মেলবোর্ন, ১১ মে- রবিবার, অসংখ্য অস্ট্রেলিয়ান তাদের মা এবং জীবনের বিশেষ নারীদের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করবেন। কেউ দেবেন ফুল, কার্ড বা উপহার, কেউ হয়তো মাকে উপহার দেবেন বিছানায় প্রাতরাশ কিংবা পরিবার নিয়ে বাহিরে একসঙ্গে খাবার।
আজ এই দিবসটি অস্ট্রেলিয়ান ক্যালেন্ডারের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও, মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারটিকে মাতৃত্বকে সম্মান জানানোর জন্য উৎসর্গ করার ধারণাটি কোথা থেকে এল?
শান্তি ও যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন থেকেই সূচনা
আধুনিক মাদার্স ডে-র সূত্রপাত মূলত আমেরিকার গৃহযুদ্ধ (১৮৬১-৬৫) পরবর্তী শান্তি এবং যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে। ১৮৭০ সালে, মার্কিন লেখিকা ও নারী অধিকার কর্মী জুলিয়া ওয়ার্ড হাউ (যিনি Battle Hymn of the Republic–এর রচয়িতা হিসেবেও পরিচিত), নারীদেরকে বিশ্বজুড়ে শান্তির জন্য একত্রিত হওয়ার আহ্বান জানান। পরে এই আহ্বান ‘মাদার্স ডে প্রোক্লেমেশন’ নামে পরিচিত হয়।
তিনি প্রস্তাব দেন, প্রতিবছর জুন মাসে ‘মায়েদের শান্তির দিন’ পালিত হোক। তবে এই ধারণা মূলত জনপ্রিয়তা পায় ১৯০৮ সালে, যখন ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার বাসিন্দা আনা ম্যারি জারভিস তাঁর মা অ্যান রিভস জারভিসের স্মরণে একটি গির্জায় স্মৃতিসভা আয়োজন করেন।
অ্যান জারভিস ছিলেন একজন শান্তি কর্মী যিনি গৃহযুদ্ধের সময় আহত সৈনিকদের সেবা করেছিলেন এবং জনস্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য মাদার্স ডে ওয়ার্ক ক্লাব গঠন করেন।
মেয়ে আনা জারভিস চেয়েছিলেন তাঁর মায়ের কাজকে এগিয়ে নিতে এবং সকল মায়েদের সম্মান জানাতে একটি নির্দিষ্ট দিন প্রতিষ্ঠা করতে।
অবশেষে, তাঁর নিরলস প্রচেষ্টার ফলে ১৯১৪ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারকে আনুষ্ঠানিকভাবে মাদার্স ডে ঘোষণা করেন।
অস্ট্রেলিয়ায় মাদার্স ডে
অস্ট্রেলিয়ায় প্রথম মাদার্স ডে পালিত হয় ১৯২৪ সালে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপরই। সিডনির বাসিন্দা জ্যানেট হেইডেন নিউইংটন স্টেট হাসপাতালে নিয়মিত এক বৃদ্ধা বন্ধুকে দেখতে যেতেন। সেখানে তিনি লক্ষ্য করেন, অনেক একাকী বৃদ্ধা মা রয়েছেন যাদের জন্য কেউ কিছু করে না। এরপর তিনি স্থানীয় স্কুল ও ব্যবসায়ীদের সহযোগিতায় তাঁদের জন্য উপহার সংগ্রহ করেন।
সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ অধ্যাপক রিচার্ড ওয়াটারহাউস বলেন, “প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অনেক নারী মা হওয়ার সুযোগ হারিয়েছিলেন, অনেকেই বিধবা হয়েছিলেন। সেই সময় একটি বিশেষ আবেগ তৈরি হয় মাদার্স ডে ঘিরে, আর আমেরিকান ধারাটিই তখন অস্ট্রেলিয়ায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।”
বাণিজ্যিকীকরণ
১৯২০-এর দশকে আমেরিকায় মাদার্স ডে বাণিজ্যিক রূপ নিতে শুরু করে। হ্যালমার্ক-এর মতো কার্ড কোম্পানি ও ফুল ব্যবসায়ীরা এই দিনটিকে লাভের উৎস হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে।
আনা জারভিস এতে খুব ক্ষুব্ধ হন এবং তাঁর জীবনের বাকি সময়টা মাদার্স ডে-র বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেই কাটিয়ে দেন। তিনি শেষ জীবনে নিঃস্ব অবস্থায় ১৯৪৮ সালে এক মানসিক হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।
অধ্যাপক ওয়াটারহাউস বলেন, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯২০-এর দশকে ভোক্তাবাদী সংস্কৃতির অংশ হিসেবে মাদার্স ডে-র এই রূপ দেখা যায় এবং তা দ্রুতই অস্ট্রেলিয়াতেও ছড়িয়ে পড়ে।”
আজ অস্ট্রেলিয়ায় মাদার্স ডে একটি বিলিয়ন ডলার মূল্যের শিল্পে পরিণত হয়েছে।
পারিবারিক মিলনের দিন
যদিও শুরুটা ছিল শান্তি ও নারীর সম্মান বৃদ্ধির লক্ষ্য নিয়ে, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মাদার্স ডে হয়ে উঠেছে একটি পারিবারিক মিলনের বিশেষ উপলক্ষ।
অধ্যাপক ওয়াটারহাউস বলেন, “এখন এটি শুধু মায়েদের প্রতি সম্মান জানানোই নয়, বরং পরিবারের সবাইকে একত্রিত হওয়ার একটি সুযোগ হিসেবে দেখা হয়। ব্যস্ত জীবনে পরিবার একসঙ্গে সময় কাটাতে পারে না, তাই এই দিনটি আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে।”
আজকের মাদার্স ডে — সকল নারীর জন্য
“এটি আর নির্দিষ্ট কিছু মূল্যবোধ বা নারীর নির্দিষ্ট ভূমিকায় সীমাবদ্ধ নয়,” অধ্যাপক বলেন। “আজ মাদার্স ডে-র আবেদন সার্বজনীন এবং বহু-সাংস্কৃতিক, যা অস্ট্রেলিয়ার সব জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের আকৃষ্ট করে।”