেন, “আমরা সাধারণ নাগরিকদের অসহনীয় কষ্টে বিস্মিত, বিশেষ করে যখন জরুরি সহায়তা দেওয়া থেকে তাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে।”
তিনি ইসরায়েলকে সতর্ক করে বলেন, “গাজা বা পশ্চিম তীর থেকে ফিলিস্তিনিদের অবৈধভাবে সরিয়ে নেওয়া যাবে না, কিংবা গাজার ভূখণ্ড সংকুচিত করা যাবে না।”
বুধবার তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “নেতানিয়াহু সরকারের গাজা পরিস্থিতি নিয়ে পদক্ষেপ এবং পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতার দায়মুক্তি “দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের সম্ভাবনাকে ধ্বংস করছে…”
‘ইসরায়েলের প্রতি একটি যৌথ বার্তা’
তিনি বলেন, “এই দেশগুলো একসঙ্গে একটি বার্তা দিচ্ছে—আপনারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে উপেক্ষা করেছেন এবং আমরা সেটি মেনে নিচ্ছি না।”
‘অপমানজনক’: ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া
ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিদন সা’আর বলেন, যুক্তরাজ্য কর্তৃক ইসরায়েলি দুই মন্ত্রীকে নিষেধাজ্ঞার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে সরকারকে অবহিত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, “নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপমানজনক।”
তিনি জানান, বিষয়টি নিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সঙ্গে আলোচনা করেছেন এবং আগামী সপ্তাহের শুরুতেই এ নিয়ে বিশেষ মন্ত্রিসভার বৈঠক ডাকা হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও নিষেধাজ্ঞার নিন্দা করে বলেন, এটি “যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠা, সব জিম্মিদের মুক্তি এবং যুদ্ধের অবসান ঘটানোর মার্কিন প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নিয়ে যায় না।”
তিনি বলেন, “আমরা কোনো ধরনের তুলনার ধারণা প্রত্যাখ্যান করি। হামাস একটি সন্ত্রাসী সংগঠন, যারা অকল্পনীয় বর্বরতা চালিয়েছে… আমরা আমাদের মিত্রদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি—আসল শত্রু কে, তা ভুলে যাবেন না।”
অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বলেন, “এটি খুবই প্রত্যাশিত, স্পষ্টতই।”
তিনি বলেন, “আমরা গাজার মানবিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে আসছি এবং আমাদের অবস্থান সবসময় এক ছিল।”
ওং জানান, যুক্তরাষ্ট্রকে নিষেধাজ্ঞা বিষয়ে “গত রাতেই” জানানো হয়েছে এবং স্বীকার করেন যে কিছু বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মতপার্থক্য থাকলেও কৌশলগত সহযোগিতা অটুট রয়েছে।
আলবানিজ বলেন, এই ইস্যুটি আগামী সপ্তাহের জি৭ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনার অগ্রাধিকার তালিকায় নেই।
অস্ট্রেলিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনীতি
অস্ট্রেলিয়ান বিরোধী দল (কোলিশন)-এর পররাষ্ট্রবিষয়ক মুখপাত্র মাইকেলিয়া ক্যাশ এই সিদ্ধান্ত সরাসরি সমালোচনা না করলেও একে “গুরুতর পদক্ষেপ” হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেন, সরকারকে এই সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা দিতে হবে।
তিনি বলেন, “আমরা লক্ষ্য করছি, অ্যালবানিজ সরকারের পক্ষ থেকে ইসরায়েলি সরকারের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।”
তিনি আরও দাবি করেন, ম্যাগনিটস্কি-ধাঁচের নিষেধাজ্ঞা ব্যবস্থাকে যদি কারও মন্তব্যের ভিত্তিতে প্রয়োগ করা হয়, তবে এটি ওই ব্যবস্থার মূলনীতিকেই দুর্বল করবে।
বেন-গভির ও স্মোটরিচের প্রতিক্রিয়া ও অবস্থান
