ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতার অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত পৌনে ১১টার দিকে ইন্তেকাল করেন।
আজ উনার জানাজা শেষে দাফন কাজ সম্পন্ন হয়েছে। একজন স্বনামধন্য শিক্ষকের জানাজা কেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ বা শহীদ মিনারে করতে দেওয়ার অনুমতি মেলেনি? ফেসবুকে একজন মন্তব্য করেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ড. আরেফিন সিদ্দিক স্যারের জানাজা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ বা শহীদ মিনারে করতে অনুমতি মিলেনি। একজন শিক্ষকের লাশকেও এত ভয়?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের মৃত্যু তাঁর শিক্ষার্থী, সহকর্মী এবং অনুরাগীদের হৃদয়ে গভীর শূন্যতা রেখে গেলেন। একজন শিক্ষক, পরামর্শদাতা এবং প্রশাসক হিসেবে তাঁর অবদান সর্বজনস্বীকৃত। মানবিক মূল্যবোধকে প্রাতিষ্ঠানিক সাফল্যের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়ে তিনি যে শিক্ষার আলো ছড়িয়েছেন, তা অসামান্য।
কিন্তু তাঁর শেষ বিদায়ের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর মৃতদেহ আনার অনুমতি না দেওয়ার ঘটনাটি তাঁর মর্যাদাপূর্ণ শেষ অন্তিম যাত্রায় একটি কালো ছায়া ফেলেছে। জীবন ও মৃত্যুর মতো মুহূর্তকেও রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখতে আমাদের অক্ষমতাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে।
অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক কেবল একজন শিক্ষকই ছিলেন না; তিনি ছিলেন অসংখ্য শিক্ষার্থীর জন্য আশা ও অনুপ্রেরণার উৎস। রাজনৈতিক ও আদর্শগত বিভেদের ঊর্ধ্বে উঠে শিক্ষার্থীদের সাথে তাঁর যোগাযোগ, ভালো মানুষ গড়ার অঙ্গীকার এবং ক্লাসরুমে তাঁর কোমল কিন্তু গভীর প্রভাব তাঁকে সকলের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অর্জন করিয়েছিল। তাঁর ছাত্ররা, যারা আজ সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভাবশালী ভূমিকা রাখছেন, তাঁকে শুধু একজন শিক্ষক হিসেবেই নয়, একজন নৈতিক দিকনির্দেশক হিসেবেও স্মরণ করেন। তাঁর জীবন, কর্ম এবং দর্শন প্রমাণ করে যে শিক্ষা কেবল ডিগ্রি অর্জনের বিষয় নয়, এটি চরিত্র ও মানবতা গঠনের বিষয়।
তবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর প্রিয় কর্মস্থলে মৃতদেহ নিয়ে আসা এবং জানাজার আয়োজন না করার সিদ্ধান্ত ক্ষোভ ও হতাশার সৃষ্টি করেছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি চার দশকেরও বেশি সময় ধরে কর্মরত ছিলেন, কেবল তাঁর কর্মস্থলই ছিল না, এটি ছিল তাঁর দ্বিতীয় ঘর। এখানেই তিনি অসংখ্য জীবনকে স্পর্শ করেছেন, প্রজন্মের পর প্রজন্মকে শিক্ষা দিয়েছেন এবং জাতির বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোতে অবদান রেখেছেন। তাঁকে এই প্রতিষ্ঠান থেকে শেষ বিদায় না দেওয়া কেবল তাঁর স্মৃতির প্রতি অবমাননাই নয়, বরং এটি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার মূল্যবোধকে ছাপিয়ে যাওয়া সংকীর্ণ রাজনীতির প্রতিফলন।
তাঁর মৃতদেহ বিশ্ববিদ্যালয়ে না নিয়ে আসার পেছনে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যেসব যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন তা অগ্রহণযোগ্য। কেউ বলছেন লজিস্টিক সমস্যার কারণে, আবার কেউ কেউ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের ইঙ্গিত দিচ্ছেন। যাই হোক, এই সিদ্ধান্তটি একজন শ্রদ্ধেয় মৃত ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধার অভাব হিসেবেই প্রতীয়মান হয়েছে, যিনি তাঁর সমগ্র জীবন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং এর শিক্ষার্থীদের উন্নয়নে উৎসর্গ করেছিলেন। যে একজন শিক্ষক, যিনি সর্বদা ঐক্য, মানবতা এবং সহমর্মিতার কথা বলতেন, তাঁকেই একটি মর্যাদাপূর্ণ বিদায় থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিকের উপাচার্য হিসেবে কর্মকাল নিয়ে সমালোচনা নতুন কিছু নয়, যেমনটি যেকোনো প্রশাসকের ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক। তাঁর রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা এবং প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে, এবং মতপার্থক্য থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে, এমনকি তাঁর সমালোচকরাও তাঁর শিক্ষক হিসেবে অবদান এবং শিক্ষার্থীদের প্রতি তাঁর অঙ্গীকারের কথা স্বীকার করেন। সব রাজনৈতিক মতাদর্শের শিক্ষার্থীরা তাঁর মৃত্যুতে একত্রে শোক প্রকাশ করেছেন, এটি তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং সবার ভালোবাসা অর্জনের ক্ষমতারই প্রমাণ।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এই সিদ্ধান্ত কেবল তাঁর শিক্ষার্থী ও অনুরাগীদের অনুভূতিই আহত করেনি, বরং এটি জাতি হিসেবে আমরা কেমন মূল্যবোধ ধারণ করি তা নিয়েও প্রশ্ন উঠা অত্যন্ত স্বাভাবিক। যদি আমরা তাঁর মতো একজন শিক্ষককে তাঁর শেষ মুহূর্তে সম্মান দেখাতে না পারি, তবে এটি আমাদের সমষ্টিগত বিবেকের প্রতি একটি গুরুতর প্রশ্ন। তাঁকে তাঁর কর্মস্থলে শেষ বিদায় না দেওয়া তাঁর আদর্শের প্রতি আমাদের অবমাননাকেই প্রকাশ করে।
এই শোকের মুহূর্তে, সংকীর্ণ রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে একজন মানুষকে সম্মান দেখানো আমাদের কর্তব্য, যিনি শিক্ষা ও মানবতার জন্য তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে, এই শ্রদ্ধা নিবেদনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করা উচিত ছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত বিভেদ ও অসম্মানের প্রতীক হিসেবে ইতিহাস হয়ে থেকে গেল।
প্রদীপ রায় –
সম্পাদক, ওটিএন বাংলা, মেলবোর্ন
১৪ মার্চ, ২০২৫