প্রদীপ রায়, সম্পাদক, OTN Bangla
প্রকাশিত, মেলবোর্ন, ১৭ মে— ২০২৫ সালের ১৫ মে, The Economist বাংলাদেশ নিয়ে একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম দেয়—“After the revolution, Bangladesh is hoping to reform”—এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, অর্থনীতি এবং ৫ আগস্টের পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এতে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে এসেছে: শেখ হাসিনা সরকারের পতনের নয় মাস পরেও, বাংলাদেশ কি সত্যিই কাঙ্ক্ষিত সংস্কারের পথে এগিয়ে যাচ্ছে?
শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হবার নয় মাস পেরিয়ে গেছে। দেশজুড়ে গণআন্দোলনের চাপে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এক নতুন বাংলাদেশের সূচনার প্রত্যাশা জাগিয়েছিল।
কিন্তু The Economist–এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদন ইঙ্গিত দিচ্ছে, এই আশার পথ সহজ নয়, বরং অনেক জটিলতার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে জাতিকে।
নোবেল পুরস্কার বিজয়ী এবং ক্ষুদ্রঋণ আন্দোলনের প্রবর্তক ডঃ মুহাম্মদ ইউনুস এখন দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান। ২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনা ও তার আওয়ামী লীগ সরকার এক ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর, তিনি দায়িত্ব নিয়েছেন একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে পুনর্গঠনের।
তার কথায়, “আমরা সঠিক পথে এগোচ্ছি, জনগণ আমাদের সঙ্গে রয়েছে, আমরা আশাবাদী।”
এই আশাবাদ এখন অত্যন্ত জরুরি। কারণ, শেখ হাসিনার পতনের পর তার শাসনামলের ভয়াবহ অনিয়মগুলো একে একে প্রকাশ্যে এসেছে। এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, প্রতি বছর প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। হত্যা, গুম, গণহত্যার মতো গুরুতর অভিযোগে মামলা জমা হচ্ছে—যদিও তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। রাজনৈতিক মহলের বিভিন্ন অংশ থেকে জোরালো দাবি উঠেছে—এই ধরনের নির্যাতন আর যেন না ফিরে আসে, সেই লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক সংস্কার অবশ্যই প্রয়োজন।
কিন্তু বাস্তবতা বলছে, বিপ্লবের ৯ মাস পরেও কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনা সহজ হচ্ছে না।
শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পরপরই ড. ইউনুস একাধিক সংস্কার কমিশন গঠন করেন—সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা ও বিচার বিভাগের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে পরিবর্তনের লক্ষ্যে। এই কমিশনগুলোতে সিভিল সোসাইটি ও শিক্ষাবিদদের স্থান দেওয়া হয়েছে। এরপর গঠিত হয় ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’—যারা বিভিন্ন দলের মতামত ও প্রস্তাব একত্র করে একটি একক “জুলাই সনদ” তৈরির চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে ৩৫টি রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে ১৬৬টি প্রস্তাব জমা পড়েছে।
কিন্তু ঐকমত্য অর্জন কঠিন। কিছু দল টেক্সটাইল খাত বা শিক্ষার প্রতি অবহেলার অভিযোগ তুলেছে। নারীদের জন্য প্রস্তাবিত সংস্কার কমিশন সবচেয়ে বিতর্কিত হয়েছে—যেখানে ইসলামিক উত্তরাধিকার আইনে নারীদের অধিকারের প্রসারে প্রস্তাব রাখা হয়েছে, যা ইসলামপন্থী দলগুলোর প্রতিবাদকে আরও উসকে দিয়েছে।
তবুও সংস্কারপন্থীদের মধ্যে আশাবাদ রয়ে গেছে। ড. আলী রিয়াজ, ঐকমত্য কমিশনের ভাইস-চেয়ারম্যান, ইতোমধ্যে উচ্চ আদালতের বিচারপতি নিয়োগে স্বাধীন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার মতো ইতিবাচক অগ্রগতির কথা বলেছেন। দ্বিতীয় পর্যায়ের সংলাপ ১৫ মে-র পর শুরু হবে, এবং আগস্টের মধ্যেই জুলাই সনদ সম্পন্ন হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন।
যদি এই সময়সূচি রক্ষা করা যায়, তবে এ বছরের ডিসেম্বরেই নির্বাচন হতে পারে। যদিও ড. ইউনুস বলছেন, নির্বাচন ২০২৬ সালের জুনের মধ্যেই হবে এবং তিনি নিজে অংশ নেবেন না। কিন্তু বিলম্বের মূল্যও দিতে হচ্ছে। দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা ও মূল্যস্ফীতি কিছুটা স্থিতিশীল হলেও, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দুর্বল। আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি নিয়েও জনমনে অসন্তোষ রয়ে গেছে—এক জরিপে দেখা গেছে, ৬০ শতাংশ মানুষ মনে করে, অবস্থার উন্নতি হয়নি।
প্রতিদিনের রাস্তায় প্রতিবাদ এখন এক সাধারণ চিত্র। আওয়ামী লীগের বিচার নিশ্চিত করার জন্য সরকারের সিদ্ধান্তে গঠিত নতুন রাজনৈতিক দল আন্দোলন করেছে। অবশেষে, ১২ মে নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করে তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণে নিষেধাজ্ঞা দেয়। তবে দলটির বিরুদ্ধে জনরোষ থাকলেও, সমর্থন একেবারে নিঃশেষ হয়নি।
আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা মোহাম্মদ আরাফাত এখনো দাবি করেন—তাদের “জনগণের ম্যান্ডেট” ছিল এবং “জিহাদিদের সহিংসতায়” তাদের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তিনি ঘোষণা করেছেন, “বাংলাদেশে আমাদের ন্যায্য অবস্থান পুনরুদ্ধারে আমরা লড়াই করব।”
অতএব, ক্ষমতার বাইরে গিয়েও আওয়ামী লীগ এখনও বাংলাদেশে রাজনৈতিক কম্পন সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখে।
সম্পাদকীয় মন্তব্য:
বাংলাদেশে একটি অভ্যুত্থান ঘটেছে, কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক সংস্কার কি সত্যিই বাস্তবায়ন হচ্ছে? এই মুহূর্তে অন্তর্বর্তী সরকার ও ড. ইউনুসের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ—সকল রাজনৈতিক শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করা। নিষেধাজ্ঞা নয়, ব্যালটই হোক চূড়ান্ত মীমাংসা।
প্রকাশিত: OTN Bangla, ১৭ মে ২০২৫