‘যে গোপনে আসিয়াছিল, তাহাকে গোপনেই যাইতে দিলাম।
কিন্তু এই নির্জন নিশীথে সে যে তাহার কতোখানি আমার কাছে ফেলিয়া রাখিয়া গেল, তাহা কিছুই সে জানিতে পারিল না।’ কম্পিউটার স্ক্রিনে লেখাটুকু লিখে আনমনেই জানালার বাইরে তাকিয়েছিল দীপ্তি। ফয়সাল যে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে তা খেয়াল করেনি। লেখালেখির এই সময়টাতে দীপ্তি এতোটাই আনমনা থাকে চারদিকের পৃথিবীতে তখন কারো উপস্থিতিই সে টের পায়না।
কি রে শরৎবাবুকে কপি পেস্ট করে চালাচ্ছিস নাকি লেখা আজকাল?
উঁকি দিয়ে না জানিয়ে অন্যের লেখা পড়া খুব খারাপ অভ্যাস। কখন এসেছো? এসেছি অনেকক্ষন। তুই বাসায় তাই জানতামনা। ভেবেছিলাম হোস্টেলে তুই। যেই মাত্র মা বললো ও ঘরে লেখালেখি করছে, ছুটে এসে অনুমতি ছাড়া লেখা পড়া শুরু করলে। আহা একটু পড়েছি আর কি। তা উত্তর তো দিলিনা। শরৎবাবুর লেখা দিয়ে গল্প শুরু, প্লাগারিজম হয়ে যাবে না?
না হবেনা। কারণ আমি বর্ণনায় লিখবো লাইনগুলো নায়িকার মাথায় ঘুরছিলো। তুই আমাকে নিয়ে একটা গল্প লিখবি? তোমার মতো খোলা বইয়ের আবার গল্প হয় নাকি? কতটুকু পড়তে পেরেছিস আমার, বল শুনি?
শোন তোমায় পড়ার কোন চেষ্টা আমি করিনি। তোমার গল্পটুকু তোমার ভার্সিটির ঐ কেয়া না বকুল সুন্দরী তার লেখার জন্য তোলা থাক। যার উদাহরণ প্রায়ই টানো আমার লেখালেখির সাথে।
তুই কেন পড়তে চাসনা?
ফয়সাল ভাই, আমি তোমার ব্যাপারে আগ্রহী না। তাই কোন তথ্য উপাত্ত আমি অন্তত তোমার ব্যাপারে এই মূহুর্তে জানতে চাইনা।
কিন্তু আমি তো চাই, কেয়া বকুল ছাড়াও তুই ও আমার সম্পর্কে কিছু লিখ। আচ্ছা লিখবো, এখন যাওতো। মায়ের সাথে গল্প করো। আমার মাথা থেকে লেখার প্লট চলে যাচ্ছে। আচ্ছা যাচ্ছি। আমি কিন্তু অপেক্ষায় থাকবো।
ফয়সাল সম্পর্কে দীপ্তির গ্রামের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। ঢাকা শহরে ওর পরিচিত বলতে ছিল এই দীপ্তিদের পরিবার। চার বছর আগে ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ার জন্য যখন প্রথমবার হোস্টেলে যাবার আগে দীপ্তিদের বাসায় আসে তখন তেমন কোন কথাই বলতে পারতোনা সে। কথায় বলে শহরের বাতাসে নাকি যাদু আছে। সেই যাদুর জোরেই ফয়সালের ভালো রেজাল্টের পাশাপাশি কথা বলা আর চালচলনের উন্নতিটুকু হয়ে যায় বছর খানেকের মধ্যে। দীপ্তির অবশ্য সেই স্মার্ট ফয়সালকে দেখার সুযোগ হয় একই ক্যাম্পাসে পড়ার সুবাদে। দীপ্তিদের বাড়িতে বরাবরই ফয়সাল নিজেকে গোবেচারা ভাবেই উপস্থিত রাখতো ।
