মতামত
লেখা: শামীম আহমেদ
টরন্টো, ১৭ এপ্রিল, ২০২৫- এই জিনিসটি বেশ কিছুদিন ধরে মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল, আজকে রাষ্ট্রদূত হারুন আল রশিদ ভাইয়ের একটি পোস্ট দেখে আবার মনে পড়ে গেল। আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে প্রায় ৮ মাস, স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি ও অগাস্ট ষড়যন্ত্রকারীরা ইতিমধ্যেই দেশকে ততটা ধ্বংস করে ফেলেছে যতটা গত ৫৪ বছরে কোন রাজনৈতিক দলও করতে পারেনি। এদিকে আওয়ামী লীগ দল হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না। অনির্বাচিত সরকারের প্রশাসন স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিদের সাথে নিয়ে তাদের উপর জুলুম নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে।
তবুও এরই মাঝে সারা বিশ্বব্যাপী মাথা তুলে দাঁড়িয়ে গেছেন অনেক মানুষ যারা কখনও আওয়ামী লীগের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন না, যাদের নাম আমরা আগে কখনও শুনিনি। তারাই এখন দেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে, স্বাধীনতা রক্ষার লড়াইয়ে সর্বাগ্রে।
তবুও এরই মাঝে সারা বিশ্বব্যাপী মাথা তুলে দাঁড়িয়ে গেছেন অনেক মানুষ যারা কখনও আওয়ামী লীগের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন না, যাদের নাম আমরা আগে কখনও শুনিনি। তারাই এখন দেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে, স্বাধীনতা রক্ষার লড়াইয়ে সর্বাগ্রে। এটি সত্য যে এদের অনেকেই আওয়ামী লীগের কোন দোষ দেখেন না, কিন্তু অন্তত এই অন্ধকার সময়ে তারা হাতে কলম তো তুলে নিয়েছেন – এটাই বা কম কীসে!
এই সময়ে, এই ক্রান্তিলগ্নে আমার মনে পড়ছে আওয়ামী লীগকে গত ১৬ বছর নেতৃত্ব দেয়া মন্ত্রী, এমপি, দলের বড় বড় পদে থাকা নেতাদের কথা। সেইসব নেতাদের কথা, যারা নিরাপদে দেশ ত্যাগ করতে পেরেছেন। এইসব নেতাদের দেশ ত্যাগের সিদ্ধান্তকে আমি প্রশ্নবিদ্ধ করব না, কারণ আমরা দেখেছি – দুর্নীতি, অন্যায়ের সাথে কোন সম্পৃক্ততা না থাকা সত্বেও কীভাবে শত শত নেতাকর্মীকে হয়রানি করা হয়েছে। মাশরাফির মতো সৎ, ব্যারিস্টার সুমনের মতো নিবেদিত স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরাও স্বাধীনতাবিরোধী উগ্র জঙ্গীদের হামলা থেকে রক্ষা পায়নি। এই জঙ্গীদের প্রশ্রয় দিয়েছে ইউনুস, ডার্টি মাস্টারমাইন্ডস এবং পঞ্চতান্ডবেরা।
দেশ থেকে অনেকে বাইরে গিয়ে নিরাপদে আছেন, তাই নিরাপদে থাকার জন্য তাদের চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তকে হয়ত সাময়িকভাবে সমর্থন করা যায়। কিন্তু এই চলে যাওয়াকে আবার প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন সাংবাদিক কবির য়াহমদ। তিনি বলছেন ইউনুসের অনির্বাচিত সরকার ২-৩ বছরের বেশী ক্ষমতায় থাকতে পারবে না; এই ২-৩ বছর জেলে থাকার সৎ সাহস কেন এইসব মন্ত্রী-এমপি, দলীয় নেতা-কর্মীদের থাকল না? তারা তো রাজনীতি করতে এসেছিল। রাজনীতি করতে যারা আসবে, তাদের তো অত্যাচার নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস থাকতে হবে। সেই সাহস তারা দেখালে আওয়ামী লীগ আরও দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে পারত এবং ইউনুস গং দেশকে মাত্র ৮-৯ মাসে ধ্বংস করে দিতে পারত না।
