মেলবোর্ন, ১৩ এপ্রিল ২০২৫ – গতকাল শনিবার ১২ এপ্রিল ২০২৫ মেলবোর্নে কৃষ্ণা কুঠিরে পালন করা হলো পবনপুত্র হনুমান জয়ন্তী। অনেক দূর দুরান্ত থেকে এসে ভক্তরা কৃষ্ণা-কুঠিরে সন্ধ্যায় বজরংবলী শ্রী হনুমানের পূজায় অংশগ্রহণ করেন। ভক্তরা বিশ্ব শান্তি কামনায় এবং সংকটমোচনে ভগবান শ্রী হনুমানের কাছে ভক্তি নিবেদন করেন।
শ্রী হনুমান জয়ন্তী কেন উদযাপন করা হয় প্রশ্ন করা হলে আগত ভক্তরা জানান, শ্রী হনুমান একজন এমন দেবতা, যাঁর ভক্তি মানুষকে বিপদ থেকে রক্ষা করে এবং সকল দুঃখ-কষ্ট দূর করে দেন। তাই তাঁকে বলা হয় ‘সঙ্কট মোচন’, অর্থাৎ যিনি সংকট বা বিপদ মোচন করেন। শ্রী হনুমানজিকে ভক্তিভরে পূজা করলে তিনি রক্ষা করেন ও আশীর্বাদ প্রদান করেন। যদি কেউ হনুমান চলিশা পাঠ করেন, তাহলে তার জন্য ভগবান শ্রী হনুমানের দৈব্য সুরক্ষা প্রস্তুত থাকে সব সময়।তার পথের সব সঙ্কটও দূর হয়ে যায়।
কৃষ্ণা-কুঠিরে শ্রী হনুমান জয়ন্তীতে আগত ভক্তদের সাথে আলোচনার ফাঁকে জানা যায় এক বিশেষ আচার অনুসারে, শুধুমাত্র হনুমানজিকে সিঁদুর অর্পণ করা হয়। যদিও তিনি একজন ব্রহ্মচারি পুরুষ, তবুও তাঁকে সিঁদুর দিয়ে পূজা করা হয়। শ্রী হনুমান মন্দির হোক বা গৃহের পূজার ঘর – সর্বত্র এই রীতিরই অনুসরণ হয়।

পুরাণ অনুসারে, একদিন ভগবান শ্রী হনুমান দেখলেন দেবী সীতা সিঁদুর পরছেন। তিনি কৌতূহলবশত জানতে চান, কেন তিনি সিঁদুর পরেন। সীতা তখন উত্তরে বলেন, “আমি এই সিঁদুর রামচন্দ্রের দীর্ঘায়ু ও মঙ্গল কামনায় পরি।”
এ কথা শুনেই হনুমান ভাবলেন, যদি সিঁদুর শ্রীরামের দীর্ঘায়ুর প্রতীক হয়, তাহলে তিনি সিঁদুর পুরো শরীরে মেখে ঈশ্বর রামের প্রতি নিজের শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন।
এই নিঃস্বার্থ ভক্তি দেখে শ্রীরামচন্দ্র তাঁকে আশীর্বাদ করেন: “যে কেউ তোমাকে সিঁদুর দিয়ে পূজা করবে, তার মনস্কামনা পূর্ণ হবে।” সেই থেকে শুরু হয় সিঁদুর দানের এই পবিত্র রীতি।
ভগবান শ্রী হনুমান ভক্তির আদর্শ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ একবার বলেন:
“মহাবীর হনুমানের চরিত্রকে তোদের আদর্শ করতে হবে। দেখ, কীভাবে রামের আদেশে সমুদ্র পেরিয়ে গেলেন! জীবনে-মরণে তাঁর কোনও দ্বিধা নেই। তিনি ছিলেন ইন্দ্রিয়জয়ী ও বুদ্ধিমান। দাস্যভাবের এই মহান আদর্শে জীবন গঠন করাই সাফল্যের মূলমন্ত্র – ‘নান্যঃ পন্থা বিদ্যতে’। একদিকে যেমন সেবাময়তা, অন্যদিকে তেমনি সিংহবিক্রম! রামের মঙ্গলের জন্য প্রাণ দিতেও তিনি পিছপা হন না। এরকম একাগ্রতা চাই জীবনে।”
প্রাচীনকালের শ্লোকগুলোর মাধ্যমেই বুঝা জানা যায়, শ্রী হনুমান,বালি,সুগ্রীব এরা কেউ পশু ছিলেন না। জ্ঞানীগুণী এবং বুদ্ধিমান ব্যাক্তিত্ব ছিলেন। হনুমান কোন লেজওয়ালা বানর নন। তথ্য ঘেঁটে জানা যায় তিনি Vanara(Van-Forest,Nara-Human) অর্থাৎ বনমানুষ, তাদের Hanuman বলা হত কারন তাদের Hanu-Jaw,Man-Prominent অর্থাৎ বড় চোয়াল ছিল।
অধিকাংশ বিশেষজ্ঞদের মতেই শ্রী হনুমান, সুগ্রীব, বালি এরা ছিলেন উপজাতি জনগোষ্ঠীর মহামানব। এদের চোয়ালের অস্থি বড় ছিল এবং এরা বন্য এলাকায় বাস করতেন।
ড. জি. রামদাস তাঁর রামায়ণ গবেষণায় এবং ক্যাথরিন লুডভিক Hanuman in the Valmiki Ramayana and Tulsidasa’s Ramacharitamanas গ্রন্থে মত প্রকাশ করেছেন যে, বাল্মীকী রামায়ণের বর্ণনা অনুযায়ী বালি, সুগ্রীবের স্ত্রী এবং অন্যান্য বানর গোত্রের মহিলাদের কোনও লেজ ছিল না। আবার সুন্দর কাণ্ডে রাবণের দ্বারা হনুমানের বর্ণনায় তাঁর লেজকে অলংকার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এসব তথ্য থেকে অনুমান করা যায় যে হনুমান, সুগ্রীব ও বালি সম্ভবত সাবর গোত্রভুক্ত ছিলেন এবং তাঁরা কৃত্রিম লেজ ব্যবহার করতেন। অন্যদিকে, কিছু গবেষকের মতে হনুমান কানওয়ার নামে একটি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, যারা তাদের তুলনামূলকভাবে বৃহৎ চোয়ালের হাড়ের জন্য পরিচিত।

পূজা সমাপনীর পর পার্থ চক্রবর্তীর নেতৃত্বে ভক্তবৃন্দ হরিনাম সংকীর্তনে আনন্দঘন পরিবেশে অংশগ্রহণ করেন এবং প্রসাদ গ্রহণ করেন। কৃষ্ণা-কুঠিরের পক্ষ থেকে অজয় চক্রবর্তী অনুষ্ঠানে আগত সকল ভক্তদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন ও তাঁদের মঙ্গল কামনা করেন।
“ওঁ মনোজবং মারুততুল্যবেগং
জিতেন্দ্রিয়ং বুদ্ধিমতাং বরিষ্ঠম্।
বাতাত্মজং বানরযূথমুখ্যং
শ্রীরামদূতং শিরসা নমামি।।“
অর্থাৎ
আমি মস্তক অবনত করে শ্রদ্ধা জানাই সেই হনুমানজিকে, যিনি মন ও বায়ুর মতো দ্রুতগামী, ইন্দ্রিয় জয়ী, বুদ্ধিমানদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, বানরসেনার প্রধান এবং শ্রীরামের দূত।
প্রদীপ রায়, কৃষ্ণা-কুঠির, শ্রী হনুমান জয়ন্তী থেকে ফিরে