মেলবোর্ন, ০২ জুন— ড্রোন হামলা করে ৪০টির বেশি রাশিয়ান যুদ্ধবিমান ধ্বংসের দাবি করেছ ইউক্রেন।
বিবিসি জানিয়েছে, ইউক্রেনের নিরাপত্তা বাহিনী (এসবিইউ) রবিবার বলেছে, এটি রাশিয়ার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত তাদের সবচেয়ে বড় আকারের ড্রোন হামলা।
এসবিইউ জানিয়েছে, “শত্রু স্ট্র্যাটেজিক বোম্বার বিমানগুলি রাশিয়ায় ব্যাপকভাবে আগুনে ঝলসানো হচ্ছে।”
ইউক্রেনের এই বিশেষ অভিযানের লক্ষ্য ছিল শত্রুর বোম্বার বিমান ধ্বংস করা।
হামলার একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে তারা, যাতে ইরকুতস্ক অঞ্চলের বেলায়া বিমানঘাঁটিতে ড্রোন হামলার দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। ভিডিওতে বোম্বার বিমানগুলোর ওপর বিস্ফোরণ ও ধোঁয়া ওঠার দৃশ্য স্পষ্ট।
ইউক্রেন জানিয়েছে, তাদের অভিযানে মোট ৪৭২টি ড্রোন এবং সাতটি ব্যালেস্টিক ও ক্রুজ মিসাইল ব্যবহার করা হয়েছে।
ইউক্রেন বলছে, তারা আকাশ পথে আসা ৩৮৫টি লক্ষ্যবস্তু নিরস্ত্র করতে সক্ষম হয়েছে।
অন্যদিকে, রাশিয়ান গণমাধ্যম রাশিয়ান টাইমস (আরটি) হামলার খবর প্রকাশ করে বলছে, এ ধরনের হামলা রাশিয়ার ইরকুতস্ক অঞ্চলের সাইবারে প্রথম।
আরটিকে আঞ্চলিক গভর্নর ইগর কোবজেভ জানান, হামলাটি সংঘটিত হয়েছে স্রেদনি নামক এক বসতির কাছে, যা বৈকাল হ্রদের কাছাকাছি এবং ইরকুতস্ক শহর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে।

কোবজেভ আরও জানান, পাশের নোভোমালটিনস্ক গ্রামে একটি পরিত্যক্ত ভবনেও ড্রোন আঘাত হানে।
আরটি জানিয়েছে, ড্রোনগুলো একটি ছোট ট্রাক থেকে উৎক্ষেপণ করা হয়। যদিও ঠিক কতগুলো ড্রোন হামলায় অংশ নিয়েছে তা স্পষ্ট নয়, তবে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ফুটেজে অন্তত তিনটি ড্রোন হামলায় অংশ নিয়েছে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। যদিও সেসব ফুটেজ যাচাই করতে পারেনি রাশিয়ান টাইমস।
গভর্নর কোবজেভ বলেন, “ড্রোন উৎক্ষেপণ স্থলটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং সাধারণ জনগণের জীবন ও স্বাস্থ্যের কোনো হুমকি নেই।”
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ইউক্রেন একাধিকবার রুশ ভূখণ্ডে ড্রোন হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ এই হামলাগুলোকে শান্তিপূর্ণ আলোচনার প্রচেষ্টা ব্যাহত করার একটি প্রচেষ্টা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
এই হামলার জবাবে মস্কো ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা শিল্প স্থাপনা, সেনা সমাবেশস্থল ও অস্ত্রগুদামে পাল্টা হামলা চালিয়েছে বলে জানানো হয়েছে।
ইরকুতস্কের এই হামলার সময়, রাশিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় মুরমানস্ক অঞ্চলেও একই ধরনের একটি ড্রোন হামলার খবর পাওয়া গেছে, যদিও এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য এখনও প্রকাশ করা হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা ইউক্রেনের ওপর ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক হামলার আহ্বান জানিয়েছেন।
রুশ সামরিক বিশ্লেষক এবং ব্লগার রোমান আলেখিন লিখেছেন, “এটি রাশিয়ার ‘পার্ল হারবার’। আমরা আশা করি, এই হামলার জবাব যুক্তরাষ্ট্র যেমন পার্ল হারবারের জবাব দিয়েছিল, তেমনই শক্তিশালী হবে, বরং তার থেকেও কঠোর।”
বিশেষজ্ঞরা আরো বলছেন এই ঘটনা ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘর্ষে নতুন মাত্রা যোগ করেছে, যেখানে দুই পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সামরিক সুবিধা অর্জনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইউক্রেনের এই অভিযানের ফলে রাশিয়ার সামরিক সক্ষমতার ওপর বড় আঘাত এসেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ইউক্রেনের হামলার প্রতিক্রিয়ায় দেশটির বিরুদ্ধে ‘ট্যাকটিক্যাল’ পারমাণবিক হামলার দাবি তুলে রুশ সামরিক বিশ্লেষক রোমান আলেখিন টেলিগ্রামে লিখেছেন, “এটি রাশিয়ার ‘পার্ল হারবার’। আমরা আশা করি, এই হামলার জবাব যুক্তরাষ্ট্র যেমন পার্ল হারবারের জবাব দিয়েছিল, তেমনই শক্তিশালী হবে, বরং তার থেকেও কঠোর।”
