সেনাবাহিনীর ‘প্রস্তাবিত ‘রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ: কি হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে?
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর প্রধান সংগঠক (দক্ষিণ) হাসনাত আবদুল্লাহ বলেছেন, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ নিয়ে সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাদের সম্প্রতি আলোচনা ছিল “রাজনৈতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ”। তিনি গতকাল(২১ মার্চ) ঢাকায় এনসিপি কার্যালয়ে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “রাজনীতি নির্ধারণের দায়িত্ব রাজনীতিবিদদের হাতে থাকা উচিত, এবং রাজনীতির দিকনির্দেশনা সম্পর্কে সিদ্ধান্তও তাদের হাতেই থাকা উচিত।”
তার এই বক্তব্য আসে এমন এক সময়ে, যখন তিনি একটি ফেসবুক পোস্টে দাবি করেন যে গত ১১ মার্চ ক্যান্টনমেন্টে এক বৈঠকে তিনিসহ আরও দুজনকে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসিত করার একটি পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয়। এরপরই আজ এনসিপি ও ছাত্রনেতারা বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। সংবাদ সম্মেলনে হাসনাত সেই বৈঠক সম্পর্কে আরও ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ৫ আগস্টের পর থেকে সেনাবাহিনী ও ছাত্রনেতাদের মধ্যে বেশ কয়েকটি আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক বৈঠক হয়েছে।
তিনি বলেন, “আপনারা জানেন, সেদিনের বৈঠকটি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য ডাকা হয়েছিল।”
নিরাপত্তা ঝুঁকি সম্পর্কে হাসনাত বলেন, যতদিন ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র-নাগরিক ও সক্রিয় রাজনৈতিক শক্তিগুলো ঐক্যবদ্ধ থাকবে, ততদিন তিনি কোনো নিরাপত্তা ঝুঁকি দেখছেন না।
যখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে সেনাবাহিনী কি শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তখন হাসনাত মন্তব্য করেন, “এ বিষয়টি অপর পক্ষের কাছে জানতে চাওয়াই ভালো।”
সংবাদ সম্মেলনে এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামও বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, কোনো দল নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কি না বা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতে পারবে কি না, তা একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। তিনি যোগ করেন, “এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা সরকার ও বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে থাকা উচিত। সেনাবাহিনী বা কোনো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের এ বিষয়ে মন্তব্য, পরিকল্পনা, সিদ্ধান্ত বা প্রস্তাব দেওয়ার কোনো এখতিয়ার নেই।”
ইন্টারিম সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ থেকে সম্প্রতি পদত্যাগ করা নাহিদ আরও বলেন, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত অবশ্যই রাজনৈতিক সম্প্রদায়কে গণতান্ত্রিকভাবে নিতে হবে এবং বাংলাদেশে অন্য কোনো পদ্ধতি যেন গড়ে না ওঠে।
তিনি বলেন, “এগিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই সংকট কাটিয়ে উঠতে হবে।”
এর আগে বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় একটি বৈঠক করেন। ওই প্রতিনিধিদলকে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার কোনো পরিকল্পনা অন্তর্বর্তী সরকারের নেই।
প্রধান উপদেষ্টার এই বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা হচ্ছে—এমন আলোচনা সামনে আনা হয়। বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে এনসিপির মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে উদ্দেশ করে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন। তাতে তিনি লেখেন, ‘আওয়ামী লীগ ৫ আগস্টেই নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। উত্তরপাড়া ও ভারতের প্রেসক্রিপশনে আওয়ামী লীগের চ্যাপটার ওপেন করার চেষ্টা করে লাভ নেই।’
এরপর ফেসবুকে আরো একটি স্ট্যাটাস দেন হাসনাত আবদুল্লাহ। তিনি উল্লেখ করেন, ‘রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ’ নামে নতুন একটি ষড়যন্ত্র নিয়ে আসার পরিকল্পনা চলছে। এই পরিকল্পনা পুরোপুরি ভারতের। সাবের হোসেন চৌধুরী, শিরীন শারমিন ও তাপসকে সামনে রেখে এই পরিকল্পনা সাজানো হচ্ছে।
১১ মার্চ সেনানিবাসে হাসনাত আবদুল্লাহসহ দুজনের কাছে এমন একটি পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, ‘আমাদের প্রস্তাব দেওয়া হয়, আসন সমঝোতার বিনিময়ে আমরা যেন এই প্রস্তাব মেনে নিই। আমাদের বলা হয়, ইতিমধ্যে একাধিক রাজনৈতিক দলকেও এই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তারা শর্তসাপেক্ষে আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনে রাজি হয়েছে। একটি বিরোধী দল থাকার চেয়ে একটি দুর্বল আওয়ামী লীগসহ একাধিক বিরোধী দল থাকা নাকি ভালো। ফলে আপনি দেখবেন, গত দুই দিন মিডিয়াতে আওয়ামী লীগের পক্ষে একাধিক রাজনীতিবিদ বয়ান দেওয়া শুরু করেছেন।
