মতামত
লেখা: শামীম আহমেদ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে একজন নারীর অবয়ব তৈরী করে সেটিতে জুতো পেটা করেছে উগ্র, মৌলবাদী গোষ্ঠী। এটি নিয়ে অনেকেই প্রতিবাদ করছেন, আপত্তি করছেন, উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। কিন্তু আপনাদের উষ্মা ও আপত্তিতে আপনারা মূল সমস্যাগুলো না দেখার ভান করছেন। এই মূল সমস্যাগুলো কী এবং কেন এটি আত্মঘাতী সেটা একটু বলি।
১) আপনাদের কেউ কেউ নিজেদের এই বলে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করছেন যে এটি শেখ হাসিনার প্রতীকী অবয়ব, তাই এটিকে জুতো পেটা করা জায়েজ। আপনারা ভুল করছেন। শেখ হাসিনা আপনাদের অপছন্দের হতেই পারেন, কিন্তু নিজেকে প্রশ্ন করুন শেখ হাসিনাকে বিশ্ববাসী কীভাবে চেনে?
শেখ হাসিনাকে বিশ্ববাসী চেনে “বাংলাদেশে আয়রন লেডি” হিসেবে। স্বাধীন বাংলাদেশে শেখ হাসিনার চাইতে শক্তিশালী ও নারী নেতৃত্ব আসে নাই কখনও। শেখ হাসিনা আপনার মতে স্বৈরাচারী হতে পারে, একনায়ক হতে পারে; কিন্তু নারীর অগ্রাধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার চাইতে বেশী ভূমিকা কেউ নেয় নাই আগে। শেখ হাসিনার ১৬ বছরের শাসনামলে নারীর অধিকার রক্ষায়, চাকরিতে, প্রোমোশনে, নিরাপত্তায় তিনি যত উদ্যোগ নিয়েছেন, বাংলাদেশে তো বটেই, পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় এত অগ্রগণ্য ভূমিকা গত কয়েক দশকে আর কেউ রাখে নাই।
নাজমুন আরা সুলতানার কথা মনে আছে আপনাদের? আমি নিশ্চিত বেশীরভাগেরই নাই। সুপ্রিম কোর্টে বাংলাদেশের প্রথম নারী বিচারপতি ছিলেন তিনি। কেন জানেন? শেখ হাসিনা চেয়েছিলেন বলে। হাইকোর্টে স্থায়ীভাবে যোগদানের ৯ বছর পর ২০১১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগের প্রথম নারী বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন এই সুলতানা। এর দুই বছর পর ২০১৩ সালের ১ এপ্রিল তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন তাকে আপিল বিভাগের একটি বেঞ্চের নেতৃত্ব দেন । সবই হয় শেখ হাসিনার আগ্রহে।
শিরীন শারমিন চৌধুরীকে ভুলে যাননি নিশ্চয়। তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম নারী হিসেবে সংসদের স্পিকার নির্বাচিন হন। কেন জানেন? শেখ হাসিনা চেয়েছিলেন। শেখ হাসিনাকে জোর করে ভারতে পাঠিয়ে দেবার পরে সংবিধান অনুযায়ী এই শিরিন শারমিনের ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব নেবার কথা। সেটি বুঝতে পেরে জঙ্গী, পঞ্চতান্ডবরা অবৈধভাবে সংসদ ভেঙে দেয়, যাতে আরেকজন নারী দেশের প্রধানমন্ত্রী না হতে পারেন।
শেখ হাসিনা আর কিছুদিন ক্ষমতায় থাকলে আপনারা একজন নারী প্রেসিডেন্টও পেতেন। ইউনুস, পঞ্চতান্ডব ও ডার্টি মাস্টারমাইন্ডসদের সরকার কেন নির্বাচন দিতে চায় না জানেন? তারা খালেদা জিয়াকে প্রধানমন্ত্রী হতে দিবে না। আরেকজন নারী তারা হজম করতে পারবে না। শেখ হাসিনা নারীদের তাদের প্রাপ্য, যোগ্য জায়গাটা দিতে চেয়েছিলেন, কোন আলগা খাতির করেন নাই। কিন্তু দেশের আর কোনো শাসক কখনও নারীদের তাদের যোগ্য জায়গাটাই দিতে চান নাই। সামনে আর কেউ সহসা দিবে, এই আশাও করবেন না দয়া করে। ৫ অগাস্ট ২০২৪ সেই আশার কবর হয়ে গেছে।