কবির য়াহমাদের যুক্তি মেনে নিচ্ছি। তবুও বাস্তবতা হচ্ছে অসংখ্য নেতা, মন্ত্রী, এমপি দেশ ছেড়েছেন, হয়ত বাধ্য হয়েছেন। এই বাস্তবতাও মেনে নিলাম। দেশ ছেড়েছেন শেখ পরিবারের রাজনীতির সাথে জড়িত প্রায় প্রত্যেকে। প্রায় লিখছি কারণ আমি সবাইকে চিনি না, কিন্তু যাদের চিনি তাদের কেউই দেশে নেই। শেখ পরিবারের প্রায় সব সদস্য দেশের বাইরে, আওয়ামী লীগের বেশীরভাগ এমপি-মন্ত্রী দেশের বাইরে – ভালো কথা। তারা জীবন নিয়ে বেঁচেছেন, বিদেশে আছেন, ধারণা করছি টাকা পয়সারও কোন সমস্যা নাই। আওয়ামী লীগের গত ১৬ বছর বাংলাদেশের ইতিহাসে উন্নয়নের মাপকাঠিতে সবচেয়ে স্বর্ণযুগ, কিন্তু একইভাবে এই সময়ে মন্ত্রী এমপিরা যে দুর্নীতি করেছে সেটিও আগের যে কোন সময়ের চাইতে বেশী। যেহেতু আমরা আওয়ামী সরকারের বেনেফিসিয়ারি না, এবং দেশের জন্য লিখি, তাই এটি আমরা বলব। আমি বলব।
তো; শেখ পরিবার ও মন্ত্রী এমপিরা সপরিবারে দেশের বাইরে গেলেন, ৮ মাসে নিশ্চয় বেশ গুছিয়েও নিয়েছেন। বাংলাদেশের অনির্বাচিত সরকার বা জঙ্গীরা এখন আর আপনাদের জন্য সেইভাবে হুমকি না। তাহলে আমাকে বলেন আপনারা এই মুহুর্তে দেশের জন্য, দলের জন্য বাইরে বসে বসে কী করছেন? আপনারা অন্তত নিজেদের ফেইসবুক, এক্স/টুইটার একাউন্টে সক্রিয় থেকে দেশে নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করতে পারতেন না? আপনারা অযোগ্য হলেও যে পরিমাণ টাকা পয়সা লুটপাট করেছেন, সেটি ভাল কাজে ব্যয় করে, শক্তিশালী একটা অনলাইন সোসাইটি বানিয়ে, মাথায় বিচার-বুদ্ধি আছে এমন মানুষদের দিয়ে গবেষণাধর্মী বিশ্লেষণ সারা বিশ্বের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারতেন না?
লুটপাটের টাকা পয়সা নিয়ে ওমরাহ করছেন, খোরমা খেজুর খাচ্ছেন; আর আশা করছেন দেশের নেতাকর্মীরা, উন্নত বিশ্বের মুক্তিযুদ্ধপ্রেমীরা আন্দোলন করে, লেখালেখি করে আবার আপনাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে?
আপনাদের তো সেটা করতে দেখলাম না। আপনারা লুটপাটের টাকা পয়সা নিয়ে ওমরাহ করছেন, খোরমা খেজুর খাচ্ছেন; আর আশা করছেন দেশের নেতাকর্মীরা, উন্নত বিশ্বের মুক্তিযুদ্ধপ্রেমীরা আন্দোলন করে, লেখালেখি করে আবার আপনাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে? আপনাদের এই প্রত্যাশা দেশের মানুষকে যে আপনারা ভৃত্য হিসেবে দেখেন তারই প্রতিচ্ছবি। আপনাদের কারও একাউন্টে কোন একটিভিটি নেই, আপনারা এতটাই নির্লজ্জ যে আপনারা বিদেশে পালিয়ে গিয়ে সেখান থেকেও লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছেন না?
এই দিক দিয়ে বলতে গেলে শুধুমাত্র গুলশানের এমপি মোহাম্মদ এ আরাফাত ক্রমাগত লিখে যাচ্ছেন। জুলাই-অগাস্টে উনার ভূমিকার সমালোচনা আছে, কিন্তু ওই সময়ের ব্যর্থতা পুরো সরকারের। এখন একমাত্র মোহাম্মদ এ আরাফাতকেই দেখছি লেখালেখি করছেন। বাকি এত এত নেতা-এমপি-মন্ত্রী আপনারা কোথায়?