এই দুই মন্ত্রীই পশ্চিম তীরে নতুন ইসরায়েলি বসতি স্থাপন এবং পূর্বে গড়ে ওঠা অবৈধ বসতিগুলোর বৈধতা দেওয়ার জোরালো সমর্থক। ২০২৪ সালে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত এই বসতিগুলিকে অবৈধ ঘোষণা করে।
গত মাসে ইসরায়েল সরকার ২২টি নতুন বসতি স্থাপনের ঘোষণা দেয় এবং আগে থেকে গড়ে ওঠা কিছু অবৈধ বসতিকেও বৈধতা দেওয়ার পদক্ষেপ নেয়।
তারা গাজায় যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে এবং সেখানে ইহুদি বসতি পুনঃস্থাপনের আহ্বান জানিয়েছেন।
স্মোটরিচ বলেছেন, “গাজায় একটিও গমের দানা প্রবেশ করতে দেব না”, এবং দাবি করেন, যুদ্ধের শেষে গাজাকে “সম্পূর্ণ ধ্বংস” করা উচিত।
বেন-গভির গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের বিতাড়িত করার দাবি জানিয়ে বলেন, “আমাদের উচিত অভিবাসনে উৎসাহ দেওয়া।”
তিনিও আল-আকসা মসজিদের স্থলে উপাসনালয় গড়ে তোলার পক্ষে কথা বলেন এবং টেম্পল মাউন্টে ইহুদিদের প্রার্থনার অধিকারের দাবি তুলে জেরুজালেমে উত্তেজনা বাড়িয়েছেন।
এছাড়া, বেন-গভিরের বিরুদ্ধে বর্ণবাদ উসকে দেওয়া ও একটি সন্ত্রাসী সংগঠনকে সমর্থন করার জন্য একাধিক ফৌজদারি মামলা রয়েছে।
মাত্র দুই সপ্তাহ আগে, তারা ‘জেরুজালেম দিবস’ উপলক্ষে পুরনো শহরে একটি জাতীয়তাবাদী মিছিলে অংশ নেন, যেখানে অংশগ্রহণকারীরা “আরবদের মৃত্যু হোক” এবং “তোমার গ্রাম পুড়ে যাক” ইত্যাদি স্লোগান দেয়।
সেনেটর ওং বলেন, “তারা ইসরায়েল সরকারের একমাত্র বিতর্কিত সদস্য নয়, তবে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে চরমপন্থী।”
বেন-গভির বলেন, “আমরা ফিরাউনের সময়ও টিকে ছিলাম, স্টারমারের দেওয়ালও পেরিয়ে যাব।”
তিনি আরও বলেন, “আমি ইসরায়েল রাষ্ট্র ও এর জনগণের জন্য নির্ভয়ে ও ভয়ভীতিহীনভাবে কাজ করে যাব।”
স্মোটরিচ এই সিদ্ধান্তকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, “ব্রিটেন একবার আমাদের পিতৃভূমিতে বসতি স্থাপন ঠেকাতে চেষ্টা করেছিল, তারা আবার সেটি করতে পারবে না। আমরা ঈশ্বরের ইচ্ছায় নির্মাণ কার্যক্রম চালিয়ে যাব।”
যুক্তরাজ্যের অবস্থান ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
গত কয়েক সপ্তাহে যুক্তরাজ্য ইসরায়েলের প্রতি তাদের সমালোচনার সুর আরও কড়া করেছে। প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার, কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি এবং ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁর সঙ্গে যৌথ বিবৃতিতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞার ইঙ্গিত দেন।
ইসরায়েলের গাজা অবরোধকে আন্তর্জাতিক নেতারা কড়া ভাষায় সমালোচনা করেছেন। প্রেসিডেন্ট মাক্রোঁ একে “লজ্জাজনক” বলে আখ্যায়িত করেছেন।
এবিসি নিউজকে যা বললেন পেনি ওং
অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেনি ওং ABC’s News Breakfast-এ বলেন, “এই নিষেধাজ্ঞাগুলোর বাস্তব প্রভাব যেমন গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক তেমনি গুরুত্বপূর্ণ হলো একসঙ্গে কয়েকটি দেশের সম্মিলিত বার্তাটি।”
তিনি আরও বলেন, “যেসব দেশ এই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তারা সবাই ইসরায়েলের সঙ্গে ঐতিহাসিক সম্পর্কযুক্ত—এটি প্রমাণ করে আমরা এই পরিস্থিতি নিয়ে কতটা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।”
এই বক্তব্যগুলো স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয় যে, পশ্চিমা বিশ্বে ইসরায়েলের চরমপন্থী মন্ত্রীদের ভূমিকা ও নীতির বিরুদ্ধে অসন্তোষ বাড়ছে, বিশেষ করে ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার এবং দুই-রাষ্ট্র সমাধানের সম্ভাবনা ধ্বংসের বিষয়ে।