২০২৫ সালের ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস (IWD) উদযাপনের বিশ্বব্যাপী প্রচারণার থিম নির্ধারিত হয়েছে (Accelerate Action) এক্সিলারেট অ্যাকশন‘। এই থিম লিঙ্গ বৈষম্য দূর করার জরুরি প্রয়োজনকে মনে করিয়ে দেয়। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান গতিতে লিঙ্গ সমতা অর্জন করতে ২১৫৮ সাল পর্যন্ত সময় লাগবে—যা এখন থেকে প্রায় পাঁচ প্রজন্ম দূরে।
১৯০৮ সাল। ১৫,০০০ নারী নিউ ইয়র্ক সিটির রাস্তায় নেমে কম কর্মঘণ্টা, ভালো বেতন এবং ভোটের অধিকারের দাবি জানান। তাদের সাহস লিঙ্গ সমতার আন্দোলনের প্রথম ভিত্তি স্থাপন করেছিল। এক শতাব্দীরও বেশি সময় পর, আজ আমরা নারীদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অগ্রগতি উদযাপন করলেও, যাত্রা শেষ হয়নি এখনও।
বাংলাদেশে বর্তমানের পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। নারী ও মেয়েদের বিরুদ্ধে সহিংসতার ভয়াবহ পরিসংখ্যান আমাদের জাতীয় গণমাধ্যমে ফুটে উঠেছে।
২০২৪ সালের প্রথম আট মাসে, ২২৪টি মেয়েকে ধর্ষণের শিকার হয়েছে, ৮১ জনকে হত্যা করা হয়েছে এবং ১৩৩ জন আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। এই সংখ্যাগুলি শুধু পরিসংখ্যান নয়; এগুলি দেশ ও সমাজের ব্যর্থতার কারণে বিধ্বস্ত জীবনের প্রতিনিধিত্ব করে।
‘সেভ দ্য রোড’-এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার ব্যাপকতা তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে গত ২০২৪ সালের মার্চ থেকে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গত ১ বছরে রেল, নৌ ও সড়কপথের পাশাপাশি রেল-নৌ-বাস স্টেশন এবং ফুটপাতে নারীদের শ্লীলতাহানি ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ১,৭৫৮টি, এবং ধর্ষিত হয়েছেন ৪১ জন নারী। আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে কেন্দ্র করে সেভ দ্য রোড-এর উদ্যোগে গণপরিবহনে ৪০ শতাংশ নারী আসন এবং নির্যাতন ও ধর্ষণ রোধে কঠোর শাস্তির দাবিতে প্রতিবেদন পাঠ, সমাবেশ ও র্যালি থেকে এই তথ্য দিয়েছেন সেভ দ্য রোড-এর মহাসচিব শান্তা ফারজানা।
এদিকে, আফগানিস্তানে নারী ও মেয়েদের অবস্থা একটি গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছেছে। ২০২১ সাল থেকে ১৪ লক্ষ মেয়েকে তাদের শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, যা ইউনেস্কো “একটি দুঃস্বপ্ন” হিসেবে বর্ণনা করেছে। তালেবানের মেয়েদের শিক্ষার উপর নিষেধাজ্ঞা শুধু তাদের ভবিষ্যৎকেই কেড়ে নেয়নি, বরং নারী শিক্ষার অগ্রগতিকে পিছিয়ে দিয়েছে। শিক্ষা একটি মৌলিক মানবাধিকার, এবং মেয়েদের একটি পুরো প্রজন্মকে এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করা আফগানিস্তানের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এই অবিচারের মুখে নীরব থাকা সমচীন নয় বলে মনে করি।
এই সমস্যাটি শুধু বাংলাদেশ বা আফগানিস্তানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বিশ্বব্যাপী নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা একটি ব্যাপক সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। মিশন অস্ট্রেলিয়ার পরিসংখ্যান অনুসারে অস্ট্রেলিয়ায়, প্রতি ৬ জন নারীর মধ্যে ১ জন তাদের বর্তমান বা প্রাক্তন সঙ্গীর দ্বারা শারীরিক বা যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন, এবং গড়ে প্রতি ৯ দিনে একজন নারী তার সঙ্গীর হাতে নিহত হন। এই পরিসংখ্যানগুলি স্মরণ করিয়ে দেয় যে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা একটি বৈশ্বিক সংকট, যার জন্য ঐক্যবদ্ধ প্রতিক্রিয়া প্রয়োজন।
এই আন্তর্জাতিক নারী দিবসে, আসুন আমরা লিঙ্গ সমতার লড়াইয়ে পুনরায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হই। আসুন আমরা ১৯০৮ সালে যেসব নারী রাস্তায় নেমেছিলেন তাদের উত্তরাধিকারকে সম্মান করি। অগ্রগতি ত্বরান্বিত করতে পুরুষ ও নারী উভয়েরই অংশগ্রহণ প্রয়োজন।
লিঙ্গ সমতার জন্য আরও ১৩৩ বছর অপেক্ষা! আমরা এমন একটি বিশ্ব তৈরি করতে চাই যেখানে প্রতিটি নারী ও মেয়ে মর্যাদা, নিরাপত্তা এবং সুযোগ নিয়ে বাঁচতে পারে। এই আন্তর্জাতিক নারী দিবসটি হোক আমাদের সম্মিলিত যাত্রার একটি মোড় পরিবর্তনের সূচনা।
সম্পাদক – প্রদীপ রায়
ওটিএন বাংলা নিউজ
৮ মার্চ, ২০২৫