আজ ভোরের আলো যখন বাংলাদেশের পবিত্র মাটি স্পর্শ করেছে, সমগ্র বাংলাদেশ গভীর কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করেছে আমাদের সকল বীর শহীদদের যারা ১৯৭১ সালে মাতৃভূমির জন্য জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। শহর থেকে গ্রাম, প্রতিটি প্রান্তে আজ উড়ছে লাল-সবুজের পতাকা, বাতাসে ধ্বনিত হচ্ছে “আমার সোনার বাংলা”, যা আমাদের বীর শহীদদের প্রতি নিবেদিত এক অমর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
বাংলাদেশের ৫৫তম স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস কেবল একটি উদযাপন নয় – আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির জন্য একটি অঙ্গীকারের দিন। সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ, আত্মত্যাগের এক মহিমান্বিত প্রতীক, আজ রক্তস্নাত ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে – প্রতিটি পাপড়ি যেন এক একটি নীরব প্রার্থনা, প্রতিটি মালা এক একটি অঙ্গীকার, আমরা কখনো ভুলবো না। জাতীয় স্মৃতিসৌধ দাঁড়িয়ে আছে সেই সব সাহসী মানুষের স্মৃতির মিনার হিসেবে, যারা অন্ধকার শোষণের মুখোমুখি হয়েছিলেন বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার আলোয় পথ চলাতে।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ এই দিনেই শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার চূড়ান্ত লড়াই। ২৫ শে মার্চ কাল রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালি জাতির উপর নৃশংস আক্রমণ চালায়। কিন্তু তারা সেদিন ভুলে গিয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৃঢ় নেতৃত্বে ন্যায়ের জন্য জাগ্রত একটি জাতির অদম্য শক্তি একটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম দিতে পারে।
২৬ শে মার্চ বাঙালি জাতি এক হয়ে দাঁড়িয়েছিল, ভয়কে রূপ দিয়েছিল রোষে, আর শোষণকে পরিণত করেছিল স্বাধীনতার অদম্য যাত্রায়। নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে – কৃষক, ছাত্র-জনতা, মা-বোন, মুক্তিযোদ্ধা সবাই মিলে লড়েছিল অবিস্মরণীয় বীরত্বে। অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সেই সংগ্রামের বিজয় এলো, জন্ম নিল স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ।
আজ, বুধবারের এই দিন, আমরা শুধু ইতিহাস স্মরণ করছি না – আমরা সম্মান করছি, স্মরণ করছি ত্রিশ লক্ষ প্রাণের আত্মদান, অগণিত ত্যাগ, এবং একটি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি অটুট বিশ্বাসকে। শহীদের স্বপ্নগুলো বেঁচে আছে আমাদের অগ্রগতিতে, তাদের সাহস আমাদের সহিষ্ণুতায়, আর তাদের চেতনা আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপে।
আজ যখন আমরা স্বাধীনতার ৫৫ বছর পূর্ণ করছি, তখন দেখতে পাচ্ছি কিছু অদৃশ্য শক্তি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করতে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাসভবন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলোকে বিকৃত করার চেষ্টা চলছে। ইতিহাসের পাতা থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলতে, মুক্তিযুদ্ধের সত্যকে অস্বীকার করতে, এবং নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করতে একের পর এক অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।
কিন্তু আমরা কি ভুলে গেছি? বঙ্গবন্ধু শুধু একটি নাম নন, তিনি বাঙালির স্বপ্নের মূর্ত প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধ কেবল একটি যুদ্ধ ছিল না, এটি ছিল ন্যায়ের জন্য, মাতৃভূমির জন্য বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের লড়াই। তাই, যারা এই চেতনাকে ধ্বংস করতে চায়, তাদের সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হবে। কারণ, বাঙালির হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ চিরভাস্বর।
এই স্বাধীনতা দিবসে আসুন আমরা শপথ নিই—ইতিহাসের বিকৃতি রুখে দাঁড়াবো, বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করবো এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আগামী প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেবো। কারণ, বাংলাদেশের ইতিহাস আমাদের গর্ব, আমাদের অস্তিত্ব—এটাকে কেউ মিথ্যা দিয়ে ঢাকতে পারবে না। সত্যিকারের শ্রদ্ধা শুধু স্মরণে নয়, কাজে। আসুন আমরা অঙ্গীকার করি আমরা সেই মূল্যবোধকে ধারণ করবো যার জন্য তারা লড়েছিলেন – ন্যায়বিচার, সমতা ও ঐক্য। আসুন আমরা এমন একটি বাংলাদেশ গড়ি যেখানে কেউ পিছিয়ে পড়বে না, যেখানে ১৯৭১ এর আত্মত্যাগ শুধু কথায় নয়, কাজে সম্মানিত হবে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা চিরজীবী হোক।