মেলবোর্ন, ২৭ এপ্রিল- সিন্ধু নদের কাছে নিজের শুকিয়ে যাওয়া সবজির জমিতে চিন্তিত মুখে কীটনাশক ছিটাচ্ছিলেন পাকিস্তানি কৃষক হোমলা ঠাকুর। সূর্য মাথার ওপরে, নদীর পানি কমে গেছে। অন্যদিকে কাশ্মীরে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর উজান থেকে পানি বন্ধের হুমকি দিয়েছে ভারত।
৪০ বছর বয়সী ঠাকুর বলেন, “যদি তারা পানি বন্ধ করে, তাহলে পুরো দেশটাই মরুভূমি হবে। আমরা না খেয়ে মরে যাব।”
এরপর তিনি স্প্রে মেশিনে পানি ভরার জন্য নদীর দিকে ফিরে যান।
ঠাকুরের প্রায় পাঁচ একর জমি পাকিস্তানের দক্ষিণ-পূর্ব সিন্ধু প্রদেশের লতিফাবাদ এলাকায়। তিব্বত থেকে শুরু হয়ে ভারত হয়ে পাকিস্তান দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার পর সিন্ধু নদীর পানি সেখান দিয়ে আরব সাগরে গিয়ে মেশে।
ঠাকুরের এই ভয় ১৫ জনেরও বেশি পাকিস্তানি কৃষক এবং অনেক বিশেষজ্ঞের মধ্যেও প্রতিধ্বনিত হয়েছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায়।
প্রথমবারের মতো ভারত বুধবার ১৯৬০ সালে হওয়া সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিত করেছে। এই চুক্তির মাধ্যমে পাকিস্তানের ৮০ শতাংশ কৃষিজমিতে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছিল।
ভারত বলেছে, এই স্থগিতাদেশ চলবে যতক্ষণ না ‘পাকিস্তান আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসবাদের সমর্থন নির্ভরযোগ্যভাবে ও অপরিবর্তনীয়ভাবে ত্যাগ করে’।
ভারত বলছে, কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর হামলা চালিয়ে ২৬ জনকে হত্যাকারী তিন জঙ্গির মধ্যে দুইজন পাকিস্তান থেকে এসেছে। ইসলামাবাদ কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেছে।
তারা জানিয়েছে, “পাকিস্তানের প্রাপ্য পানি আটকানোর বা সরানোর যে কোনো চেষ্টা যুদ্ধের কাজ হিসেবে গণ্য করা হবে।”
এই চুক্তির মাধ্যমে সিন্ধু ও তার শাখা নদীগুলো পরমাণু শক্তিধর দুই প্রতিবেশীর মধ্যে ভাগ করা হয়েছিল।
সরকারি কর্মকর্তা এবং উভয় দেশের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারত তাৎক্ষণিকভাবে পানি বন্ধ করতে পারবে না।
কারণ চুক্তিতে বলা হয়েছে, ভারতের শুধুমাত্র জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের অনুমতি আছে। বড় ধরনের পানি সংরক্ষণ বা বাঁধ নির্মাণের অনুমতি নেই। তবে কয়েক মাসের মধ্যেই পরিস্থিতি বদলাতে পারে।
ভারতের পানি সম্পদ মন্ত্রী চন্দ্রকান্ত রঘুনাথ পাটিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে লিখেছেন, “আমরা নিশ্চিত করব সিন্ধু নদীর এক ফোঁটা পানিও যেন পাকিস্তানে না পৌঁছায়।”
তবে পাকিস্তানের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া আতঙ্ক নিয়ে তিনি কোনো প্রশ্নের উত্তর দেননি।
ভারতের দুইজন সরকারি কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানান, ভারত কয়েক মাসের মধ্যে সেচখালের মাধ্যমে নিজের কৃষি খাতে পানি প্রবাহ সরাতে পারে। একই সঙ্গে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিকল্পনা শুরু করতে পারে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে চার থেকে সাত বছর সময় লাগতে পারে।
প্রাথমিকভাবে ভারত এখন থেকে পাকিস্তানকে নদী প্রবাহ সম্পর্কিত তথ্য ও বন্যা সতর্কতা দেবে না। একই সঙ্গে দেশটি স্থায়ী সিন্ধু কমিশনের বার্ষিক সভায় অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকবে।
সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিতের বিষয়টি কেবল কৃষিকাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। পানি সংকট বিদ্যুৎ উৎপাদনেও বড় ধরনের আঘাত হানবে। এধরনের পরিস্থিতি পাকিস্তানের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিতে পারে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক পরামর্শক সংস্থা অক্সফোর্ড পলিসি ম্যানেজমেন্টের অর্থনীতিবিদ ওয়াকার আহমেদ বলেন, “পাকিস্তান ভারতের এই হুমকির বিষয়টি অবমূল্যায়ন করেছে।”
তিনি বলেন, “ভারতের কাছে তাৎক্ষণিকভাবে পানি আটকে দেয়ার মতো অবকাঠামো নেই। বিশেষ করে বন্যার সময়। তাই এই সময়টি পাকিস্তানের জন্য তাদের পানি খাতের অদক্ষতা দূর করার একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ। আমাদের পানির ব্যবস্থাপনায় অনেক অপচয় এবং ফাঁক আছে।”
গত কয়েক বছরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকার চুক্তিটি পুনরায় আলোচনার চেষ্টা করেছে। দুই দেশ নেদারল্যান্ডসের হেগের পার্মানেন্ট কোর্ট অব আরবিট্রেশনে কিশেংগঙ্গা ও রাতলে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের পানি সংরক্ষণ সংক্রান্ত বিরোধ মীমাংসার চেষ্টা করছে।
ভারত তাদের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত বিভিন্ন নদীর পানি প্রবাহের তথ্য ভাগাভাগি করা বন্ধ করে দিয়েছে, বন্যার সতর্কতা দেওয়া স্থগিত করেছে এবং স্থায়ী সিন্ধু কমিশনের বার্ষিক বৈঠক বন্ধ করে দিয়েছে বলে রয়টার্সকে জানিয়েছেন দেশটির কেন্দ্রীয় পানি কমিশনের প্রধান হিসেবে অবসর নেওয়া কুশবিন্দর ভোহরা। তিনি সিন্ধু কমিশনার হিসেবে দায়িত্বপালন করেছেন আর এখন মাঝে মাঝে সরকারের পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন।
ভোহরা বলেন, “এখন আমরা স্বাধীনভাবে আমাদের প্রকল্পগুলো চালাতে পারব।”
বিশ্বব্যাংকের একজন মুখপাত্র বলেছেন, “আমরা চুক্তির স্বাক্ষরকারী। তবে আমাদের ভূমিকা একটি নির্দিষ্ট দায়িত্বসীমায় সীমাবদ্ধ। সদস্য দেশগুলোর সার্বভৌম সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা কোনো মতামত দেই না।”
সিন্ধু প্রদেশে ১৫০ একর জমির মালিক নাদিম শাহ। তিনি তুলা, আখ, গম ও সবজি চাষ করেন।
নাদিম বলেন, “আমরা আল্লাহর উপর ভরসা করি, তবে ভারতের পদক্ষেপ নিয়ে উদ্বেগ আছে।”
পাকিস্তানের ২৪ কোটি মানুষের বাস। দেশের জন্য বরাদ্দ তিনটি নদীর পানি দিয়ে প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া হয়, যা দেশের মোট কৃষিজমির ৮০ শতাংশ।
করাচিভিত্তিক গবেষণা সংস্থা পাকিস্তান এগ্রিকালচার রিসার্চ-এর ঘাশারিব শাওকাত বলেন, “এই মুহূর্তে আমাদের কোনো বিকল্প নেই। এই নদীগুলো শুধু কৃষিকাজ নয়, নগর জীবন, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং কোটি কোটি মানুষের জীবিকার জন্য দরকার।”
পাকিস্তানি রাজনীতিকরা বলেছেন, সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত হওয়া একটি বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি বলেন, “আমরা ইতোমধ্যেই কয়েক প্রজন্ম ধরে সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে আছি। যদি সিন্ধু জল চুক্তি থেকে বের হয়ে যাই, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও এক নতুন ধরনের সংঘর্ষের মধ্যে জড়াব। এটা হতে দেওয়া উচিত নয়।”