মেলবোর্ন, ১৪ জুন—বৃহস্পতিবার রাতে একটি তদন্তমূলক প্রতিবেদনে প্রকাশ পায়, ইরান তার পরমাণু দায়বদ্ধতা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে — প্রায় ২০ বছর পর এমন ঘটনা প্রথম। বেশ কয়েক বছর ধরেই ইরানের সঙ্গে জাতিসংঘের পরমাণু পর্যবেক্ষক সংস্থার টানাপোড়েন চলছিল।
এই নতুন উত্তেজনা ইঙ্গিত দেয়, ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি আরও বাড়াতে পারে — যেমনটা তারা আগেও হুমকি দিয়েছিল।
তবে, প্রতিবেদন প্রকাশের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ইসরায়েল পাল্টা আঘাত হানে।
‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’
স্থানীয় সময় শুক্রবার ভোরে ইসরায়েল ইরানের উপর ব্যাপক বিমান হামলা চালায়। টার্গেট করা হয় ইরানের পরমাণু কেন্দ্রগুলোকে, যাতে নিহত হন বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী এবং ইরানের এলিট প্যারামিলিটারি ইউনিটের সদস্যরা।
সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ-এর তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলের এই অভিযান ছিল দুই ধাপে বিভক্ত:
প্রথম ধাপে, ছোট ড্রোনের বহর ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা রাডার ও যোগাযোগ কেন্দ্রগুলোতে হামলা চালিয়ে সতর্কতা ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে দেয়।
দ্বিতীয় ধাপে, শত শত ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান শতাধিক লক্ষ্যবস্তুতে নিখুঁত হামলা চালায় — যার মধ্যে ছিল মিসাইল ঘাঁটি ও প্রতিরক্ষা স্থাপনাও।
এই হামলার কয়েক ঘণ্টা পর, ইরান পাল্টা প্রতিশোধ হিসেবে ইসরায়েলের দিকে একাধিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে।
তেল আবিব ও জেরুজালেমে ভোররাতে সাইরেন বাজে, লোকজন আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটে যায়। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানায়, বেশিরভাগ ক্ষেপণাস্ত্র তাদের ‘আয়রন ডোম’ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দ্বারা ধ্বংস করা হয়েছে।
শনিবার সকাল পর্যন্ত ইসরায়েল জানিয়েছে, তিনজন নিহত হয়েছে।
এদিকে তেহরানে কয়েকটি বিস্ফোরণ শোনা যায়। ফার্স নিউজ এজেন্সির তথ্য অনুযায়ী, দুটি ক্ষেপণাস্ত্র মেহরাবাদ বিমানবন্দরে আঘাত হানে।
যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা
এই পাল্টাপাল্টি হামলার ফলে গোটা অঞ্চলে উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। গাজা ও লেবাননে ইরানের মিত্ররা ইতিমধ্যেই ইসরায়েলি হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লাহ আলি খামেনি ইসরায়েলকে যুদ্ধ শুরুর জন্য দায়ী করেছেন। অন্যদিকে, ইসরায়েল বলেছে, এই হামলা তাদের জাতীয় সুরক্ষার অংশ।
দীর্ঘ দিনের শত্রুতা ও পরমাণু প্রতিযোগিতা
ইসরায়েল ও ইরানের সম্পর্ক বহুদিন ধরেই টানাপোড়েনপূর্ণ। ইসরায়েল চায় না, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করুক বা তার মিত্রদের সেই অস্ত্রে সজ্জিত করুক।
২০১০ সালে, একটি মার্কিন-ইসরায়েলি ভাইরাস ইরানের ইউরেনিয়াম সেন্ট্রিফিউজ ধ্বংস করে। ২০১৮ সালে ইসরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু দাবি করেন, তারা ইরানের একটি গোপন গুদাম থেকে পারমাণবিক কর্মসূচির প্রমাণ পেয়েছে।
২০১৫ সালের চুক্তির মাধ্যমে ইরানের অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা ১০ বছরের জন্য রুদ্ধ করা হয়েছিল, কিন্তু ইসরায়েল ও পরে ডোনাল্ড ট্রাম্প সেই চুক্তির বিরোধিতা করেন।
২০১৮ সালের মে মাসে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে চুক্তি থেকে বের করে নেন এবং এরপর স্যাবোটাজ অব্যাহত থাকে।
উত্তেজনার নতুন পর্ব
২০২৩ সালের ২৬ অক্টোবর, ইসরায়েল প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে ইরানের উপর হামলা চালায়।
এপ্রিল ২০২৫-এ ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকের পর নেতানিয়াহু বলেন, “চুক্তি তখনই সম্ভব, যদি আমেরিকান তত্ত্বাবধানে ইরানের সমস্ত পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করা হয়।” নইলে মিলিটারি অ্যাকশনই একমাত্র পথ — এমন হুঁশিয়ারিও দেন তিনি।
চুক্তি না হলে আরও ‘নির্মম’ হামলার হুমকি
রবিবার ছিল মার্কিন-ইরান পরমাণু আলোচনা চক্রের ষষ্ঠ দফার নির্ধারিত দিন, কিন্তু ভবিষ্যৎ এখনও অনিশ্চিত। ইরান বলছে, এই আলোচনার আর মানে নেই।
তাদের অভিযোগ, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে হামলার সুযোগ করে দিয়েছে।
তেহরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, “আপনি একদিকে আলোচনার দাবি করবেন, আর অন্যদিকে ইসরায়েলকে হামলার সুযোগ দেবেন — এটা গ্রহণযোগ্য নয়।”
যুক্তরাষ্ট্র জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে। তবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, ইরান নিজেই এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
Truth Social-এ তিনি লেখেন, “চুক্তির সুযোগ আমি দিয়েছিলাম। এখন আর সময় নেই — আলোচনা করুন, না হয় আরও ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকুন।”
সূত্র: ABC / Reuters / AP