শেখ হাসিনাও চেষ্টা করছেন, কিন্তু আমরা জানি শেখ হাসিনার পাবলিক কমিউনিকেসন অত্যন্ত দুর্বল। উনি গত ১০ বছর যখনই মুখ খুলেছেন, তখনই আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা কমেছে। বঙ্গবন্ধু এবং শেখ হাসিনার মধ্যে অদ্ভুত একটা বৈপরীত্য খেয়াল করি, সেটা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু পাবলিক স্পিকিং এবং মাস কমিউনিকেসনে দুর্দান্ত ছিলেন। তিনি অসম্ভব ভাল বক্তৃতা দিতে পারতেন, খুব সহজে মানুষের কাছে পৌঁছুতে পারতেন, তার কথা মানুষের কলিজায় গিয়ে লাগত। কিন্তু তিনি প্রশাসক হিসেবে অত দক্ষ ছিলেন না, এটা আশা করাও ঠিক না। যে মানুষটা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম করে জীবনের ১৩ বছর জেলে কাটিয়েছেন একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে তিনি প্রশাসক হিসেবে ভাল না হতেই পারেন।
কিন্তু শেখ হাসিনা ঠিক তার উল্টো। তিনি ১৬ বছরের শেষ ২০ দিন বাদে প্রশাসক হিসেবে অসামান্য দক্ষতা দেখিয়েছেন, কিন্তু তিনি জনগণের হৃদয় যতটুকু জয় করেছেন, যতবারই ভাষণ দিয়েছেন, ততবারই সেই জনপ্রিয়তা কমেছে। তিনি ভারত থেকে যতবার কথা বলেছেন, আমি কোন বিবেচক মানুষকে তার প্রশংসা করতে দেখিনি। অনেকে বলছেন কর্মীদের চাঙা রাখার জন্য তার কথা বলা জরুরী। হতে পারে এটি সত্য। কিন্তু তিনি যদি তার উত্তরসূরি তৈরী করতেন, ১০ জন নেতা তৈরী করতেন, তাহলে নেতাকর্মীদের তার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হতো না।
ব্যক্তিপুজোর দিন শেষ। বিপুল ক্ষমতাধর বাইডেন নির্বাচন শেষ হবার পর আলোচনার বাইরে। বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি মানুষের হৃদয় জয় করা ক্যানাডার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো যেদিন ক্ষমতা ছেড়েছেন, তারপরের দিন থেকে তার ব্যাপারে বিশ্ব মিডিয়ায় এমনকি মানুষের মধ্যে কোন আলোচনা নেই।
বিশ্ব রাজনীতি আগের মতো আর নেই। ব্যক্তিপুজোর দিন শেষ। বিপুল ক্ষমতাধর বাইডেন নির্বাচন শেষ হবার পর আলোচনার বাইরে। বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি মানুষের হৃদয় জয় করা ক্যানাডার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো যেদিন ক্ষমতা ছেড়েছেন, তারপরের দিন থেকে তার ব্যাপারে বিশ্ব মিডিয়ায় এমনকি মানুষের মধ্যে কোন আলোচনা নেই। অথচ আমাদের রাজনীতিবিদরা এখনও ব্যক্তিপুজোর ভরসায় থাকেন। আমরা সাধারণ মানুষও সকাল-বিকেল তাদের প্রণাম করে যাচ্ছি। ভক্ত সমর্থকদের কাছে শেখ হাসিনার কোন বিকল্প নেই। সর্বোচ্চ আদালতে প্রমাণিত ও দন্ডপ্রাপ্ত আসামী তারেক জিয়ারও কোন বিকল্প নেই।
আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের যেমন নিজেদের গুছিয়ে নিতে হবে, তেমনই প্রশ্ন করতে হবে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা এমপি-মন্ত্রী ও শেখ পরিবারের সদস্যদের গত ৮ মাসের ভূমিকা কী? তারা কে কোথায়? তারা জনগণের কাছে জবাবদিহিতা করছে না কেন? আমি জানি আওয়ামী লীগের যে অংশটি অন্ধ, তারা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আবার ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখছে। তারা বলছে এই মুহুর্তে দলের আগের কোন কর্মকান্ডকে প্রশ্ন করা যাবে না, নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না, এখন দলের খারাপ সময়, ক্ষমতায় আসলে তারা এসব দেখবে – আমি সাধারণ সমর্থকদের বলি – এদের একফোঁটা বিশ্বাস করবেন না।
জুলাই-অগাস্টে বাংলাদেশ পাল্টে গেছে আজীবনের জন্য। ভাল কিছু হয়নি আফসোস, যদিও হতে পারত। ইউনুস বাংলাদেশকে বদলে দিতে পারত। সেটা করেনি। কিন্তু এই খারাপের মধ্যেও আওয়ামী লীগের জন্য অনেক কিছু শেখার আছে। বঙ্গবন্ধু যে আওয়ামী লীগের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছেন, স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরেও সেই দলের নেতৃত্বে শেখ পরিবারের কাউকেই থাকতে হবে এমন কোন কথা নেই। আর কেউ যদি থাকতে চায় এই বিপন্ন সময়ে তার যোগ্যতা প্রমাণ করে দেখাতে হবে। দুবাই-কলকাতা-ফিনল্যান্ড-আমেরিকায় বসে গ্রীষ্মকালীন ছুটি শেষে তারা আবার ৫ বছর পর দেশ শাসন করতে চাইলে সেটা মেনে নেবেন না।
আমার আজকের লেখাও ভবিষ্যত আওয়ামী লীগের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্যই লেখা। তবুও জানি কিছু জঙ্গী, মৌলবাদী এই লেখাতেও খুশী হবে না, তাদের খুশী করাও আমার কাজ না। আমার কাজ দেশের স্বার্থে, ভবিষ্যতের গণতান্ত্রিক আওয়ামী লীগকে স্বাধীনতার আদর্শকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার লড়াইয়ে শক্তিশালী করা।
আর সেই কাজের জন্য বিগত ১৬ বছরের প্রভাবশালী নেতা-এমপি-মন্ত্রী ও শেখ পরিবারের সদস্যদের কেবল বিগত ১৬ বছরের নয়; বরঞ্চ গত ৮ মাসের কার্যকলাপকেও প্রশ্ন করতে হবে।
লেখক: শামীম আহমেদ, টরন্টো, অন্টারিও
উল্লিখিত মতামত লেখকের নিজস্ব, এবং প্রতিষ্ঠানের অবস্থান বা দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত করে না।