দীপ্তির এইচএসসির পর ওর মা কয়েকবার বলেছিল ফয়সালের কাছ থেকে কোন সাজেশন নেবে কিনা বা ওকে পড়াতে বলবে কিনা? কিন্তু শহরের নামী কলেজ থেকে পাশ করা দীপ্তি এক বাক্যেই সেটা নাকচ করে দেয়। দীপ্তি যে ফয়সালের কাছে পড়তে চায়নি সেটা ওর মা হয়তো কথায় কথায় কখনও ফয়সালকে বলে দিয়েছিল। তারপর থেকেই দেখা হলেই ফয়সাল ঐ ব্যাপারটা নিয়ে খোঁচাতো দীপ্তিকে। গ্রামের ছেলে বনাম শহুরে মেয়ে, তোর সাথে তো কথাও বলতে হয় মেপে, এই জাতীয় খুঁনসুটি থেকেই তাদের মধ্যে বছর তিনেকের বয়সের পার্থক্য থাকলেও একটা সু্ন্দর সম্পর্ক হয়ে ওঠে। এই বয়সের ছেলেমেয়েদের মেলামেশাটা ভয়ের কারণ হলেও দীপ্তির মা তেমন আপত্তি করেননি কখনও ওদের ব্যাপারটা নিয়ে এর মূল কারণ ফয়সালের মা না থাকা। আর ওদের বাড়িতে ছয় মাসে নয় মাসে এলেও ফয়সাল মূলত দীপ্তির মা বাবার সাথেই বেশী সময় গল্প করে কাটাতো। দীপ্তির সাথে হয়তো খাবার টেবিলে কথা হতো সামান্য যার বেশীরভাগই ছিল দুষ্টুমীর ছলে বলা কথা। আর নয়তো ক্যাম্পাসে হুটহাট দেখা হলে একটু আধটু কথা।
ফয়সালের সাথে তার সম্পর্কটা অন্য কোন দিকে যেতে পারতো কিনা সেটা নিয়ে অনেকবার ভেবেছে দীপ্তি। বিশেষ করে বছরখানেক আগে হুট করে ছুটে আসা কিছু মূহুর্ত এক বর্ষণমুখর বিকেলে দীপ্তিকে বহুবার ভাবিয়েছে গত একটা বছর।
পরেরদিন এসাইনমেন্ট জমা দিতে হবে বলে লাইব্রেরীতে মুখ ডুবিয়ে থাকায় কখন যে ঘড়ির কাঁটা শেষ বিকেলের ঘরে ছুটে গেছে টের পায়নি দীপ্তি। যখন বের হয়েছে লাইব্রেরী থেকে তখন আকাশ ঘন অন্ধকার। রাস্তায় পা দিতেই বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। মুষলধারে ঝরে পড়ার আগে আগে কোনরকমে সামলে আবার লাইব্রেরীর বারান্দায় উঠে যেতে বাধ্য হয় দীপ্তি। কিছুটা সময় দাঁড়াতেই মোবাইল বেজে ওঠে। স্ক্রিনে ফয়সালের নাম্বার। ক্যাম্পাসেই নিশ্চয়ই আছে ভেবে এদিক ওদিক চোখ দিয়ে খুঁজে ফোন ধরে দীপ্তি।
হ্যালো? তুই কি লাইব্রেরীর সামনে দাঁড়ানো?
হুম। এমন বৃষ্টি বের হবার মুখে। আটকে গেলাম। ছাতা নাই সাথে? অবশ্য ছাতা দিয়েও এই বৃষ্টিতে রক্ষা হবেনা বোধহয়। তুই দাঁড়া ওখানেই, আমি দেখি কোন রিকশা পাই কিনা। বাসায় যাবি না হলে? হলে।
দশ মিনিট বাদেই একটা রিকশা এসে থামে দীপ্তির কাছাকাছি। দৌড়ে রিকশায় উঠতে উঠতেও দীপ্তি ভিজে যায় বেশ অনেকটাই। কি বৃষ্টিটাই না শুরু হলো বলোতো, এই অসময়ে? এদেশে আছেই দুই ঋতু, গরমকাল আর বর্ষাকাল। বৃষ্টির সময় অসময় কি এখানে? নিশ্চিত কালকে এসাইনমেন্টের লাস্ট ডেট।
হুম, তুমি জানলে কিভাবে?
একই গোয়ালেরই তো গরু। বইয়ে মুখ ডুবিয়ে ছিলি দেখে খেয়াল করিসনি কখন এতো অন্ধকার হয়েছে চারদিক।
হুট করেই যেন বৃষ্টির প্রকোপ কমে আসে একটু আর চারদিক আলো করে শেষ বিকেলের আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে আকাশ। চোখের সামনে আকাশ থেকে হলুদ কমলা রং যেন দ্যুতি ছড়াচ্ছিল। দেখো দেখো কি সু্ন্দর আকাশ!
