সম্পাদকীয় | OTN Bangla
মেলবোর্ন, ০১ মে—সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের চলমান আইনি লড়াই আজ বাংলাদেশে ন্যায়বিচার, সাংবিধানিক অধিকার ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে গভীর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।
জামিন নিয়ে টানাপোড়েনের পর অবশেষে গতকাল অর্থাৎ বুধবার বাংলাদেশ হাইকোর্টের (Bangladesh Highcourt )দুই বিচারপতির বেঞ্চ তাঁর জামিন মামলায় রায় ঘোষণা করে।
কিন্তু, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে হাইকোর্টের (Bangladesh Highcourt)এই রায়ের বিরুদ্ধে, এবং চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিন স্থগিত রাখার জন্য দ্বারস্থ হয়েছেন দেশের সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার জজ আদালতে।
গতকালকের শুনানিতে সরকারের পক্ষে অংশ নিয়েছিলেন বাংলাদেশের অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আরশাদুর রউফ। যার জেরে মনে করা হচ্ছে, বাংলাদেশ হাইকোর্ট থেকে জামিন মিললেও এখনই জেলমুক্তির কোনরকম সম্ভাবনা নেই চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের। যদিও আগামী রবিবার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে শুনানির পর তা জানা যাবে।
গতকাল হাইকোর্ট রাষ্ট্রপক্ষ এবং চিন্ময় কৃষ্ণ দাস প্রভুর আইনজীবীদের বক্তব্য শোনেন। রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল অনীক আর হক শুনানি করেন। শুনানি চলাকালীন সময়ে রাষ্ট্রপক্ষে আরো উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুহাম্মদ আবদুল জব্বার ভুঞা, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ফরিদ উদ্দিন খান। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীগণ বারবার উল্লেখ করেন সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিনকে ঘিরে সংঘর্ষে চট্টগ্রামে নিহত হয়েছে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ। দেশকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত চিন্ময় কৃষ্ণ দাস। আদালত এই সময় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের বলেন, বিষয়গুলো যেহেতু মামলার এজাহারে নাই তাই অপ্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে এখানে কথা বলা যাবে না। আদালত যথার্থভাবে জানিয়ে দেন, যেসব বিষয় মামলার নথিতে নেই, সেগুলো আদালতে আলোচ্য হতে পারে না। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা—বিচারিক প্রক্রিয়া যেন প্রমাণ ও আইন অনুযায়ী চলে, আবেগ ও রাজনৈতিক চাপে নয়।
উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের ২৫ নভেম্বর, তাঁকে sedition (রাষ্ট্রদ্রোহ) মামলায় ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর গ্রেপ্তারের পর থেকেই দেশজুড়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ শুরু হয়, যা একটি গভীর জনঅসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ।
একটা লম্বা সময় চিন্ময় কৃষ্ণ দাস কে মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে
দুঃখজনকভাবে, ৩ ডিসেম্বর আদালত সরকারের আবেদনের প্রেক্ষিতে এবং আইনজীবী অনুপস্থিতির কারণে জামিন শুনানি পিছিয়ে ২০২৫ সালের ২ জানুয়ারিতে নির্ধারণ করে। আরও বিস্ময়কর হলো, সেই সময় কোনো আইনজীবী তাঁর পক্ষে আদালতে হাজির হননি। এই অনুপস্থিতির মূল কারণ ছিল চট্টগ্রাম বার অ্যাসোসিয়েশনের এক নজিরবিহীন ও নৈতিকতাবিরোধী সিদ্ধান্ত—যারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে চিন্ময়ের পক্ষে কেউ মামলা লড়তে পারবে না। এটি পেশাগত আচরণের লঙ্ঘন এবং বিচারিক প্রক্রিয়ার মৌলিক নীতিমালার পরিপন্থী।
বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সুস্পষ্টভাবে সুরক্ষিত:
- ধারা ৩২ অনুযায়ী, “আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না।”
- ধারা ৩৩(১) অনুযায়ী, “গ্রেপ্তারকৃত কোন ব্যক্তিকে যথাসম্ভব শীঘ্র গ্রেপ্তারের কারণ জ্ঞাপন না করিয়া প্রহরায় আটক রাখা যাইবে না এবং উক্ত ব্যক্তিকে তাঁহার মনোনীত আইনজীবীর সহিত পরামর্শের ও তাঁহার দ্বারা আত্মপক্ষ-সমর্থনের অধিকার হইতে বঞ্চিত করা যাইবে না।”
- ধারা ৩৩(৫) বলছে, “নিবর্তনমূলক আটকের বিধান-সংবলিত কোন আইনের অধীন প্রদত্ত আদেশ অনুযায়ী কোন ব্যক্তিকে আটক করা হইলে আদেশদানকারী কর্তৃপক্ষ তাঁহাকে যথাসম্ভব শীঘ্র আদেশদানের কারণ জ্ঞাপন করিবেন এবং উক্ত আদেশের বিরুদ্ধে বক্তব্য-প্রকাশের জন্য তাঁহাকে যত সত্বর সম্ভব সুযোগদান করিবেন।”
চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের ক্ষেত্রে উপরোক্ত প্রতিটি ধারা চরমভাবে লঙ্ঘিত করা হয়েছে। তাঁকে আইনজীবী নিযুক্ত করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, তাঁর আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, এমনকি তাঁর শুনানি এগিয়ে নেওয়ার আবেদনও ১২ ডিসেম্বর নাকচ করা হয়েছে। এইসব পদক্ষেপ শুধু সংবিধান বিরোধী নয়, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তি—বিশেষ করে আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সনদ (ICCPR)-এর ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদেরও লঙ্ঘন, যেখানে ন্যায্য বিচার পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।
সরকারের মধ্যেই সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিন নিয়ে বিভক্তি রয়েছে
বর্তমানের পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। হাইকোর্টের দুই বিচারপতির বেঞ্চ চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে জামিন দিলে, সঙ্গে সঙ্গেই সরকার আপিল বিভাগে গিয়ে জামিন স্থগিতের আবেদন করে। এতে স্পষ্ট হয়ে উঠছে, সরকারের মধ্যেই চিন্ময়ের বিষয়ে বিভক্ত মত বিদ্যমান—একপক্ষ চাইছে আইনি পথে তাঁকে মুক্তি দিতে, অপরপক্ষ যেন মরিয়া তাঁকে আটক রাখার জন্য।
চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিন এখন আর কেবল একজন ব্যক্তির মুক্তির প্রশ্ন নয়; এটি এখন বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার নিরপেক্ষতা, সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি এবং আইনি পেশার নৈতিকতা রক্ষার এক কঠিন পরীক্ষা। যদি তিনি দোষী হন, তবে তা আইনগত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রমাণিত হোক; কিন্তু রাজনৈতিক সুবিধা বা জনমতকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে তাঁকে আইনি সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত করা হলে, তা হবে ন্যায়বিচারের চরম অবমাননা। বাংলাদেশ আজ একটি সংকটময় মোড়ে দাঁড়িয়ে। বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা ও সংবিধানের মর্যাদা রক্ষা করাই এখন সময়ের দাবি।