উক্ত স্ট্যাটাসের শেষ অংশে হাসনাত বলেন, ‘আওয়ামী লীগ রাজনীতি করতে পারলে জুলাই ব্যর্থ হয়ে যাবে। আমাদের শরীরে একবিন্দু রক্ত থাকা পর্যন্ত আমাদের শহীদদের রক্ত আমরা বৃথা হতে দেব না। ৫ আগস্টের পরের বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের কামব্যাকের আর কোনো সুযোগ নেই; বরং আওয়ামী লীগকে অবশ্যই নিষিদ্ধ হতেই হবে।’
হাসনাতের এই স্ট্যাটাসের পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মী-সমর্থকেরাও ফেসবুকে এ বিষয়ে বিভিন্ন বক্তব্য তুলে ধরেন।
ঠিক এরকম একটি পরিস্থিতিতে গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন একদল শিক্ষার্থী। সেখান থেকে গতকাল বিকেলে বিক্ষোভ কর্মসূচির দেওয়া হয়।
গত শুক্রবার, ২১ মার্চ এই আলোচনায় যুক্ত হয় অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার বক্তব্য-সংবলিত একটি ভিডিও ক্লিপ। তিনি বিকেলে নিজের ফেসবুক পেজে ১৭ মিনিট ৩ সেকেন্ডের ওই ভিডিও পোস্ট করেন। ওই ভিডিও বক্তব্যে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করার প্রস্তাবে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার–উজ–জামান আপত্তি তুলেছিলেন বলে উল্লেখ করেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ।
জামায়াতে ইসলামীকে রাজনীতিতে পুনর্বাসন, এনসিপির সমন্বয়কদের দ্বন্দ্ব
এর আগে শুক্রবার এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে জামায়াতে ইসলামীকে রাজনীতিতে পুনর্বাসন করার জন্য বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সমালোচনা করেন। ষড়যন্ত্রকারীরা এখন আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনের চেষ্টা চালাচ্ছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
‘আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনের দেশবিরোধী চক্রান্ত মোকাবিলায়’ ছাত্র-নাগরিক, বিএনপি ও জামায়াতের বাংলাদেশের পক্ষের অংশ এবং সেনানিবাসে ও বেসামরিক প্রশাসনের বাংলাদেশ রক্ষাকারী অংশকে এই লড়াইয়ে শামিল হওয়ার আহ্বান জানান নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী। এরপরে এনসিপির অন্যান্য সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ, সারজিস আলমসহ অনেকেই তাঁর এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত জানান। পরে অবশ্য নাসীরুদ্দীন ফেসবুক থেকে স্ট্যাটাসটি সরিয়ে নেন। এ থেকেই সমন্বয়কদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানামুখী আলোচনার পাশাপাশি আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টার প্রতিবাদ ও গণহত্যার দায়ে দলটিকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে গতকাল শুক্রবার ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়।
ঢাকায় বিক্ষোভ
প্রথম আলো জানিয়েছে জুমার নামাজের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পৃথক পৃথক বিক্ষোভ মিছিল করেছে কয়েকটি সংগঠন। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ কেন্দ্রীয় মসজিদের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। পরে বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের সামনে সমাবেশ করে। সেখানে সংগঠনের কেন্দ্রীয় সদস্যসচিব জাহিদ আহসান বলেন, আওয়ামী লীগ নামে ও তাদের প্রতীক নিয়ে কাউকে রাজনীতি করতে দেওয়া হবে না। কচুক্ষেত থেকে নেওয়া সিদ্ধান্ত বাংলাদেশে বাস্তবায়িত হবে না।
বিকেলে রাজু ভাস্কর্যের সামনে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের’ ব্যানারে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়। সেখান থেকে ‘গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধকরণ মঞ্চ’ নামের একটি প্ল্যাটফর্মের ঘোষণা দেওয়া হয়। পরে আয়োজকেরা জানান, এই প্ল্যাটফর্মের নাম পরিবর্তন করে ‘গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধকরণ আন্দোলন’ করা হয়েছে।
ওই সমাবেশে ঘোষণাপত্র পাঠ করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সহসমন্বয়ক এ বি যুবায়ের। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে শনিবার তাঁদের অবস্থান কর্মসূচি ও গণ-ইফতার আয়োজনের কথা রয়েছে। একই দাবিতে রাজু ভাস্কর্যের সামনে বিক্ষোভ করে ইনকিলাব মঞ্চ।
আওয়ামী লীগের বিচার ও তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে শুক্রবার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করেন।
এখন সর্বমহলে একটাই আলোচনা, আওয়ামী লীগ কি তাহলে শীঘ্রই বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফিরে আসছে?