উল্টোদিকে তাহলে নির্ঘাত রংধনু উঠেছে।
দুজনেই একসাথে মুখ বাড়িয়ে দেয় রিকশার পেছন দিয়ে রংধনু দেখবে বলে। একটু সময়ের জন্য একটু বেশী কাছাকাছি আসা, চারদিকের অদ্ভুত কন্যাসুন্দর আলোর বন্যা, আকাশ জুড়ে ফুঁটে থাকা রংধনু আর ঝিরিঝিরি বৃষ্টি সব মিলিয়ে যে অদ্ভুত এক মূহুর্ত তৈরী হয় ঠিক সেসময়ে দীপ্তির মনে এক অদ্ভুত হাহাকার জেগে ওঠে। কয়েক মূহুর্তের জন্য ফয়সালকে মনে হয় তার একান্ত নিজের মানুষ। খুব ইচ্ছে করে ফয়সালের হাতে হাত রাখতে। নিতান্তই হলের গেইট চলে আসাতে বোধহয় নিজের সেই অদ্ভুত ইচ্ছের মুখে লাগাম টানতে পারে দীপ্তি।
আমি আসি বলে হুড়মুড়িয়ে বলতে গেলে রিকশা থেকে নেমে আসে সে।
ছাতাটা নিয়ে যা। বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাঁধাবি।
ছাতার জন্য হাত বাড়াতেই ফয়সালের চোখে চোখ পড়ে তার। ফয়সালের ঘোরলাগা চোখে কি কোন অব্যক্ত কথা ছিল দীপ্তির জন্য নাকি পুরোটাই দীপ্তির মনের ভুল; সেই ব্যাখ্যা দীপ্তি এখনও খুঁজে পায়নি বলেই বুঝি থেকে থেকে ঐদিনের ঘটনাটা মনে পড়ে প্রায়শই।
‘আমি যাচ্ছি দীপ্তি’, দরজার বাইরে ফয়সালের গলা শুনে এক লহমায় বাস্তবে ফিরে আসে সে।
গল্প লেখা শেষ?
হুম প্রায়।
পড়তে দিবিনা?
ছুটির দিনের বিশেষ সংখ্যায় আসবে, পড়ে নিও তখন।
আমার আর কখনও বিশেষ হওয়া হলোনা তোর কাছে। আজীবন গ্রামের ছেলেই রয়ে গেলাম।
…………….
ঘুমের মধ্যেই ফয়সালের নাম শুনে চোখ মেলে দীপ্তি। ছুটির দিন বলে ভাত খাওয়া শেষে একটু ঘুমিয়েছিল। হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নিয়ে মাস্টার্স করতে সিঙ্গাপুর যাওয়া, দীপ্তিকে সেভাবে কিছু না জানানো এসব কারণে ফয়সালের সাথে গত এক বছরে তেমন একটা যোগাযোগ হয়নি দীপ্তির, মাঝে মাঝে মেসেঞ্জারে হাই হ্যালো ছাড়া। ফয়সাল এসেছে ভেবেই বিছানা থেকে নেমে দরজার কাছে যেতেই শুনতে পায় কেউ একজন বলছে, আমি আসলে ফয়সালের জন্য দীপ্তি মাকে আমার ঘরের বৌ করার আবদার নিয়ে এসেছি। রুম থেকে বের হবার চেয়ে বরং দরজা লাগিয়ে দেয়াই সমীচিন মনে হয় দীপ্তির। মেসেঞ্জারে ফয়সালের নামের পাশে সবুজ আলো দেখে সাথে সাথেই মেসেজ রাখে দীপ্তি।
মনে মনে এসব ছিল তোমার? ফিরতি মেসেজ আসে সাথে সাথেই। কি সব ছিল?
তোমার বাবা আমাদের বাসায়।
তাই? আমিতো কিছু জানিনা।
সত্যিই কিছু জানোনা না বলতে চাইছোনা।
কি জানতে চাও?
সব কিছু।
সেই কবেকার বৃষ্টিভেজা গোধূলীর আলোয় তোমার কতটুকু যে আমার কাছে রেখে গেছো তা তুমি নিজেও জানোনি আর আমাকেও তা ফিরিয়ে দেয়ার সুযোগই কখনও দাওনি। কারো কাছ থেকে গ্রামের ছেলের তকমাটুকু মুছে ফেলতেই এই বাইরে মাস্টার্স করতে আসার সিদ্ধান্ত। যদি কেউ ফিরে পেতে চায় তার রেখে যাওয়া অনেক কিছু। আরো কিছু জানতে চাও?????
ফয়সালের এতোগুলো প্রশ্নবোধক চিহ্নের উত্তরে ছোট্ট একটা লাভ ইমোজি দিয়ে চুপ করে যায় দীপ্তি। সেই সেদিনের ফয়সালের চোখের ঘোরলাগার মানে তবে ঠিক ঠিকই ধরতে পেরেছিল দীপ্তি।
ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস
জেনারেল প্র্যাকটিশনার, মিলডোরা, ভিক্টোরিয়া
…………………………………………………………………………………………………………