তাই রাজু ভাস্কর্যে এই হামলা শেখ হাসিনার উপর ভেবে আত্মতৃপ্তিতে ভুগবেন না। এই হামলা বাংলাদেশের নারীদের উপর। আপনি জুলাই আন্দোলনে স্বতঃস্ফুর্ত ছিলেন কিন্তু অগাস্ট ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন, সেটা আপনার দোষ না। কিন্তু আপনি যদি এখনও বুঝতে না পারেন যে এই দেশ খুবই ধারাবাহিকভাবে ইরান, আফগানিস্তানের দিকে যাচ্ছে এবং একজন নারী হয়েও আপনি সেটার প্রতিবাদ করছেন না – সেটি আপনার দোষ।
২) আরেকটা জিনিস মনে রাখবেন, নারীদের উপর মোল্লাদের এই ক্ষোভ ৯ মাস পুরনো নয়; এটি বহুদিন ধরেই ছিল, আছে। কিন্তু শেখ হাসিনা এদের গলায় শিকল পরিয়ে রেখেছিলেন। শয়তানকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। শেখ হাসিনার ভয়ে এইসব জঙ্গী, উগ্র, সন্ত্রাসী, রাজাকারের বংশধর, পাকিস্তানী বীর্য, মৌলবাদী – সব একঘাটে পানি খেত। তারা শেখ হাসিনার কথা শুনলে গুটিয়ে তাদের গর্তে ঢুকে যেত। পৃথিবীর সবাই মহামানব না; অনেকেই শয়তান। শয়তানকে সবাই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না; শেখ হাসিনা পারতেন। শেখ হাসিনা সেই নারী যিনি ৫ ওয়াক্ত নামাজ পরে, রোজা-কালাম, সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষের অধিকার নিশ্চিত করে আবার রাষ্ট্র পরিচালনাও করতেন। তিনি বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে মডারেট মুসলিম দেশ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা নাই, এখন শয়তান সব রাস্তায় নেমে এসেছে। তাদের শিকল ভেঙে গেছে।
৩) এই ঘটনায় মূল যে বিষয়টি নিয়ে খুব বেশী মানুষকে বিচলিত হতে দেখলাম না, সেটা হচ্ছে এটি কোথায় হচ্ছে তার গুরুত্ব, তাৎপর্য অনুধাবন করা। রাজু ভাস্কর্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র ও উদারতার প্রতীক। সেই জায়গায় নারী অবমাননার এই ঘটনা ঘটেছে। জঙ্গী, মৌলবাদী, উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠী তাতে উল্লাস করছে, এটি বিস্ময়কর নয়। আতংকিত হবার ঘটনা হচ্ছে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছে, যে কোন অন্যায় প্রতিরোধে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে, সেখানে এখন নির্বিবাদে উগ্র মৌলবাদীরা নারীর অবমাননা করতে পারছে? এটি তখনই বোঝা যাচ্ছিল যখন জুলাই আন্দোলন ও অগাস্ট ষড়যন্ত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পঞ্চতান্ডব ও ডার্টি মাস্টারমাইন্ডরা প্রকাশ্যে ষড়যন্ত্র করেছে, যখন ডাকসুতে নুরুর মতো একটা তৃতীয় শ্রেণীর মেরুদন্ডহীন-বুদ্ধিহীন মানুষ নির্বাচিত হয়েছে ভিপি হিসেবে।
আপনারা বুঝতে পারছেন না যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে যখন এই ঘটনা ঘটে, যখন রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে এই বীভৎস ঘটনা ঘটে – তখন আপনাদের ঘরে বসে আশাবাদী হবার সব বাতি নিভে গেছে?
আমি ডিসেম্বরে দেশে গিয়ে আমার খুবই উদারপন্থী এক মডেল, নায়িকা, গায়িকা, বুদ্ধিজীবী, সুশীল, উচ্চশিক্ষিত, উচ্চবিত্ত বান্ধবীকে বলেছিলাম, তোমরা যে শেখ হাসিনার পতন ঘটিয়ে মৌলবাদীদের ক্ষমতায় আনলে, তোমার কি মনে হয় তুমি এই পোষাকে, এই মুক্তচিন্তা নিয়ে একবছর পর বাংলাদেশে টিকতে পারবে? সে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেছিল, “যখনকারটা তখন দেখা যাবে।”
বন্ধু, তোমার “যখনকারটা তখন” খুব বেশী দূরে ছিল না, বর্তমানে চলে এসেছে। এখন সেই বাংলাদেশকে তুমি কেমন দেখছ?
লেখক: শামীম আহমেদ, টরন্টো, অন্টারিও, ৩ মে ২০২৫
(উল্লিখিত মতামত লেখকের নিজস্ব, এবং প্রতিষ্ঠানের অবস্থান বা দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত করে না।)