এই মন্তব্য দেশটির একাংশে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের জন্য জনমত তৈরির ইঙ্গিত দিচ্ছে।
‘ট্যাকটিক্যাল’ পারমাণবিক অস্ত্র মূলত এমন পারমাণবিক বোমা, যার বিস্ফোরণক্ষমতা তুলনামূলকভাবে কম—প্রায় ০.৩ থেকে ১০০ কিলোটনের মধ্যে। এগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য নির্মিত, যেন নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করা যায়।
তবে সীমিত বিস্তার হলেও এর ধ্বংসযজ্ঞ ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব অনেক।
বিশ্বে প্রচলিত কৌশলগত বা ‘স্ট্র্যাটেজিক’ পারমাণবিক বোমার তুলনায় এগুলো ছোট হলেও, ভয়াবহতার দিক দিয়ে কোনো অংশে কম নয়। ১৯৬১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পরীক্ষিত ‘জার বোমা’ ছিল ৫৮ মেগাটনের। আর যুক্তরাষ্ট্রের স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট অনুসারে, তাদের সবচেয়ে বড় স্ট্র্যাটেজিক অস্ত্র ১.২ মেগাটনের।
২০২৪ সালের শেষদিকে, রাশিয়া তার পারমাণবিক নীতিমালায় গোপনে পরিবর্তন আনে। যুক্তরাজ্য ভিত্তিক গণমাধ্যম দ্য টাইমসের প্রতিবেদন অনুসারে, নতুন নীতিতে বলা হয়, রাশিয়ার ভূখণ্ডে বা তার গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সম্পত্তির ওপর অ-পরমাণু দেশ হামলা চালালেও, যদি তা একটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশের সহায়তায় ঘটে তবে মস্কো পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের অধিকার রাখে।
‘পুতিনের মস্তিষ্ক হিসাবে’ পরিচিত রুশ চিন্তাবিদ আলেকজান্ডার ডুগিন যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যম দ্য সানকে বলেছেন, “যুক্তরাজ্য যদি ইউক্রেনকে সহায়তা বন্ধ না করে, তাহলে তা পারমাণবিক মানচিত্র থেকে মুছে ফেলা হতে পারে।”
সম্প্রতি এক ভাষণে ভ্লাদিমির পুতিন পশ্চিমা দেশগুলোকে সরাসরি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, “রাশিয়ার অস্তিত্বের হুমকি তৈরি হলে আমাদের সব অস্ত্রই টেবিলের ওপর থাকবে।” বার্তা সংস্থা রয়টার্সে বলছে, এই বক্তব্য দিয়ে তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন, পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার আর শুধুই তাত্ত্বিক বিষয় নয়, বাস্তব সম্ভাবনাও হয়ে উঠছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও আশঙ্কা
ন্যাটো, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্র কেউই এখন পর্যন্ত এমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেয়নি, যা রাশিয়ার এই পারমাণবিক হুমকিকে প্রত্যক্ষ স্বীকৃতি দেয়। তবে পশ্চিমা কৌশলগত বিশ্লেষকরা বলছেন, রাশিয়া যদি পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করে, তাহলে যুদ্ধ একটি সম্পূর্ণ নতুন স্তরে পৌঁছাবে। এর রাজনৈতিক ও সামরিক মূল্য রাশিয়ার জন্য ভয়াবহ হবে।
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, রাশিয়ার এই আচরণ শুধু ইউক্রেনের বিরুদ্ধে নয়, বরং পশ্চিমা দেশগুলোকেও স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে।
রাশিয়ার ভেতরে পারমাণবিক হামলার সমর্থনে সরব হওয়া কেবল প্রতিক্রিয়াশীল উত্তেজনা নয়। এটি যুদ্ধের ধরন, কূটনৈতিক ব্যর্থতা এবং পশ্চিমা বিশ্বের সীমাবদ্ধতার একটি প্রতিফলন। পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে ছলচাতুরির এই খেলা যদি বাস্তবে রূপ নেয়, তবে তা কেবল ইউক্রেন নয়, গোটা বিশ্বের জন্য এক অন্ধকার অধ্যায় রচনা করবে।
এ ধরনের উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক শক্তিগুলোর দায়িত্ব আরও বেড়েছে— যুদ্ধের উত্তাপ কমানো, ও যুদ্ধের পেছনে পারমাণবিক ছায়াকে নির্মূল করাই এখন সময়ের দাবি।